কর্মযোগ
প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দুধর্মে দুইটি মার্গ বা পথ প্রচলিত আছে, যথা— প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি মার্গ। কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে ঈশ্বর সাধনাই প্রবৃত্তি মার্গ। যেমন— বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, পূজা, আশ্রম, সংস্কার প্রভৃতি প্রবৃত্তি মার্গের অন্তর্গত। নিবৃত্তি মার্গ বলতে বহির্মুখী ইন্দ্রিয়কে নিবৃত্ত করে ঈশ্বরে মন স্থাপন করা বেঝায়। সহজ কথায় প্রবৃত্ত মার্গ হল সৎকর্মে প্রবৃত্ত হওয়া এবং নিবৃত্তি মার্গ হল অসৎ কর্ম হতে নিবৃত্ত হওয়া। এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি মার্গকে আশ্রয় করেই কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি যোগের সৃষ্টি হয়েছে। নিচে কর্ম যোগের বর্ণনা করা হল।
কর্মযোগ কি
ঈশ্বরের প্রতি মনকে যুক্ত করার পন্থাই যোগ। আর
কর্মের মাধ্যমে ঈশ্বরে মনোনিবেশ করাই কর্মযোগ।
কর্মযোগ কত প্রকার
শাস্ত্রের অনুসারে কর্ম প্রধানত দুই প্রকার, যথা— শ্রৌত-কর্ম ও স্মার্ত-কর্ম। শ্রুতি বা বেদকে আশ্রয় করে যে কর্ম তাকে শ্রৌত-কর্ম এবং স্মৃতি-শাস্ত্রকে আশ্রয় করে যে কর্ম তাকে স্মার্ত-কর্ম বলে। শ্রৌত-কর্ম বলতে মূলত যাগ-যজ্ঞ বোঝায় আর স্মার্ত-কর্ম বলতে আশ্রম, সংস্কার, ব্রত, প্রায়শ্চিত্ত, দান প্রভৃতি বোঝায়। আবার অন্যভাবে কর্মযোগকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যথা— নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্ম। কামনা-বসনাশূন্য কর্মকে নিষ্কাম কর্ম আর কামনা-বাসনাযুক্ত কর্মকে সকাম কর্ম বলে। সকাম কর্মে বন্ধন হয় কিন্তু নিষ্কাম কর্মে কোন বন্ধন হয় না। তাই মুক্তিলাভের জন্য অবশ্যই নিষ্কাম কর্ম করতে হবে।
কর্মযোগের লক্ষণ
কর্মযোগীর লক্ষণ তিনটি, যথা— ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন, কতৃর্ত্বাভিমান ত্যাগ এবং ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমার্পণ। কর্ম করে যেতে হবে কিন্তু কর্মফলের আশা করা যাবে না। মনে করতে হবে সব কর্ম ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরই মানুষকে দিয়ে কর্ম করিয়ে নিচ্ছেন। আমি করছি, আমার কর্ম এরকম অহংকার বর্জন করাকে কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ বলে। সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমার্পণ করতে পারলেই প্রকৃত কর্মযোগী হওয়া যাবে।
গীতায় কর্মযোগ
গীতায় তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক এই তিন প্রকার কর্মের কথা বলে হয়েছে। ফল কি হবে, নিজের সামর্থ্য কতটুকু প্রাণিহিংসাদি পাপ হবে কিনা, পরিণামে কি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এসব বিচার না করে মোহবশত যে কর্ম আরম্ভ করা হয়, তা তামসিক কর্ম বলে কথিত। ফল-কামনা করে অথবা অহঙ্কার সহকারে বহু আয়াস স্বীকার করে আড়ম্বরের সাথে যে কর্ম করা হয় তাকে রাজসিক কর্ম বলে। কিন্তু ফল-কামনা পরিত্যাগ করে, হিংসা-ক্রোধ বর্জন করে অনাসক্ত হয়ে যে কর্ম করা হয় তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলে। তিনটি কর্মের মধ্যে সাত্ত্বিক কর্মই শ্রেষ্ঠ এবং এই সাত্ত্বিক কর্ম মূলত নিষ্কাম।
বেদান্তে কর্মযোগ
বেদান্তসার গ্রন্থে কাম্য, নিষিদ্ধ, নিত্য, নৈমিত্তিক, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি কর্মের উল্লেখ আছে। স্বর্গ ও অন্যান্য সুখলাভের আশায় যে কর্ম করা হয় তাকে কাম্য কর্ম বলে, যেমন— জ্যোতিষ্টোম, সোম-যাগ ইত্যাদি। যেসব কর্ম করলে নরকবাস হয় তাকে নিষিদ্ধ কর্ম বলে, যেমন— ব্রহ্মহত্যা, হরণ করা প্রভৃতি। যে সকল কর্ম কোন কিছুর নিমিত্তে বা উপলক্ষে করা হয় তাকে নৈমিত্তিক কর্ম বলে, যেমন— উপনয়নাদি সংস্কার, গ্রহণ উপলক্ষে স্নান, পুত্র জন্মালে দ্বাদশকপাল, বৈশ্বানর যজ্ঞ করা প্রভৃতি। যে সকল কর্ম কেবল পাপ ক্ষয়ের জন্য করা হয় তাকে প্রায়শ্চিত্ত কর্ম বলে, যেমন— চান্দ্রায়ণ, চৌর প্রায়শ্চিত্ত, পতিত-সংসর্গ প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি।
কর্ম ছাড়া কেউই বাঁচতে পারে না। তাই কর্মযোগীকে
নিষ্কাম ও সৎকর্ম করে যেতে হবে। কর্ম করতে করতে একদিন তার ঈশ্বরের প্রতি তীব্র ভক্তি
জন্মাবে। তখন সংসারের সব অনিত্য কর্ম ত্যাগ করে তিনি শুধু ঈশ্বরের কর্মই করবেন এবং
তাতেই তার একদিন মুক্তি লাভ হবে।
(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)
কর্মযোগ সংক্রান্ত পিডিএফ বই “কর্মযোগ” পড়তে বা ডাউনলোড করতে নিচের DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন
কর্মযোগ সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন
আরও পড়ুন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন