7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১

বেদ ও বৈদিক গ্রন্থ

 বেদ কি ও কত প্রকার এবং বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থের পরিচয়

    হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ। বেদের উপর ভিত্তি করেই হিন্দুধর্মের কাঠামো তৈরী হয়েছে। ‘বিদ’ ধাতু হতে বেদ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘বিদ’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান। এই জ্ঞান বা বিদ্যা দুই প্রকার, যথা পরা ও অপরা বিদ্যা। জাগতিক বা লৌকিক বিষয় সম্পর্কিত বিদ্যাই পরা বিদ্যা আর ব্রহ্ম সম্পর্কিত বিদ্যাই অপরা বিদ্যা। পরা বিদ্যা থেকে অপরা বিদ্যা শ্রেষ্ঠ। বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ কোন পুরুষ দ্বারা রচিত নয়। বেদে বিভিন্ন মন্ত্রগুলোর রচয়িতা হিসেবে বিভিন্ন ঋষির নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু বেদ ঋষি কতৃর্ক সঙ্কলিত হলেও বেদের জ্ঞান স্বয়ং ঈশ্বর প্রদত্ত। অর্থাৎ ঋষিগণ ঈশ্বর কতৃর্ক যে জ্ঞান লাভ করেছেন তাই লিপিবদ্ধ করে বেদ সৃষ্টি করেছেন। মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে সমগ্র বৈদিক সাহিত্য গঠিত। বেদ কর্ম ও জ্ঞান কাণ্ডে বিভক্ত। কর্মকাণ্ড আলোচনা করে যজ্ঞ ও বিভিন্ন মাঙ্গলিক-ক্রিয়া সম্পর্কে। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। জ্ঞানকাণ্ড আলোচনা করে ব্রহ্ম (ঈশ্বর) ও মুক্তি সম্পর্কে। আরণ্যক ও উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত। মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব বেদ সংহিতাকে ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব এই চারটি ভাগে বিভাজন করেন। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল।


ঋক্-বেদ সংহিতা

    চতুর্বেদের মধ্যে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলো সর্বপেক্ষা প্রাচীন। ‘ঋচ’ ধাতু থেকে ঋক শব্দটি এসেছে যার অর্থ স্তুতি করা। ঋগ্বেদে বিভিন্ন দেবতাদের স্তুতি বা প্রশংসা করা হয়েছে। আবার ঋক অর্থ মন্ত্র। কয়েকটি ঋক বা মন্ত্র নিয়ে একটি সূক্ত এবং কয়েকটি সূক্ত নিয়ে একটি মণ্ডল গঠিত হয়। ঋগ্বেদে ১০টি মণ্ডলে ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৫৫২টি ঋক বা মন্ত্র আছে। ১০,৫৫২টি মন্ত্রে ৩,৯৭,২৬৫টি অক্ষর রয়েছে। এর মধ্যে আচার্য সায়ন ১১টি সূক্তের মোট ৮০টি ঋকের ভাষ্য রচনা করেননি। এইগুলো বালখিল্য নামে পরিচিত। ঋগ্বেদের আর এক প্রকার বিভাজন আছে। সেখানে সমগ্র ঋগ্বেদকে ৮টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার প্রতি ভাগকে বলা হয় অষ্টক। কতগুলো মন্ত্র বা ঋক নিয়ে গঠিত হয় বর্গ এবং কতগুলো বর্গ নিয়ে গঠিত হয় অধ্যায়। প্রতিটি অষ্টক ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত। বেদ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। ঋকবেদের ২১টি শাখা রয়েছে। সে ২১টি শাখার মধ্যে শাকল, বাস্কল, আশ্বানয়ন, শাংখ্যায়ন ও মাণ্ডুকেয় শাখাগুলো প্রচলিত রয়েছে।

  এবার ঋগ্বেদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ঋগ্বেদে দেবমাতা অদিতির কথা উল্লেখ আছে। অখণ্ড, অচ্ছিন্ন, অসীম ও অনন্ত প্রকৃতির নাম অদিতি। অদিতির গর্ভেই দেবতাদের জন্ম। ঋগ্বেদে রাজা ভারত ও সুদাসের যুদ্ধের কাহিনী বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। রাজা ভারতের পুরোহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র আর সুদাসের পুরোহিত ছিলেন বশিষ্ঠ। যুদ্ধে ভারত সহ দশ জাতি পরাজিত হয়। যুদ্ধে জয়লাভ  করায় সুদাস রাজা বশিষ্ঠকে ২০০টি গরু, ২টি রথ ও ২টি অশ্বদান করেছিলেন। ঋগ্বেদে রাজা মান্ধাতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন রাজর্ষি। এখনও মানুষ প্রাচীনত্ব বোঝাতে ‘মান্ধাতার আমল’ কথাটি বলে। ঋগ্বেদে বর্ণিত কক্ষীবানের গল্পটি বেশ চমকপ্রদ। গল্পটি এরকম কক্ষীবান অধ্যয়ন সমাপ্ত করে বাড়ি ফেরার পথে এক জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। স্বনয় রাজা কক্ষীবানের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন এবং তাঁর দশ কন্যার সাথে বিবাহ দিলেন। স্বনয় রাজা বিবাহের উপহার সামগ্রী হিসেবে ১০০ নিস্ক (৩২০০ রতি) স্বর্ণ, ১০০টি অশ্ব, ১০০টি বৃষ, ১০৬০টি গাভী ও ১১খানা রথ দিয়েছিলেন। বহু-বিবাহের প্রচলন যে বৈদিক যুগেও ছিল তা এই গল্পে ফুটে ওঠে।

    সাধনার দ্বারা মানুষও দেবত্ব লাভ করতে পারে, তার প্রমাণ ঋগ্বেদে আছে। ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলের ১৬১ নং সূক্তে বলা হয়েছে- সুধন্বপুত্র ঋভু, বিভু ও বাজ একদিন সোমরস পান করছেন এমন সময় দেবতারা অগ্নিকে তাঁদের নিকট পাঠালেন। অগ্নি তাঁদের দেবত্ব পরীক্ষা করার জন্য একটি চমসকে চার খণ্ড করতে এবং অশ্ব, ধেনু ও রথ নির্মাণ করতে বললেন। ঋভুগণ সে সব কিছু করে দেখালেন। ফলে ঋভুগণ দেবতার মর্যাদা পেলেন।

ঋকবেদ


    বৈদিক যুগেও নারীরা অবহেলিত ছিল না। ২য় মণ্ডলের ১৭নং সূক্তে উল্লেখ আছে সে সময় একদল নারী চিরকুমারী থাকত এবং তাঁরা সম্পত্তির ভাগ পেত। স্বয়ংবর সভায় নারীরা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বর বেছে নেয়ার সুযোগ পেত। এছাড়াও বিবাহের সময় কন্যা শ্বশুর বাড়ি কতৃর্ক উপঢৌকন (অর্থ বা দ্রব্য-সামগ্রী) পেতেন। বৈদিক যুগে নারী ও পুরুষের একত্রে যজ্ঞ করার অধিকার ছিল শুধু তাই না, নারীরাও যজ্ঞের পুরোহিত হতে পারতেন। পাওয়া যায় ঋগ্বেদের ৫ম মণ্ডলের ২৮ নং সূক্তের ঋষি “বিশ্ববারা” একজন নারী ছিলেন। এছাড়া বেদে লোপামুদ্রা, রোমশা, জুহু, পৌলোমী, কাক্ষীবতী ঘোষা, জরিতা, শ্রদ্ধা কামায়নী প্রভৃতি নারী-ঋষির পরিচয় পাওয়া যায়।

   ঐসব সূক্তগুলোতে জগৎ সৃষ্টির কথা ও মায়ার বর্ণনা আছে। ঋগ্বেদে বহু দেবতার স্তুতি থাকলেও ইহা একেশ্বরবাদকেই সমর্থন করে। ঋগ্বেদে যে দার্শনিক সূক্তগুলো আছে, সেগুলো অতি মহৎ। ঋগ্বেদের উপমা ও দর্শন অতি সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন ১০ম মণ্ডলে আছে যে, যমী তাঁর ভ্রাতা যমের সাথে মিলিত হতে চায় কিন্তু যম তাতে রাজী হয় না। এর পিছনের একটি সূক্ষ্ম দর্শন রয়েছে। আসলে যম ও যমী হচ্ছে গদ্ধর্ব (সূর্য) ও আপাঘোষার (উষা) দুই জমজ সন্তান। মূলত যম দিন ও যমী রাত্রীর প্রতীক। দিবা-রাত্রীর মিলন হাতে পারে না, তাই যম ও যমীর মিলন হয়নি। সূর্যের কারণে দিবা-রাত্রী সৃষ্টি হয়। এজন্য সূর্যকে দিবা-রাত্রীরূপী যম ও যমীর পিতা বলা হয়েছে। এরকম অনেক রূপক কাহিনী ঋগ্বেদে আছে। ঋগ্বেদকে বেদের জ্ঞানকাণ্ড বলা হলেও দশম মণ্ডলে কিছু রোগ-নিবারণ, গর্ভরক্ষা, শত্রুনাশ, অলক্ষ্মীনাশ প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ আছে যা মূলত কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত।  

সাম-বেদ সংহিতা

    ‘সো’ ধাতু হতে সাম শব্দটি গঠিত হয়েছে যার অর্থ সঙ্গীত। সামবেদের মন্ত্রসমূহ সুর করে গাওয়া হয়। এই বেদের অধিকাংশ মন্ত্র ঋগ্বেদ থেকে চয়ন করা হয়েছে। মন্ত্রগুলো ঋগ্বেদের অষ্টম ও নবম মণ্ডলে আছে। সামবেদে মোট মন্ত্রসংখ্যা ১৮১০টি। সামবেদ ৩ ভাগে বিভক্ত, যথা পূর্বার্চিক মহালক্ষ্মী আর্চিক ও উত্তরার্চিক। চরণব্যুহ গন্থে সাম বেদের ৭টি শাখার পরিচয় পাওয়া যায়, যথা রাণায়নীয়, শাত্যমুগ্র, কলাপ, মহাকলাপ, শাদূর্ল, লাঙ্গলায়ন এবং কৌথুম। বর্তমানে রাণায়নীয়, কৌথুম ও জৈমিনীয় এই তিনটি শাখা পাওয়া যায়।

যজুর্বেদ সংহিতা

   ‘যজ্’ ধাতুর উত্তরে উসি প্রত্যয় যোগে যজুস্ পদটি গঠিত। যজ্ ধাতুর অর্থ যজন বা যজ্ঞ করা। তাই যজুর্বেদের আলোচ্য বিষয় যজ্ঞ। যজুর্বেদে দর্শপূর্ণ, পিণ্ডপিতৃ, চাতুর্মাস্য, রাজসূয়, অগ্নিহোত্র, জ্যোতিষ্টোম, অশ্বমেধ, সর্বমেধ ইত্যাদি যজ্ঞের বর্ণনা আছে। যজুর্বেদ শুক্ল ও কৃষ্ণ এই দুই ভাগে বিভক্ত। শুক্ল-যজুর্বেদ দুই ভাগে বিভক্ত, যথা মাধ্যন্দিন ও কান্ব। কৃষ্ণ-যজুর্বেদ চার ভাগে বিভক্ত, যথা তৈত্তিরীয়, কাঠক, মৈত্রায়ণীয় ও কাপিষ্ঠল। শুক্ল-যজুর্বেদে ৪৪টি অধ্যায়, ৩০৩টি অনুবাদক এবং ১৯১৫টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র রয়েছে। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখাতে মোট ৭টি কাণ্ড, ৪৪টি প্রপাঠক, ৬৪৪টি অনুবাক এবং ২১৮৪টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র রয়েছে। সব মিলিয়ে যজুর্বেদে মোট ১,৯২,০৯০টি মন্ত্র, ১৯৪৮৮টি বাক্য ও ২৫৩৮৬৮টি অক্ষর রয়েছে। ঋক্ ও সাম পদ্যে রচিত হলেও যজুঃ ও অথর্ব গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিতে রচিত। পতঞ্জলি মহাভাষ্যে যজুর্বেদের ১০০টি শাখার কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমানে যজুর্বেদের মাত্র ৫টি শাখা প্রচলিত, যথা শুক্ল-যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী সংহিতার মাধ্যন্দিন ও কান্ব এবং কৃষ্ণ-যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতার কাঠক, মৈত্রাণীয় ও তৈত্তিরীয় শাখা।

অথর্ব-বেদ সংহিতা

   চতুর্বেদের মধ্যে অথর্ববেদ সবার শেষে রচিত। এর অপর নাম অথর্বাঙ্গিরস (অথর্ব + অঙ্গিরস)। “অথর্ব” দ্বারা ব্যাধি নিরাময়, গর্ভরক্ষা, পুত্রোষ্টিক্রিয়া, ভোজবিদ্যা প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যকাণ্ড বোঝায় এবং “অঙ্গিরস” দ্বারা শত্রুবধ, উচাটন, বশীকরণ, অভিচার ইত্যাদি অমঙ্গলজনক কর্মকাণ্ড বুঝায়। ব্যসদেবের শিষ্য সুমন্ত আর সুমন্তের শিষ্য কবন্ধু প্রথমে গুরুর নিকট অথর্ববেদ পাঠ করেন। বিষ্ণু পুরাণ মতে অথর্ববেদের যে ৫টি খণ্ড যথা নক্ষত্র, বৈতনিক, সংহিতা অঙ্গিরস ও শান্তি কল্প। অথর্ববেদে মোট ২০টি কণ্ডিকা, ৩৮টি প্রপাঠক, ৯০টি অনুবাক, ৭৩১ টি সূক্ত এবং প্রায় ৬০০০ মন্ত্র রয়েছে। অথর্ববেদের ৯টি শাখা থাকলেও শৌনক ও পিপ্পলাদ এই দুটি শাখা বর্তমানে প্রচলিত। 

ব্রাহ্মণ

   ব্রাহ্মণ নামক গ্রন্থে মূলত যাগযজ্ঞের ক্রিয়া-প্রণালী বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক বেদের প্রত্যেক শাখায় একটি করে ব্রাহ্মণ আছে। বেদে যজ্ঞীয় দেবতার স্তুতি রয়েছে আর ব্রাহ্মণে যজ্ঞের নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধান রয়েছে। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ সংখ্যা দুটি, একটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং অপরটি কৌষিতকি ব্রাহ্মণ। সামবেদের আটটি ব্রাহ্মণ, যথা ১) তাণ্ড্যমহা বা পঞ্চবিংশ, ২) ষড়বিংশ, ৩) ছান্দোগ্য, ৪) জৈমেনিয় বা তলবকার, ৫) সামবিধান, ৬) দেবতাধ্যায়, ৭) আর্ষেয় এবং  ৮) বংশ ব্রাহ্মণ। কৃষ্ণ যজুবেদের ব্রাহ্মণের নাম তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ এবং শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম শতপথ ব্রাহ্মণ। বাহ্মণের আলোচ্য বিষয় ৬টি যথা ১) বিধি, ২) অর্থবাদ, ৩) নিন্দা, ৪) প্রশংসা, ৫) পুরাকল্প এবং ৬) পরকৃতি। বিধিতে রয়েছে যজ্ঞের নিয়মাবলী বা বিধি-বিধান আলোচনা। অর্থবাদে বিভিন্ন ক্রিয়াকাণ্ডের ব্যাখ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতির বর্ণনা করা হয়েছে। নিন্দা অংশে রয়েছে কোন বিষয়ে দোষ ধরে এবং যুক্তি খণ্ডন করে সেটাকে পরিহার করার বিধান। প্রশংসা অংশে বিভিন্ন যজ্ঞের প্রশংসা করা হয়েছে। পুরাকল্পে আলোচিত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত বিভিন্ন যজ্ঞের ইতিহাস ও মাহাত্ম্য। এবং পরকৃতি অংশে পুরোহিতগণের কীর্তি, বিভিন্ন রাজা-মহারাজার যজ্ঞ, দান-দক্ষিণার কথা বর্ণিত হয়েছে।

আরণ্যক

   বেদের উপসংহার ভাগ ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণের উপসংহার ভাগ আরণ্যক। যা অরণ্যে বসে রচিত, তাই আরণ্যক। অরণ্যে বসে গুরু কতৃর্ক শিষ্যরা যে জ্ঞান লাভ করত তার লিপিবন্ধ রূপই আরণ্যক। আরণ্যকের সাথে উপনিষদের গভীর মিল রয়েছে। ঋগ্বেদে ঐতরেয় ও কৌষীতকি নামে দুটি আরণ্যক রয়েছে। সামবেদে ছান্দোগ্য নামক এক আরণ্যক রয়েছে। শুক্ল ও কৃষ্ণ যজুর্বেদে যথাক্রমে বৃহদারণ্যক ও তৈত্তিরীয় নামক আরণ্যক রয়েছে। আরণ্যকে মূলত সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ব্রহ্ম, আধ্যাত্মবিদ্যা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

বেদাঙ্গ

   বেদাঙ্গ হল বেদের অঙ্গ বা অবয়ব যা বেদ অধ্যয়নে সাহায্য করে। ৬টি বেদাঙ্গ রয়েছে, যথা শিক্ষা, কল্প, ব্যকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। শিক্ষায় উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত প্রভৃতি স্বর, মাত্রা, বর্ণ, পাঠের প্রকারভেদ ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে যা সূক্তগুলোকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে সাহায্য করে। কল্পে ব্রাহ্মণের সারতত্ত্ব সূত্রাকারে বর্ণিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন যজ্ঞ ও সংঙ্কার সম্পর্কে বর্ণনা আছে। কল্পের ৪টি শ্রেণী আছে, যথা শ্রৌতসূত্র, গৃহাসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্কসূত্র। সঠিকভাবে বেদ অধ্যয়নের জন্য ব্যাকরণ একান্ত আবশ্যক। ব্যাকরণ অংশে আলোচিত হয়েছে বর্ণ, সন্ধি, সমাস, প্রকৃতি, প্রত্যয়, লিঙ্গ, বচন ইত্যাদি। নিরুক্ততে বিভিন্ন বৈদিক শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। সংক্ষেপে একে অভিধানও বলা চলে। বেদের রস, গুণ, দোষ, উপলব্ধি এবং উচ্চারিত মন্ত্র হৃদয়াঙ্গম করার জন্য ছন্দ আবশ্যক। বৈদিক ছন্দ ৭টি যথা গায়ত্রী, উষ্ণীক, অনুষ্টুভ, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুভ ও জগতী। ঋগ্বেদে ত্রিষ্টুভ, জগতী, গায়ত্রী ও অনুষ্টুভ এই চারটি ছন্দই অধিক ব্যবহৃত হয়েছে। ত্রিষ্টুভে চার চরণ এবং প্রত্যেক চরণে অক্ষর সংখ্যা ১১, জগতীতেও চার চরণ কিন্তু প্রত্যেক চরণে অক্ষর সংখ্যা ১২, গায়ত্রীতে তিন চরণ এবং প্রত্যেক চরণে অক্ষর সংখ্যা ৮ এবং অনুষ্টুভে চার চরণ এবং প্রত্যেক চরণে অক্ষর সংখ্যা ৮। জ্যোতিষ নামক বেদাঙ্গে সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, গতি ও স্থিতি সংক্রান্ত জ্ঞান রয়েছে। মাস, বার, পক্ষ, তিথি, ঋতু ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আছে। বৈদিক যুগে জ্যোতিষ সংক্রান্ত জ্ঞানের দ্বারা যজ্ঞের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হত।

পাঠ-প্রণালী 

    বেদমন্ত্র উচ্চারণের জন্য এগার প্রকার পাঠ-প্রণালী আছে, যথা সংহিতা-পাঠ, পদ-পাঠ, ক্রম-পাঠ, জটা-পাঠ, মালা-পাঠ, শিখা-পাঠ, লেখা-পাঠ, ধ্বজা-পাঠ, দণ্ড-পাঠ, রথ-পাঠ এবং ঘন-পাঠ। সংহিতা-পাঠ প্রণালীতে মূল মন্ত্র যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। পদ-পাঠ প্রণালীতে প্রত্যেক পদের সন্ধি ভেঙ্গে এবং সমাসবদ্ধ পদের সমাস ভেঙ্গে একটি করে পড়া হয়। ক্রম-পাঠ প্রণালীতে প্রথমটি ছাড়া প্রত্যেক পদ পুনরায় পড়া হয়। জটা-পাঠ প্রণালীতে দুটি পদ প্রথমে যথাক্রমে পড়ে তারপর উল্টিয়ে পড়ে আবার ঠিকমত পড়া হয়। মালা-পাঠে ১ম ও ২য় পদ পাঠ করেই ৬ষ্ঠ ও ৫ম পদ পাঠ করতে হয়। তারপর ২য় পদ পাঠ কেও ৫ম ও ৪র্থ পদ পাঠ করতে হয়। লেখা পাঠে কখনও দুটি পদ কখনও তিনটি পদ একত্রে যথাক্রমে এবং বিপরীতক্রমে পাঠ করা হয়। শিখা-পাঠ অনেকটা জটা-পাঠের মত তবে জটা-পাঠে সব চরণেই দুইটি পদ এক একবারে উচ্চারিত হলেও শিখা-পাঠে মধ্যে মধ্যে অথবা ৩য়, ৬ষ্ঠ ও ৯ম চরণে ৩টি করে পদ একবারে উচ্চারণ করতে হয়। ধ্বজা-পাঠে প্রথমে ক্রম-পাঠের মত ছয়টি পদ উচ্চারণ করে তারপর বিপরীতক্রমে ঐ ছয়টি পদ পাঠ করতে হয়। দণ্ড-পাঠে ক্রম-পাঠের দুটি দুটি পদ যথাক্রমে তিন তিনবার উচ্চারিত হয় কিন্তু শুধুমাত্র দ্বিতীয়বার বিপরীত ক্রমে পাঠ করতে হয়। রথ-পাঠ মূলত ক্রম-পাঠের ধারা এবং তার বিপরীত ধারা মিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। ঘন-পাঠে প্রথম চারটি পদ দুটি দুটি করে ঠিক জটা পাঠের মত করে পাঠ করতে হয়। তারপর তিনটি করে পদ যথাক্রমে, বিপরীতক্রমে এবং বিপর্যস্তভাবে উচ্চারণ করতে হয়। এগারটি পাঠ-প্রণালীর মধ্যে সংহিতা-পাঠ, পদ-পাঠ, ক্রম-পাঠ ও জটা-পাঠ প্রণালী বেশী ব্যবহৃত হয়। নিচে সংহিতা, পদ, ক্রম ও জটাপাঠের উদাহরণ দেয়া হল

সংহিতা-পাঠ

 তৎ সবিতুর্ বরেণিয়ং ভর্গো দেবস্য ধীমহি।

                                                ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।।

পদ-পাঠ

তৎ। সবিতুঃ। বরেণ্যম্। ভর্গঃ। দেবস্য। ধীমহি।

                                             ধিয়ঃ। যোঃ। নঃ। প্রচোদয়াৎ।।

ক্রম-পাঠ

তৎ সবিতুঃ। সবিতুর্বরেণ্যং। বরেণ্যং ভর্গঃ।

                                               ভর্গো দেবস্য। দেবস্য ধীমহি। ধীমহিতি ধীমহি।

                                               ধিয়ো যঃ। যো নঃ। নঃ প্রচোদয়াদিতি প্রচোদয়াৎ ।।

জটা-পাঠ

তৎ সবিতুঃ। সবিতুঃ তৎ। তৎ সবিতুঃ।

                                                 সবিতুঃ বরেণ্যম্। বরেণ্যম্ সবিতুঃ। সবিতুঃ বরেণ্যম্।

                                                বরেণ্যম্ ভর্গঃ। ভর্গঃ বরেণ্যম্। বরেণ্যম্ ভর্গঃ।

                                                ভর্গঃ দেবস্য। দেবস্য ভর্গঃ। ভর্গঃ দেবস্য।

                                                দেবস্য ধীমহি। ধীমহি দেবস্য। দেবস্য ধীমহি।

                                                ধীমহি ধিয়ঃ। ধিয়ঃ ধীমহি। ধীমহি ধিয়ঃ।

                                                ধিয়ঃ যোঃ। যোঃ ধিয়ঃ। ধিয়ঃ যোঃ।

                                                যোঃ নঃ। নঃ যোঃ। যোঃ নঃ।

                                                নঃ প্রচোদয়াৎ। প্রচোদয়াৎ নঃ। নঃ প্রচোদয়াৎ।।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন