তন্ত্র শাস্ত্র
একদিন কৈলাসে পার্বতী ভগবান শিবের নিকট কলির মায়াবদ্ধ জীবের উদ্ধারের উপায় জানতে চান। এর উত্তরে ভগবান শিব যে তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন তাই তন্ত্র শাস্ত্র নামে খ্যাত। তন্ত্র শাস্ত্রকে গুহ্যবিদ্যাও বলা হয়। কারণ দীক্ষিত ও অভিজ্ঞ শিষ্য ছাড়া অন্য কারো নিকট এই বিদ্যা গুরুরা প্রকাশ করেন না। শাক্ত ও শৈবদের নিকট তন্দ্র-শাস্ত্র অতি আদরণীয়। আগম-তত্ত্ব বিলাসে ৬৪খানি তন্ত্র শাস্ত্রের নাম উল্লেখ আছে। তার মধ্যে কিছু প্রসিদ্ধ তন্ত্র শাস্ত্র হল— কুলার্ণব তন্ত্র, তন্ত্রসার, মহানির্বাণ তন্ত্র, তন্ত্রকৌমুদী, তারা রহস্য, কামাখ্যা তন্ত্র, আগমসার, আগমচন্দ্রিকা, যোগ-ডামর, শিব-ডামর, দুর্গা-ডামর, ব্রহ্ম-ডামর, আদি-যামল, ব্রহ্ম-যামল, বিষ্ণু-যামল, রুদ্র-যামল, গৌতমী, আদ্য, সরস্বতী, যোগিনী তন্ত্র প্রভৃতি।
তন্ত্র-সাধনা
তন্ত্র শাস্ত্রে পঞ্চ ম-কার সাধনা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। পঞ্চ ম-কার বলতে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন বোঝায়। তন্ত্রে এই পঞ্চ ম-কার ভক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই পঞ্চ ম-কারের একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক তাৎপর্য রয়েছে। মদ্য অর্থ সুরা নয়। তন্ত্র-শাস্ত্রে মদ্য অর্থ ব্রহ্মানন্দ। সাধকের ব্রহ্মরন্ধ্র হতে এক ধরণের সোমরস নির্গত হলে সাধক অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করে। তন্ত্র শাস্ত্রে ঐ সোমরসকেই মদ্য বলে। মাংস বলতে পশুপাখির মাংস বোঝায় না। তন্ত্র শাস্ত্রে মাংস অর্থ বাক্য। আর মাংস ভক্ষণ অর্থ বাক্য ভক্ষণ অর্থাৎ বাক্-সংযম করা। আগমসারে আছে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সর্বদা চলাচল করছে। ঈড়া-পিঙ্গলা নামক স্নায়ুই সে গঙ্গা-যমুনা আর শ্বাস-প্রশ্বাসই সে মৎস্য স্বরূপ। শ্বাস-প্রশ্বাস রূপ মৎস্য ভক্ষণ করার অর্থ শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে প্রণায়াম করা। চতুর্থ মকার মুদ্রা অর্থ অষ্টপাশ অর্থাৎ— আশা, তৃষ্ণা, গ্লানি, ভয়, ঘৃণা, মান, লজ্জা ও ক্রোধ এবং এদের জয় করাই মুদ্রা সাধন। পঞ্চম ম-কার মৈথুন অর্থ কোন নারী-পুরুষের মিলন নয়। তন্ত্র শাস্ত্রে মৈথুন বলতে বোঝায় ব্রহ্মরন্ধে্র অবস্থিত সহস্রার চক্রের বিন্দুর সাথে কুল-কুণ্ডলিনী শক্তির মিলন। তন্ত্র-শাস্ত্রে পাঁচ প্রকার বাণের কথা আছে, যথা— মারণ, উচাটন, মোহন, স্তম্ভন ও বশীকরণ। তন্ত্রশাস্ত্র এই পঞ্চবাণ প্রয়োগ করে জীবকে অনিষ্ট করতে বলেনি বরং নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পঞ্চবাণ প্রয়োগ করতে বলেছে। তাই পঞ্চবাণের গুঢ় তাৎপর্য জানা একান্ত আবশ্যক। স্থুল অর্থে মারণ বলতে বধ করা বোঝায়। কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্র কোন জীবকে বধ করতে বলেনি, নিজের আমিত্ব বা অহংকারকে বধ করতে বলেছে। উচাটন অর্থ ঊর্ধদিকে টেনে নেয়া। কুলকুণ্ডলিনী-শক্তিকে ঊর্ধদিকে টেনে নেওয়াই তন্ত্র-সাধকের মূল লক্ষ্য। বৈষায়িক কোন বস্তুতে মুগ্ধ না হয়ে আরাধ্য দেবতার রূপে মুগ্ধ হওয়াই সাধকের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। মোহন অর্থ আকর্ষণ করা। বাহ্য কোন বস্তুতে আকর্ষিত না হয়ে ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করাই শ্রেয়। স্তম্ভন অর্থ অচল হয়ে যাওয়া। মনকে ইষ্ট দেবতায় স্তম্ভন করলে মন আর বিষয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে না। বশীকরণ অর্থ বশ করা। তন্ত্র-শাস্ত্র কোন রমণীকে বশ করতে বলেনি, বলেছে রিপুকে বশ করতে। এভাবে তন্ত্রের বিভিন্ন স্থুল ভাব বর্জন করে সূক্ষ্ম ভাব গ্রহণ করাই সাধকের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন