7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

রামায়ণ কাহিনী

রামায়ণ কাহিনী

    মহর্ষি বাল্মীকি রামায়ণ কাহিনী রচনা করেন। কথিত আছে যে, মহর্ষি বাল্মীকি রামের জন্মের ষাটহাজার বৎসর পূর্বে রামায়ণ রচনা করেন। রামায়ণে প্রথমে ছয়টি কাণ্ডে চব্বিশ হাজার শ্লোক ছিল। পরবর্তিতে বাল্মীকি উত্তর-কাণ্ড রচনা করার কারণে রামায়ণে কাণ্ড সংখ্যা হয় সাতটি, যথা আদি, অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দর, লঙ্কা ও উত্তর কাণ্ড। রামায়ণে রামের প্রিতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম এবং সত্যপরায়ণতা আজও সকলের শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়। দেবী সীতা তাঁর সতীত্ব ও পতিভক্তির জন্য সকল হিন্দুনারীর নিকট আদর্শনীয়া ও পাতঃস্মরণীয়া হয়ে আছেন। দর্শন বিচারে রাম শুভ বিবেক আর রাবণ ভোগের প্রতীক। রাবণের দশ মাথা দশ ইন্দ্রিয়কে সূচিত করে। ঐ দশ ইন্দ্রিয় শুধু বিষয়-ভোগে নিয়োজিত থাকে। বিষয়-ভোগে উন্মত্ত ইন্দ্রিয় রূপ রাবণ যখন আনন্দময়ী শক্তি রূপ সীতাকে হরণ করে তখন বিবেক রূপ রাম রাবণকে বধ করে আনন্দময়ী সীতাকে উদ্ধার করেন। সুতরাং জ্ঞান বা বিবেকের দ্বারা ইন্দ্রয়কে দমন করলে দেহে আনন্দময়ী সত্তা জাগ্রত হয় এটাই রামায়ণের মূল-বস্তু। রামায়ণে রাম ১৫ বছর বয়সে মিথিলার রাজা জনকের কন্যা সীতা দেবীকে বিবাহ করেন। ১২ বছর অযোধ্যায় বসবাসের পর ২৭ বৎসর বয়সের সময় রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য অষ্টাদশবর্ষীয়া সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে ১৪ বৎসরের জন্য বনবাসে যান। বনবাসের ১৩ বছর শেষে মাঘ মাসের কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে রাবণ সীতাকে হরণ করে। পরের বছর মাঘ মাসের দ্বিতীয়াতে রাম ও রাবণের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ৮৭ দিন পর কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে রাবণকে বধ করে রাম সীতা দেবীকে উদ্ধার করেন। এখন রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনী আলোচনা করা যাক।

রামায়ণ

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১। সূচনা।

    ত্রেতাযুগে অযোধ্যায় দশরথ নামে এক বেদজ্ঞ, দূরদর্শী, সত্যবাদী ও প্রজাপ্রিয় রাজা ছিলেন। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা নামে রাজা দশরথের তিন রাণী ছিল। অনেক দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও তাঁর কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি সন্তান কামনায় অশ্বমেদ যজ্ঞের আয়োজন করেন। ঋষ্যশৃঙ্গ নামক এক মুনি যজ্ঞের পৌরহিত্য করেন। এই সময়ে দেবতারা রাবণ নামক এক পুলস্ত্য-বংশীয় রাক্ষসের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে ব্রহ্মার শরণাগত হন। রাবণ ব্রহ্মার নিকট বর পেয়েছিলেন যে, কোন দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসের হাতে তার মুত্যু নেই কিন্তু মানুষ তাঁকে বধ করতে পারবে। তাই ব্রহ্মার অনুরোধে দেবতারা বিষ্ণুর নিকট প্রার্থনা করেন যে, তিনি যেন মনুষ্য রূপে পৃথিবীতে অবর্তীণ হয়ে রাবণকে বধ করেন। দেবতাদের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু দশরথের তিন রাণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করতে সম্মত হন। যা হোক, যজ্ঞের সময় দশরথের ঐ যজ্ঞের অগ্নি থেকে পায়সে পরিপূর্ণ পাত্র হস্তে এক প্রজাপতি প্রেরিত পুরুষ উঠে আসলেন এবং দশরথকে বললেন, “মহারাজ, এই দেবনির্মিত সন্তানদায়ক পায়স আপনার পত্নীদের খেতে দিন”। তারপর দশরথ ঐ পায়সের অর্ধাংশ কৌশল্যাকে, অবশিষ্ট অর্ধেকের অধাংশ সুমিত্রাকে এবং অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধাংশ সুমিত্রাকে খেতে দিলেন অর্থাৎ ১৬ ভাগের ৮ ভাগ কৌশল্যাকে, ৪ ভাগ কৈকেয়ীকে এবং ২ ভাগ সুমিত্রাকে খেতে দিলেন। যজ্ঞের দ্বাদশ মাস পরে চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে বড় রাণী কৌশল্যার গর্ভে রামের, পুষ্যা নক্ষত্রে মেঝ রাণী কৈকেয়ীর গর্ভে ভরতের এবং অশ্লেষা নক্ষত্রে ছোট রাণী সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের জন্ম হয়। জন্মের সময় আকাশ থেকে দেবগণ পুষ্প বৃষ্টি করলেন। জন্মের এগার দিন পর কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ দশরথের চার পুত্রের  নামকরণ করেন। বাল্যকাল থেকে রাম ও লক্ষ্মণের মধ্যে এবং ভরত ও শত্রুঘ্নের মধ্যে প্রগাঢ় স্নেহ-সম্বন্ধ ছিল। রাজা দশরথ চারপুত্রের মধ্যে রামকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-২। তাড়কা ও বিভিন্ন রাক্ষস বধ।

    পুত্রদের বয়স ষোল বৎসরও হয়নি, এমন সময় বিশ্বামিত্র মুনি দশরথের নিকট উপস্থিত হলেন। মহামুনি জানালেন যে, তিনি এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন কিন্তু মারীচ ও সুবাহু নামক দুই মহাবলী রাক্ষস যজ্ঞবেদির উপর মাংস ও রক্ত বর্ষণ করছে। এরকম বিঘ্ন করার পরও তিনি রাক্ষসদ্বয়কে বিনাশ করতে পারছেন না, কারণ যজ্ঞকালে শাপ দেয়া অনুচিত বলে তিনি ক্রোধ সংবরণ করেছেন। তাই তিনি ঐ রাক্ষসদ্বয়কে বধ করার জন্য জ্যেষ্ঠপুত্র রামকে দশ রাত্রির জন্য নিয়ে যেতে চান। রাম দশরথের প্রাণাধিক প্রিয়। তাই তিনি প্রথমে রামকে বিশ্বামিত্রের সাথে যেতে দিতে চাননি কিন্তু তাতে বিশ্বামিত্র ক্রোধান্বিত হন। অগত্যা দশরথ রামকে যেতে দিতে সম্মত হন। তারপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে অযোধ্যা ত্যাগ করেন।

   মলদ ও করুষ নামক স্থানে তাড়কা নামক এক যক্ষীর দৌরাত্ম্য ছিল। তাড়কা সুকেতু নামক এক যক্ষের কন্যা এবং জম্ভপুত্র সুন্দের পত্নী। তাড়কা ও তার পুত্র মারীচ অগস্ত্য মুনিকে ভক্ষণ করতে গেলে মুনির শাপে তাড়কা ও মারীচ রাক্ষসে পরিণত হয়। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে রাম রাক্ষসী তাড়কাকে তীরবিদ্ধ করে বধ করেন। তারপর বিশ্বামিত্র মুনি ধ্যানযোগে প্রাপ্ত দণ্ডচক্র, বিষ্ণুচক্র, বজ্র, শৈবশূল, বারুণ পাশ, বায়ব্যাস্ত্র, বষর্ণাস্ত্র, শোষণাস্ত্র প্রভৃতি দিব্যাস্ত্র রামকে দান করেন। ষষ্ঠ দিনে বিশ্বমিত্র যজ্ঞবেদি প্রজ্জ্ব¡লিত করেন। তখন মারীচ ও সুবাহু যজ্ঞে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে রাম শরাসনে মানবাস্ত্র যোজনা করে মারীচকে, আগ্নেয়াস্ত্রে সুবাহুকে এবং বায়ব্যাস্ত্রে অন্যান্য রাক্ষসদের বধ করেন। পরের দিন প্রভাতে বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে মিথিলা রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৩। রাম ও সীতার বিবাহ।

    মিথিলা যাওয়ার পথে গৌতম মুনির আশমে রামের পাদস্পর্শে পাষাণরূপিণী অহল্যা শাপমুক্ত হয়ে মানবী রূপ ধারণ করেন। এই অহল্যা ছিলেন গৌতম মুনির পত্নী। গৌতমের অনুপস্থিতিতে ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশে অহল্যার নিকট এসে তাঁর সতীত্ব হরণ করেছিলেন। গৌতম ফিরে এসে এ ঘটনা বুঝতে পেরে ইন্দ্র ও অহল্যাকে শাপ দিয়েছিলেন। গৌতমের ঐ শাপে ইন্দ্র নপুংসক এবং অহল্যা পাষাণে পরিণত হয়েছিলেন। তবে গৌতম পরে একথাও বলেছিলেন যে, দশরথপুত্র রাম যেদিন এ আশ্রমে আসবেন সেদিন অহল্যার শাপ-মোচন হবে এবং তাঁকে লাভ করবে। গৌতমের ঐ বাক্য অনুসারে রামের স্পর্শে অহল্যা শাপমুক্ত হয়ে গৌতমের কাছে চলে গেলেন এবং বিশ্বামিত্র ও রাম-লক্ষ্মণ মিথিলার জনকের কন্যা সীতার সয়ংবর সভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

    জনক সম্পর্কে কিছু কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন। জনক কিন্তু কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। জনক মূলত মিথিলার রাজাদের উপাধি। সীতার পিতার প্রকৃত নাম সীরধ্বজ। এবার জনকের বংশ পরিচয় সম্পর্কে আসা যাক। ধর্মাত্মা নিমির পুত্রের নাম মিথি এবং মিথির পুত্রের নাম জনক। তিনিই মিথিলার প্রথম জনক (রাজা)। তাঁর তিন পুরুষ পরে দেবরাত এবং দেবরাতের চৌদ্দপুরুষ পরে  হ্রস্বরোম। হ্রস্বরোমের দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ সীরধ্বজ (জনক) এবং কনিষ্ঠ কুশধ্বজ। যা হোক, সীতা কিন্তু জনকের ঔরসজাত নয় অর্থাৎ সীতা অযোনিজা (যোনিভেদ করে যার জন্ম নয়)। ধর্মাত্মা ও বৈদেহী জনক জমি চাষ করার সময় হলরেখা থেকে এক কন্যা উঠে এসেছিল। জনক সে কন্যাকে নিজ কন্যার মত লালন-পালন করেছিলেন। লাঙ্গল দ্বারা জমি চাষের ফলে জমিতে যে হলরেখা সৃষ্টি হয় তাকে সীতা বলে। সীতা (হলরেখা) থেকে ঐ কন্যাকে পেয়েছেন বলে ঐ কন্যার নাম রেখেছেন সীতা। জনক ঠিক করলেন যে, এই অযোনিজা কন্যা বীর্যশুল্কা (বীরত্ব প্রকাশ রূপ পণ দিয়ে নিতে হয় এমন নারী) হবেন। সে জন্য তিনি স্থির করলেন যে, যিনি তাঁর নিকট রক্ষিত মহাদেবের ধনু ভঙ্গ করতে পারবেন, তিনিই সীতাকে বিবাহ করার যোগ্য হবেন। কত রাজা-মহারাজা যক্ষ-রক্ষ, দেবতা, অসুর সে হরধনু ভঙ্গের চেষ্টা করেছিল কিন্তু কেউ ঐ হরধনু ভঙ্গ করতে পারল না। তখন বিশ্বমিত্রের নির্দেশে রাম সেই ধনুক অবলীলায় তুলে নিয়ে ভঙ্গ করলেন। সে সময় বজ্রপাৎতুল্য শব্দে স্বর্গ-মর্ত্য কম্পিত হল। জনক তাঁর কন্যা সীতাকে রামের মত বীরের হস্তে সমর্পণ করতে পারবে ভেবে আনন্দিত হলেন। পরের দিন রাজা দশরথ জনকের দূতগণের নিকট এই খবর পেয়ে মিথিলায় উপস্থিত হলেন। দশরথের সাথে তাঁর মন্ত্রীবর্গ, বশিষ্ট প্রভৃতি ঋষিগণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন মিথিলায় আসলেন।

    বশিষ্ট মুনির ইচ্ছায় জনক জ্যেষ্ঠা কন্যা সীতাকে রামের হস্তে এবং কনিষ্ঠা কন্যা ঊর্মিলাকে লক্ষ্মণের হস্তে সমর্পণ করতে সম্মত হলেন। পরে বিশ্বামিত্র মুনির ইচ্ছায় জনক তাঁর ভ্রাতা কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবীকে ভরতের সাথে এবং শ্রুতকীর্তিকে শত্রুঘ্নের সাথে বিবাহ দিতে সম্মত হলেন। মহা-আড়ম্বরে চার ভ্রাতার বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর দশরথ তাঁর পুত্র ও পুত্রবধুগণ সহ আযোধ্যার দিকে যাত্রা করলেন। পথে হঠাৎ পরশুরাম সবার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। পরশুরাম রামকে বললেন, “আমি তোমার বীরত্ব আর হরধনু ভঙ্গের কথা শুনেছি। আমি আর এক ধনু এনেছি, তুমি এতে শর যোজনা করে নিজের বল দেখাও”। রাম পরশুরামের নির্দেশমত ধনুতে শর যোজনা করলেন। তখন পরশুরামের দেহ থেকে তেজোরশ্মি রামের দেহে প্রবেশ করল। পরশুরাম বুঝতে পারলেন যে, এই দশরথপুত্র রামই বিষ্ণুর অবতার এবং পরে তিনি রামকে প্রদক্ষিণ করে মহেন্দ্র পর্বতে তপস্যায় চলে গেলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৪। রামের বনে গমন।

    বিবাহের পর সকলে অযোধ্যায় ফিরে এলে রাজমাতাগণ পুত্র ও পুত্রবধুদের বরণ করে নিলেন। কয়েকদিন পর ভরত ও শত্রুঘ্ন মামা বাড়ি গেলেন এবং রাম ও লক্ষ্মণ পত্নীসহ সুখে বাস করতে লাগলেন। রাজা দশরথ রামকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং সে উপলক্ষে অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। তখন কৈকেয়ীর পিত্রালয় থেকে আগত মন্থরা নামক এক কুব্জা দাসী কৈকেয়ীকে মন্ত্রণা দিলেন যে, দশরথ রামকে অভিষিক্ত করলে কৈকেয়ীর গর্ভজাত ভরত কখনই রাজা হতে পারবে না বরং সে রামের দাস হয়ে থাকবে। মন্থরার এই রকম কুবুদ্ধিতে বশিভূত হয়ে কৈকেয়ী রাজা দশরথের নিকট দুইটি বর চাইলেন। রামের পরিবর্তে ভরতের অভিষেক হোক এটা ছিল তাঁর প্রথম বর এবং রাম মৃগচর্ম পরিধান করে তপস্বী হয়ে চৌদ্দ বৎসর দণ্ডকারণ্যে বাস করুক এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় বর। এই বর প্রার্থনার একটা ইতিহাস আছে। একবার দেবাসুরের যুদ্ধে কৈকেয়ী তাঁর রণ-কৌশল আর বুদ্ধিমত্তার দ্বারা দশরথের প্রাণরক্ষা করেছিলেন। দশরথ তখন খুশি হয়ে কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। কৈকেয়ী সে বর তখন চাননি। তাই এখন স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে ঐ বর চাইলেন। রাজা দশরথ কৈকেয়ীর ঐ কথা শুনে মুছির্ত হলেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর তিনি কৈকেয়ীকে শত বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। অবশেষে তিনি কৈকেয়ীর শর্ত মেনে নিয়ে রামকে কাছে ডাকলেন। কৈকেয়ী তাঁর বরের কথা রামকে খুলে বললে রাম অকপটে সব শর্ত মেনে নিলেন এবং শীঘ্রই বনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন।

    রামের বনে যাওয়ার কথা শুনে দশরথ মুর্ছিত হয়ে পড়লেন। রামের মুখে সবকথা শুনে লক্ষ্মণ ক্রোধান্বিত হন এবং রামকে জোড়পূর্বক রাজ্য অধিকার করতে বলেন। কিন্তু পিতৃভক্ত রাম পিতা দশরথের আদেশ অমান্য করে রাজ্য অধিকার করে সুখভোগ করার চেয়ে বনে গমন শ্রেয় মনে করলেন। রাম সীতাকে মাতা কৌশল্যা ও পিতা দশরথের সেবার জন্য রেখে বনে যেতে চাইলেন। কিন্তু পতিব্রতা সীতা পতি রামকে ছেড়ে থাকতে অসম্মত হলেন এবং তিনিও রামের সাথে বনে গমন করতে চাইলেন। রাম তাঁকে বোঝালেন যে, বনে বাস করা অনেক বিপদজনক এবং তাঁর মত কোমলমতী নারীর পক্ষে তা অসম্ভব। কিন্তু পতিব্রতা সীতার নিকট পতিকে ছাড়া সংসারে সুখভোগের চেয়ে পতির সাথে বনে গিয়ে দুঃখেভোগই শ্রেয়। তাই সীতার সঙ্কল্পের কাছে নত হয়ে রাম সীতাকে বনে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। শুধু সীতা নয় লক্ষ্মণও রামের সাথে বনে যাওয়ার সঙ্কল্প করলেন।

    বনে যাওয়ার পূর্বে রাম পিতা দশরথের কক্ষে গেলেন। দশরথ রামকে বনে যেতে নিষেধ করেন এবং তাঁকে বন্দি করে রাজ্য অধিকার করার কথা বলেন। জোরপূর্বক রাজ্য অধিকার করা ক্ষাত্রধর্মের বিরোধী নয়। কিন্তু রাম যদি জোরপূর্বক রাজ্য অধিকার করেন, তবে কৈকেয়ীকে দেয়া দশরথের বর নিষ্ফল হবে। বর নিষ্ফল হলে দশরথের মান ও ধর্ম দুটোই নষ্ট হবে। তাই রাম পিতা দশরথের মঙ্গলের কথা ভেবে বনে গমনের সিদ্ধান্ত নিলেন। বনে গমনের পূর্বে রাম ব্রাহ্মণগণকে এবং মন্ত্রী চিত্ররথকে ধেনু, ধন-রত্ন, বস্ত্র, যান ও দাসী দান করলেন। রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ, পিতা, মাতা ও বিমাতাদের প্রণাম করে রথে আরোহনপূর্বক বনের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। সুমন্ত হলেন তাঁদের রথের সারথী। বহু অযোধ্যাবাসীরা তাঁর রথের পিছনে পিছনে তমসা নদীর তীর পর্যন্ত গেলেন। সেখানে সবাই একরাত্র কাটানোর পর রাম সকলের নিদ্রাভঙ্গের পূর্বেই সে স্থান হতে বনের দিকে দ্রুত গমন করলেন। অযোধ্যাবাসীগণ নিদ্রাভঙ্গের পর রামকে না দেখতে পেয়ে বিলাপ করতে করতে অযোধ্যায় ফিরে এলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৫। রাম ও সীতার বনবাস।

    রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ রথে আরোহন করে গঙ্গার তীরবর্তী প্রদেশে এসে নিষাদ রাজার আতিথ্য গ্রহণ করলেন। পর দিন তাঁরা গঙ্গা পার হয়ে বৎসদেশে আশ্রয় নিলেন এবং সুমন্ত শোকাতুর চিত্তে অযোধ্যায় ফিরে এলেন। বৎসদেশে রাত্রিযাপন শেষে তাঁরা গঙ্গা ও যমুনার সংযোগ স্থলে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে গেলেন। পরদিন তাঁরা মুনির কথামত দশ ক্রোশ দূরে অবস্থিত বহু মুনি-ঋষির তপস্যা স্থল চিত্রকূট পবর্তের নিকট গমন করলেন। চিত্রকূট পর্বতের পাদদেশে যে বন আছে, ঐ বনে বাল্মীকি মুনির আশ্রম রয়েছে। রাম-সীতা ও লক্ষ্মণ ঐ আশ্রমের নিকট গৃহ নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন।

    সুমন্তের মুখে রামের বনগমনের কথা শুনে দশরথ আরও শোকাতুর হয়ে পড়লেন। রামের বনযাত্রার ষষ্ঠ রাত্রির মধ্যভাগে দশরথের একটি পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল। তিনি কৌশল্যাকে অতীতের এক দুষ্কৃতির কথা শোনালেন। তিনি বিবাহের পূর্বে যুবরাজ থাকাকালে বর্ষার সময় সরযু নদীর তীরে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। অন্ধকারে যখন সরযুর জল অদৃশ্য হয়ে গেল তখন কলসে জল ভরার শব্দ শুনে দশরথ মন করলেন কোন হস্তী হয়তো জলপান করছে। তিনি ঐ শব্দ লক্ষ্য করে শব্দভেদী শর নিক্ষেপ করলেন। কিছুক্ষণ পর এক মানুষের আর্তনাদ ও ক্রদন শোনা গেল। দশরথ নিকটে গিয়ে দেখেন তিনি যাকে বধ করেছেন, তা কোন হস্তী নয়, এক মুনিকুমার। মুনিকুমার অন্ধ পিতামাতার জন্য জল নিতে এসেছিলেন। দশরথ মুনিকুমারের অনুরোধে তাঁর পিতা অন্ধুমনির নিকট গিয়ে সব খুলে বললেন। অন্ধমুনি ও তাঁর পত্নী পুত্রের মৃত্যুর কথা শুনে শোকে কাতর হলেন এবং কুপিত হয়ে দশরথকে অভিশাপ দিলেন যে, তাঁকেও একদিন পুত্রশোকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। দশরথ এই ইতিহাস শেষ করে নিজের কৃতকর্মে ভাবতে ভাবতে আর রামের শোকে বিলাপ করতে করতে অর্ধরাত্রের পর প্রাণত্যাগ করলেন। ভরত ঐ রাতে এক দুঃস্বপ্ন দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে মাতুল বাড়ি থেকে শত্রুঘ্নকে নিয়ে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে রওনা হন। অযোধ্যায় এসে তিনি রামচন্দ্রের বনগমন ও পিতার মৃত্যুর কথা শুনতে পান। ভরত ও শত্রুঘ্ন পিতার মৃত্যুশোকে কাতর হলেন এবং মন্থরা ও কৈকেয়ীকে তাদের পাপকর্মের জন্য তিরস্কার করেন।

    ভরত অযোধ্যার সিংহাসন প্রত্যাখ্যান করে জ্যেষ্ঠ রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য মাতাগণকে সঙ্গে নিয়ে বনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভরত রামের নিকট উপস্থিত হয়ে পিতার মৃত্যু সংবাদ শোনালেন। ঐ দুঃসংবাদ শুনে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ শোকে ক্রন্দন করতে থাকলেন। ভরত রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে অযোধ্যার রাজা করতে চাইলেন এবং নিজে চৌদ্দ বৎসর বনে বাস করতে চাইলেন। কিন্তু রাম পিতৃসত্য পালনে দৃঢ়-প্রতীজ্ঞ। তাই তিনি ভরতের প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে তাঁকে অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে রাজ্য পরিচালনা করার নির্দেশ দেন। অগত্যা ভরত জ্যেষ্ঠ রামের নির্দেশ পালন করার জন্য অযোধ্যায় ফিরে আসেন। পরের দিন রাম চিত্রকূট ত্যাগ করে অত্রি মুনির আশ্রমে গেলেন। অত্রির পত্নী অনসূয়া সীতার আচারনিষ্ঠা ও পতিভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে বস্ত্র অলঙ্কার, গন্ধ, অনুলেপন প্রভৃতি উপহার দিলেন। অত্রি মুনির আশ্রমে এক রাত্র যাপন করে তাঁরা দণ্ডকারণ্যে গেলেন। সেখানে বিরাধ নামক এক রাক্ষস রাম-লক্ষ্মণকে বধ করে সীতাকে পত্নী রূপে গ্রহণ করতে চাইল। তখন রাম-লক্ষ্মণ বিরাধকে বধ করেন। অন্তিমকালে বিরাধ তাঁদের জানাল যে, সে পূর্বে তুম্বুরু নামক এক গন্ধর্ব ছিল। কুবেরের শাপে তাকে রাক্ষস হতে হয়েছে এবং রামের পদস্পর্শে তার শাপমোচন হয়েছে। পরে রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা বিরাধের অনুরোধে শরভঙ্গ ঋষির আশ্রমে গেলেন। শরভঙ্গ তপোবলে ব্রহ্মলোকে গমনের অধিকার করেছেন। ইন্দ্র তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলেন। কিন্তু শরভঙ্গ রামের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রাম এলে রামের সাথে সাক্ষাৎ করার পর তিনি দেহ ত্যাগ করে ব্রহ্মলোক গমন করেন। শরভঙ্গ দেহত্যাগ করার পূর্বে রাম তাঁর নিকট বসবাসের উপযোগী স্থানের কথা জেনে নিলেন। তারপর শরভঙ্গের কথামত তাঁরা মন্দাকিনী নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে সুতীক্ষ্ণের ঋষির আশ্রমে গেলেন। রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা সুতীক্ষ্ণের আশ্রমে এক রাত্র যাপন করার পর বিভিন্ন মুনি-ঋষিদের আশ্রম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

    রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা ভ্রমণকালে সবার আগে থাকতেন রাম মধ্যে সীতা এবং সবার পিছনে থাকতেন লক্ষ্মণ। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ নানা আশ্রমে ভ্রমণ করতে করতে যখন দশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, তখন তাঁরা পুনরায় সুতীক্ষ্ণের আশ্রমে ফিরে এলেন। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ সুতীক্ষ্ণের মুনির নিকট অগস্ত্যের মহীমার কথা শুনলেন। বিন্ধ্য নামক পর্বত সুর্যের গতিপথ রোধ করার জন্য বর্ধিত হচ্ছিল। ফলে প্রজারা সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। তখন অগস্ত্য প্রজাদের মঙ্গলের জন্য বিন্ধ্যপর্বত ডিঙ্গিয়ে চলে পাওয়ায় সময় পর্বতকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যতক্ষণ না ফিরে আসবেন ততক্ষণ যেন সে বর্ধিত না হয়। অগস্ত্য ঐ স্থানে আর ফিরে আসেনি, তাই অগস্তের অনুগত বিন্ধ্যপর্বতও আর বর্ধিত হতে পারেনি। এছাড়াও অগস্ত্য ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই অসুরকে বধ করেছিলেন। অগস্ত্যের কথা শোনার পর রাম-সীতা-লক্ষ্মণ সুতীক্ষ্ণের নিকট হতে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে রওনা হলেন। অগস্ত্য মুনির সাথে সাক্ষাৎ শেষে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী পঞ্চবটী নামক বনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পঞ্চবটীতে প্রবেশকালে তাঁরা জটায়ু নামক বিরাটাকার পক্ষীর দর্শন পেলেন। জটায়ুর বংশপরিচয় এরকম কশ্যপের ঔরসে দক্ষ কন্যা দনুর গর্ভে শুকীর জন্ম। শুকীর গর্ভে নতা এবং নতার গর্ভে বিনতার জন্ম। বিনতার গর্ভে গরুড় ও অরুণ জন্মগ্রহণ করেন। অরুণের জ্যেষ্ঠপুত্র সম্পাতি এবং কনিষ্ঠ পুত্র জটায়ু। জটায়ু রাম-লক্ষ্মণ ও সীতাকে দেখে তাঁদের ভক্ত হয়ে গেলেন এবং তিনি বনে সীতাকে রক্ষার ভার নিলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৬। পঞ্চবটী বণে শূর্পণখার নাক কর্তণ।

    পঞ্চবটীতে লক্ষ্মণ মাটি, বাঁশ, শমীবৃক্ষের শাখা, কুশ-কাশপত্র প্রভৃতি দিয়ে এক পর্ণকুটির নির্মাণ করেন এবং তাঁরা সেখানে সুখে বাস করতে থাকেন। একদিন রাক্ষস রাবণের বোন শূর্পণখা তাঁদের কুটিরের নিকট এসে রামের রূপ দর্শনে মোহিত হলেন এবং রামকে পতিরূপে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। রাম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে শূর্পণখা লক্ষ্মণকে পতি রূপে গ্রহণ করতে চাইল। লক্ষ্মণও তাকে ফিরিয়ে দিলে সে সীতাকে ভক্ষণ করতে এগিয়ে যায়। লক্ষ্মণ তখন রামের নির্দেশে খড়গাঘাতে ঐ রাক্ষসীর নাক ও কান কেটে দিলেন। শূর্পণখা তার মাসতুত ভাই খর ও দূষণের নিকট গিয়ে রাম-লক্ষ্মণ কতৃর্ক তার অপমানিত হওয়ার কথা খুলে বলল। খর ও দূষণ বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে আসলে তারা রাম-লক্ষ্মণ কতৃর্ক নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে খর-দূষণের চৌদ্দ হাজার রাক্ষস সৈন্যও নিহত হয়। অকম্পন ও শূর্পণখা রাবণের নিকট রাক্ষস নিধনের সব ঘটনা খুলে বলে। রাবণ সব শুনে ক্রোধিত হয় রাম-লক্ষ্মণকে বধের প্রতীজ্ঞা করল। তখন অকম্পন জানাল যে, যুদ্ধ করে রাম-লক্ষ্মণকে পরাজিত করা যাবে না। রামের প্রাণাধিক প্রিয় ভার্যা সীতাকে হরণ করতে পারলে রাম-লক্ষ্মণ তাঁর দুঃখে দুর্বল হয়ে পড়বে আর তখন তাঁদের বধ করা সহজ হবে।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৭। রাবন কর্তৃক সীতা হরণ।

    রাবণ অকম্পনের পরামর্শমত রথে চেপে প্রথমে মারীচের আশ্রমে গিয়ে তাকে সব ঘটনা বলল। মারীচও রাম-লক্ষ্মণকে বধে ও সীতাকে হরণকার্যে রাবণকে সহয়তা করতে সম্মত হল। মায়াবী মারীচ একটি সোনার হরিণের রূপ ধরে পঞ্চবটী বনে গল। সীতা ঐ মায়ামৃগকে দেখে মোহিত হলেন এবং রামকে অনুরোধ করলেন ঐ সোনার হরিণ ধরে তাঁর কাছে নিয়ে আসার জন্য। রাম-লক্ষ্মণ সীতাকে বোঝালেন যে, ঐ হরিণ কোন রাক্ষসের মায়া হতে পারে এবং ঐ হরিণকে ধরতে গেলে কোন বিপদে পড়তে হতে পারে। কিন্তু সিতার সঙ্কল্পের নিকট হার মেনে রাম ঐ সোনার হরিণ ধরতে উদ্যত হলেন। রাম যতই হরিণের নিকটে যান, হরিণ ততই দূরে পালিয়ে যায়। এভাবে রাম হরিণের পিছে পিছে বহুদূর যাওয়ার পর এক বাণ নিক্ষেপ করেন। সেই বাণে ঐ হরিণ বিদ্ধ হয় এবং হরিণরূপী মারীচ নিজ রূপ ধারণ করে। মৃত্যুর পূর্বে মারীচ রামের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে “হা সীতা, হা লক্ষ্মণ” বলে চিৎকার করতে করতে মারা গেল। সীতা ঐ চিৎকার শুনে বুঝতে পারলেন যে, রাম হয়তো বড় বিপদে আছেন। তাই তিনি লক্ষ্মণকে নির্দেশ দেন রামকে সাহায্য করার জন্য। রাম অনুজ লক্ষ্মণকে সীতার সুরক্ষার জন্য রেখে গেছেন তাই তিনি রামের আদেশ উপেক্ষা করে সীতার কথায় যেতে সম্মত হলেন না। কিন্তু সীতার ভর্ৎসনায় লক্ষ্মণ যেতে বাধ্য হলেন। এই সুযোগে রাবণ পরিব্রাজক তপস্বীর রূপ ধরে সীতার নিকট এল। সীতা রাবণকে ব্রাহ্মণ মনে করে আসন, পাদ্য ও ভোজ্য দিয়ে সংবর্ধনা দিলেন। তারপর সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাবণ নিজ পরিচয় দিল এবং সীতাকে পত্নী রূপে কামনা করল। সীতা তখন রাবণকে দৃঢ়ভাবে ভর্ৎসনা করলে রাবণ নিজ রূপ ধারণ করে সীতাকে জোরপূর্বক রথে তুলে নিজ রাজ্য লঙ্কার অভিমুখে রওনা হল।

   সীতাকে রাবণ নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি এক বৃক্ষের উপর জটায়ুকে দেখে তাঁর শরণাপন্ন হন। জটায়ু সীতাকে রক্ষা করার জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধের পর রাবণ খড়গাঘাতে জটায়ুর পাখা, পা ও পার্শ্বদেশ ছিন্ন করলে জটায়ু ভূপাতিত হন। তখন সীতা নিরূপায় হয়ে তাঁর দেহের সব অলঙ্কার নিচে ফেলতে লাগলেন যাতে ঐ অলঙ্কার দেখে রাম-লক্ষ্মণ বুঝতে পারেন যে, তাঁকে কোন পথে হরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জনশূন্য অরণ্য প্রদেশের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সীতা একটি পর্বতশৃঙ্গে পাঁচটি বানর দেখলেন এবং রামকে সংবাদ দেবে এই আশায় তিনি তাঁর উত্তরীয় ও কিছু অলঙ্কার ফেলে দিলেন। তারপর সীতাকে রাবণ তার লঙ্কাপুরীর নিকট অশোক বনে নিয়ে যায় এবং কিছু রাক্ষসী নিযুক্ত করে সীতাকে সেবা করার ও বশে আনার জন্য।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৮। সীতা অন্বেষণ।

    রাম-লক্ষ্মণ ফিরে এসে কুটিরে সীতাকে দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারেন যে, কোন রাক্ষস হয়তো সীতাকে হরণ করেছে। তাঁরা সীতাকে খুজতে খুজতে এক স্থানে সীতার অলঙ্কার ও রাক্ষসের পদচিহ্ন দেখতে পান। কিছুদুর যেতে যেতে তাঁরা জটায়ুকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। রাম-লক্ষ্মণ জটায়ুর মুখে শুনতে পান যে, বিশ্রবার পুত্র রাবণ সীতাকে হরণ করে দক্ষিণ দিকে নিয়ে গেছে এবং তাঁর পাখা ও চরণ কেটে দেয়েছে। রাবণ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার পূর্বেই জটায়ুর মৃত্যু হয়। রাম-লক্ষণ জটায়ুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন। তাঁরা হাটতে হাটতে ক্রৌঞ্চ নামক অরণ্যে উপস্থিত হলেন। সেখানে অয়োমুখী নামক এক রাক্ষসী লক্ষ্মণকে পতি রূপে গ্রহণ করতে চাইলে লক্ষ্মণ কুপিত হয়ে তার নাক, কান ও স্তন কেটে দিলেন। বনের একটু গভীরে যেতেই কবন্ধ নামক এক বিরাটাকার রাক্ষস তাঁদের আক্রমন করল। রাম-লক্ষ্মণ কবন্ধের দুই বাহু কেটে দিলেন। তখন কবন্ধ জানাল যে, সে পূর্বে খুব রূপবান ছিল কিন্তু স্থুলশিরা ঋষির অভিশাপে কুৎসিত রাক্ষসে পরিণত হয়েছিল। রাম তাঁর বাহু ছেদন করায় তার শাপমুক্তি হল। রাম-লক্ষ্মণ কবন্ধের শেষকৃত্য করার পর সে পূর্বের রূপ ফিরে পেয়ে সে জানাল যে, সুগ্রীব নামক এক সত্যনিষ্ঠ, ধীর ও মহাবলশালী বানর সীতা অন্বেষণে সাহায্য করতে পারে। সুগ্রীব তাঁর ভ্রাতা ইদ্রপুত্র বালী কতৃর্ক বিতাড়িত হয়ে পম্পা সরবরের তীরবর্তী ঋষ্যমূক পর্বতে চার জন বানরের সঙ্গে বাস করছিলেন। কবন্ধের কথামত রাম-লক্ষ্মণ পম্পা সরোবরের নিকট গেলেন। পম্পার পশ্চিম তীরে মাতঙ্গ মুনির আশ্রম অবস্থিত। ঐ আশ্রমে কেবল শবরী নামক এক ধর্মশীলা সন্ন্যাসিনী থাকেন। রাম-লক্ষ্মণ সেখানে গেলে শবরী তাঁদের চরণ-বন্দনা করে ও পাদ্য-আচমনীয় দিয়ে সম্মান করলেন। শবরী জানালেন যে, তিনি ব্যতীত এই আশ্রমের সব ঋষিই স্বর্গে গমন করেছেন। এবং তিনি কেবল রামের দর্শনের অপেক্ষায় তখনও দেহত্যাগ করেননি। রাম-লক্ষ্মণকে পরম ভক্তিভরে সেবা-যত্ন করার পর শবরী অগ্নিতে দেহ আহুতি দিলেন এবং দিব্য রূপে স্বর্গলোকে গমন করলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৮। সীতা অন্বেষণ। রাম-লক্ষ্মণের সাথে হনুমানের সাক্ষাৎ।

    রাম-লক্ষ্মণ ঋষ্যমূক পর্বতের নিকট আসলে সুগ্রীব তাঁদের দূর হতে দেখে ভয় পেয়ে সহচর বানরদের সাথে এক নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন। সুগ্রীব তাঁর সচীব হনুমানকে রাম-লক্ষ্মণের পরিচয় জানতে পাঠালেন। এখন হনুমান সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। হনুমানের পিতার নাম কেশরী এবং মাতার নাম অঞ্জনা। পবনদেবের ঔরসজাত বলে হনুমানকে পবনপুত্রও বলা হয়। হনুমান বাল্যকালে সূর্যকে ফল মনে করে ধরার জন্য আকাশে তিনশত যোজন উঠেছিলেন, কিন্তু ইদ্র কুপিত হয়ে তাঁর উপর বজ্র নিক্ষেপ করলে তিনি পবর্তের চূড়ায় নিপাতিত হয়। পর্বতের চূড়ার উপরে নিপতিত হওয়া ফলে তাঁর বাম হনু (চোয়াল) ভগ্ন হয়ে যায় সেই থেকে তিনি হনুমান নামে খ্যাত হলেন। বজ্রাঘাতেও জীবিত আছে দেখে ইন্দ্র তুষ্ঠ হয়ে তাঁকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন এবং ব্রহ্মা তাকে বর দিলেন যে, কোন অস্ত্র তাকে বধ করতে পারবে না। যা হোক, হনুমান এক সন্ন্যাসীর রূপ ধরে রাম-লক্ষ্মণের নিকট আসলেন। রাম-লক্ষ্মণের নিকট সীতা হরণের কাহিনী শুনে তিনি নিজ রূপ ধারণ করলেন এবং রাম-লক্ষ্মণকে পিঠে বহন করে সুগ্রীবের কাছে নিয়ে গেলেন। সুগ্রীব হনুমানের নিকট রাম-লক্ষ্মণের পরিচয় শুনে তাঁদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করলেন। সুগ্রীব রাম-লক্ষ্মণকে জানাল যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বালী তাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছে এবং তাঁর পত্নী রুমাকে গ্রহণ করেছে। সুগ্রীব আরও জানল যে, রাবণ সীতাদেবীকে হরণ করে নিয়ে যাওয়া সময় সে তাঁকে দেখেছে। তিনি সীতার ফেলে দেওয়া উত্তরীয় ও অলঙ্কার এনে রামকে দেখালে রাম-সীতার দুঃখে বিলাপ করতে লাগলেন। তখন সুগ্রীব আশ্বাস দিলেন যে, তিনি সীতাকে খুজে তাঁর নিকট এনে দেবেন। রামও তাকে স্বান্তনা দিয়ে বললে যে, তিনি বালীকে বধ করে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করে দেবেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-৯। বালী ও সু্গ্রীবের যুদ্ধ এবং বালী বধ।

    রাম সুগ্রীবের সাথে বালী বধের পরিকল্পনা করলেন। সিদ্ধান্ত হল যে, সুগ্রীব বালীকে যুদ্ধে আহবান করবেন এবং সুগ্রীব ও বালীর যুদ্ধের সময় রাম তীর নিক্ষেপ করে বালীকে বধ করবেন। পরদিন সকলে সুগ্রীব পরিকল্পনা অনুসারে বালীকে যুদ্ধে অহবান করলে বালী যুদ্ধ করতে এল। তারপর শুরু হল বালী ও সুগ্রীবের তুমুল মুষ্টি যুদ্ধ। কিন্তু জ্যেষ্ঠ বালী ও কনিষ্ঠ সুগ্রীবের চেহারা একই রকম ছিল, ফলে রাম বালী ও সুগ্রীবকে পৃথক করতে পারলেন না। সুগ্রীব বালীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হয়ে পালিয়ে এলেন। পরের দিন সুগ্রীবকে সহজে চেনার জন্য ফুলের মালা পড়ানো হল। আবার সুগ্রীব বালীকে যুদ্ধে আহবান করলে বালী সুগ্রীবের সাথে যুদ্ধ শুরু হল। রাম এবার বালী ও সুগ্রীবকে পৃথক করতে পেরে বালীকে লক্ষ্য করে বাণ নিক্ষেপ করলে বালী বিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হল। বালীর মৃত্যুতে তার পত্নী শোকে কাতর হয়ে সহমরণে যেতে চাইলে রাম তাকে স্বান্তনা দিয়ে শান্ত করলেন। ভ্রাতার মৃত্যুর পর সুগ্রীবও শোকার্ত হলেন এবং সন্ন্যাসী হয়ে জীবনধারণ করতে চাইলেন। রাম সুগ্রীবকে শোক হতে নিবৃত্ত করে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা পদে এবং বালীপুত্র অঙ্গদকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১০। বাণর-সেনাদের সীতা অন্বেষণ।

   বর্ষা শেষে শরৎ ঋতু এলে সুগ্রীব সৈন্য সংগ্রহের জন্য হনুমানকে নির্দেশ দিলেন। লক্ষ্মণ ও হনুমান মিলে বানর, ভল্লুক ও গোলাঙ্গুল বীরগণকে রামের সম্মুখে উপস্থিত করলেন। তারপর সুগ্রীব সীতাদেবীকে অনুসন্ধানের জন্য পূর্ব দিকে পাঠালেন বিনত নামক যুথপতিকে, দক্ষিণ দিকে পাঠালেন হনুমান, নীল, জাম্ববান, গয়, গবাক্ষ প্রভৃতি বীরগণকে, পাশ্চিম দিকে পাঠালেন তারার পিতা অর্থাৎ তাঁর শ্বশুর সুষেণকে এবং উত্তর দিকে পাঠলেন শতবল নামক বীর বানরকে। তারা প্রত্যেকেই সসৈন্যে সীতা অন্বেষণে রওনা হলেন। তবে সব বানর সেনার মধ্যে হনুমান ছিলেন শ্রেষ্ঠ বীর। তাই সুগ্রীব হনুমানকেই সীতা উদ্ধারের গুরুভার অর্পণ করলেন। হনুমান রামের নিকট একটি অভিজ্ঞান (স্মৃতিচিহ্ন) চাইলে রাম তাঁকে একটি তাঁর নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় (আংটি) দেন যা দেখে সীতা বুঝতে পারে যে, হনুমান রাম কতৃর্ক প্রেরিত হয়েছেন। একমাস পর পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকের বানররা সীতাকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এল। দক্ষিণ দিকে গমনকারী হনুমান, অঙ্গদ, জাম্বুবান প্রভৃতি বীরগণ সীতাকে খুজতে খুজতে বিন্ধ্য-পর্বতের নিকট গেলেন। তাঁরা বিন্ধ্য-পর্বতে বসবাসকারী জটায়ুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম্পাতির নিকট জানতে পারে যে, এই দক্ষিণ সমুদ্রের ওপারে শতযোজন দূরে যে দীপ আছে সেখানে বিশ্বকর্মা নির্মিত লঙ্কাপুরীতে রাবণ বাস করে। সম্পাতির পুত্র সুপার্শ্ব রাবণকে দেখেছে এক নারীকে রথে করে লঙ্কার দিকে নিয়ে যেতে। সম্পাতির মুখের কথা শুনে বানরবীরগণ সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। লম্ফ দ্বারা গয় দশ, গবাক্ষ বিশ, শরভ ত্রিশ, ঋষভ চল্লিশ, গন্ধমাদন পঞ্চাশ, মৈন্দ ষাট, দ্বিবিদ সত্তর, সুষেণ আশি এবং বৃদ্ধ মল্লরাজ জাম্বুবান নব্বই যোজন যেতে পারে। অঙ্গদ শত যোজন বিস্তৃত সমুদ্র পার হতে পারলেও ফিরে আসার শক্তি তাঁর নেই। একমাত্র হনুমানই ঐ সমুদ্র পার হয়ে আবার ফিরে আসতে পারেন। তাই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় গিয়ে সীতার অনুসন্ধানের জন্য একমাত্র হনুমানই উপযুক্ত। হনুমান মহেন্দ্র পর্বতে আরোহন করে সূর্য, ইন্দ্র, ভূতগণ ও পবনদেবকে বন্দনা করে বৃহদাকার দেহ ধারণ করে সমুদ্র পার হওয়ার জন্য লম্ফ দিলেন। হনুমান আকাশমার্গে সমুদ্র পারি দেওয়ার পথে সিংহিকা নামক এক রাক্ষসীকে বধ করেন। হনুমান সমুদ্রের ওপার গিয়ে লম্ব পর্বতে অবতরণ করে ত্রিকুট পর্বতের উপর অবস্থিত লঙ্কাপুরীকে দেখতে লাগলেন। সন্ধ্যাকালে হনুমান বিড়ালের রূপ ধারণ করে উত্তর দ্বার দিয়ে লঙ্কায় প্রবেশ করলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১১। হনুমানের লঙ্কা-কাণ্ড।

    লঙ্কায় সীতাকে খুজতে খুজতে হনুমান অশোক বনে প্রবেশ করে একটি শিশু গাছে আরোহন করে দেখলেন যে, ঐ বৃক্ষের মূলে এক পরমা সুন্দরী রমণী রাক্ষুসী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। হনুমান ভাবলেন যে, হয়তো এই রমণীই দেবী সীতা হবেন। তারপর হনুমান দেখলেন যে রাবণ এসে সীতাকে পত্নী রূপে কামনা করল কিন্তু সীতা রাবণ ও তাঁর মাঝখানে একটি তৃণ রেখে রাবণকে দৃঢ় ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন। রাবণ তখন ক্রোধান্বিত হয়ে চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন যে, দু মাসের মধ্যে সীতা যদি তার পত্নী হতে সম্মত না হন তবে সে সীতাকে হত্যা করবে। রাবণ চলে যাওয়ার পর হনুমান রামের গুণকীর্তন শুরু করলেন। সীতা শব্দ শুনে বৃক্ষের উপরে চেয়ে দেখেন একটি বানর রামের গুণকীর্তন করছেন। তারপর হনুমান সীতার পরিচয় জানতে চাইলে সীতা হনুমানকে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বললেন। সীতাও হনুমানের পরিচয় জানতে চাইলে হনুমান তাকে রামের বার্তাবাহক হিসেবে পরিচয় দান করেন। কিন্তু সীতার মনে হল এটা কোন মায়াবী রাক্ষসের ছলও হতে পারে। তখন হনুমান রামের দেওয়া অঙ্গুরীয় প্রদর্শন করলে সীতার বিশ্বাস হয় যে, হনুমান সত্যিই রামের দূত। হনুমান সীতাকে পিঠে করে লঙ্কা থেকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তাতে রামের যশহানি হবে বলে তিনি হনুমানের সাথে যেতে চাইলেন না। সীতা চায় রাম যেন বীরত্বের সাথে লঙ্কায় এসে রাবণ বধ করে তাঁকে নিয়ে যান। হনুমান সীতার নিকট হতে অভিজ্ঞান স্বরূপ একটি বস্ত্রে শোভিত চূড়ামণি নিয়ে প্রস্থান করলেন।

    হনুমান লঙ্কা থেকে যাওয়ার পূর্বে শত্রুপক্ষের বলাবল যাচাই করতে চাইলেন। এজন্য তিনি অশোক বন লণ্ড-ভণ্ড করতে লাগলেন। রাক্ষসীদের নিকট রাবণ ঐ খবর জানাতে পেরে হনুমানকে বধ করার জন্য সৈন্য পাঠালেন। কিন্তু একে একে জম্বুমালী, মন্ত্রিপুত্রগণ, বিরূপাক্ষ, যূপাক্ষ, দুর্ধর্ষ, প্রঘস, ভাসকর্ণ, রাবণপুত্র অক্ষ প্রভৃতি রাক্ষসবীরগণ হনুমান কতৃর্ক নিহত হল। কোন উপায় না দেখে রাবণ তার পুত্র ইন্দ্রজিৎকে পাঠালেন। ইন্দ্রজিৎ বিভিন্ন বাণে হনুমানকে বিদ্ধ করতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হল। অবশেষে ইন্দ্রজিৎ ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে হনুমানকে বন্ধন করে রাবণের রাজসভায় নিয়ে গেলেন। রাবণ হনুমানের পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় হনুমান জানালেন যে, তিনি রাম ও কিস্কিন্ধ্যারাজ সুগ্রীবের দূত। সীতাদেবীর খোজ তিনি লঙ্কায় এসেছেন। তিনি একথাও বলেন যে, রাম-লক্ষ্মণ ও সুগ্রীব সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শীঘ্রই লঙ্কায় এসে সীতাদেবীকে উদ্ধার করবেন। হনুমানের কথা শুনে রাবণ হনুমানকে বধ করতে চাইল। কিন্তু রাবণ তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধর্মনিষ্ঠ বিভীষণের উপদেশে সে হনুমানকে বধ করা থেকে বিরত হল। তবে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য তার লেজে অগুন ধরিয়ে দিলেন। সীতা একথা জানতে পেরে অগ্নির নিকট প্রার্থনা করলেন যেন হনুমানের লাঙ্গুল দগ্ধ না হয়। তারপর হনুমান দেখলেন যে, তাঁর লাঙ্গুলে আগুন থাকার পরও বরফের মত শীতল বোধ হচ্ছে। হনুমান তখন তাঁর ঐ লেজের আগুন দিয়ে সমস্ত লঙ্কাপুরী দগ্ধ করলেন। তারপর সমুদ্রের জলে আগুন নিভিয়ে এবং সীতাদেবীর নিকট বিদায় নিয়ে লঙ্কা পার হয়ে জাম্বুবান, অঙ্গদ প্রভৃতি সহচারীদের সাথে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এলেন। হনুমান সীতার দেওয়া মণি রামকে দেখলেন এবং সীতার সমস্ত বার্তা রামকে বললেন। সব কিছু শুণে রাম আবেগে আপ্লুত হলেন এবং প্রতীজ্ঞা করলেন যে সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় নিয়ে যাবেন। তারপর রাম-লক্ষ্মণ, সুগ্রীব ও তার সৈন্য-সামন্তের সাথে উত্তরফাল্গুণী নক্ষত্রের দিনে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন। তাঁরা সমুদ্র তীরবর্তী বেলাবনে এসে চিন্তা করতে লাগলেন কি করে সমুদ্র পার হওয়া যায়।

    হনুমানের লঙ্কা-দগ্ধ হওয়ার কথা এবং রামের লঙ্কা আক্রমনের কথা শুনে রাবণ একটু চিন্তিত হয়ে পড়লে অন্যান্য অসুররা তাকে সান্ত্বনা ও উৎসাহ দিল। কিন্তু বিভীষণ রাবণকে উপদেশ দিলেন যে, রাম কোন সাধারণ মনুষ্য নয়। সকলের অবধ্য রাম লঙ্কা আক্রমন করলে লঙ্কার সব রাক্ষস ধ্বংস হবে তাছাড়া সীতাকে হরণ করে রাবণ অর্ধম করেছে তাই সীতাকে রামের নিকট ফিরিয়ে দেওয়াই তার কর্তব্য। বিভীষণের উপদেশ রাবণ অমান্য করল এবং অন্যান্য রাক্ষসরাও বিভীষণকে অনেক অপমান করল। তাই বিভীষণ লঙ্কা ছেড়ে রামের পক্ষে যোগ দিলেন। রাবণ শাদুর্ল নামক এক চরের নিকট খবর পেল যে, রাম-লক্ষ্মণ ও সুগ্রীবের বানরসেনারা লঙ্কা আক্রমন করতে আসছেন। তখন রাবণ শুক নামক মন্ত্রীকে পাঠালেন সুগ্রীবকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার অনুরোধ করতে। শুক পক্ষী রূপ ধারণ করে সুগ্রীবের নিকট ঐ মন্ত্রণা দিলে সুগ্রীব তা প্রত্যাখ্যান করেন।

রামায়ণ কাহিনী: পর্ব-১২। সমুদ্র-সেতু রচনা ও লঙ্কা গমন। 

    রাম সমুদ্রের তীরে কুশ বিছিয়ে পূর্বমুখী হয়ে শয়ন করে সংকল্প করলেন, “হয় সাগর পার হব নয় সমুদ্র লুপ্ত করব”। কিন্তু ত্রিরাত্র আরাধনা করার পরেও সমুদ্র দেখা না দিলে, রাম সমুদ্র শুষ্ক করার জন্য ধনুতে ব্রহ্মাস্ত্র যোজনা করলেন। তখন সমুদ্র উপস্থিত হয়ে সমুদ্র পার হওয়ার উপায় বললেন। সমুদ্র জানালেন যে, বিশ্বকর্মাপুত্র নল তাঁর বক্ষে সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ এবং তিনি আরো প্রতিশ্রম্নতি দিলেন যে, পার হওয়াকালে তিনি স্থির থাকবেন। কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র অব্যর্থ, তাই রাম সমুদ্রের অনুরোধে উত্তরদিকে দ্রুমকুল্য নামক স্থানে ঐ তীর নিক্ষেপ করায় সেখানে গহববের সৃষ্টি হল এবং ঐ স্থান মরুকান্তার নামে খ্যাত হল। রামের নির্দেশে নল অন্যান্য বানরসেনাদের সহায়তায় শাল, কুটজ, অজুর্ন, তাল, আম্র প্রভৃতি বৃক্ষ ও পাহাড় পর্বতের দ্বারা পাঁচ দিনের মধ্যে শতযোজন সেতু নির্মাণ করলেন। সমুদ্র পার হয়ে সুগ্রীব সৈন্য-সামন্তসহ প্রচুর ফলমূল ও জল সমন্বিত স্থানে এসে আশ্রয় নিলেন। রামের নির্দেশে নীল ও অঙ্গদ বানরবাহিনীর মধ্যভাগ, ঋষভ ও গন্ধমাদন দক্ষিণ ও বামপার্শ্ব, রাজা সুগ্রীব পশ্চাদ ভাগ, জাম্ববান, সুষেণ, ও বেগদর্শী অভ্যন্তরভাগ এবং রাম-লক্ষ্মণ অগ্রভাগ রক্ষার দায়িত্ব নিলেন। রাবণের দূত শুক এরকম সৈন্য-বিভাগের কথা রাবণের নিকট গিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করল। তারপর রাবণের নির্দেশে শুক, সারণ, শাদুর্ল প্রভৃতি রাক্ষসরা রামের বানরসেনার নিকট এসে বানর রূপ ধরে সব খবরাখবর নিতে আসল। কিন্তু বিভীষণ তাদের চিনে ফেলে এবং তাদের ধরে রামের নিকটে নিয়ে যায়। দয়ালু রাম তাদের মুক্তি দিলে তারা রাবণের নিকট ফিরে আসে।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৩। লঙ্কা-যুদ্ধের প্রস্তুতি।

    রাবণের নির্দেশে বিদ্যুজ্জিুহ্ব নামক এক মায়াবী মায়াবলে রামের মুণ্ড ও বৃহৎ ধনুর্বাণ প্রস্তুত করে। তারপর রাবণ সীতার নিকট এসে বলে যে, বিদ্যুজ্জিহ্ব রামের মুণ্ড ছেদন করেছে। রাবণের নির্দেশে বিদ্যুৎজ্জিহ্ব রামের মুণ্ড ও ধনু সীতার নিকট রেখে যায়। সীতা তা দেখে বিলাপ করতে করতে ভূপাতিত হয়ে যায়। তারপর রাবণ চলে গেলে রাক্ষসী সরমা সীতাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে যে, ঐ মুণ্ড রামের নয়, সবই রাবণের মায়া। সরমার কথা শুনে সীতা শান্ত হন। রাবণের মাতামহ মাল্যবাণ রাবণকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে এবং সীতাকে রামের নিকট ফিরিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু রাবণ সে উপদেশ উপেক্ষা করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। রাবণ প্রহস্তকে পূর্বদ্বারে। মহাপার্শ্ব ও মহোদরকে দক্ষিণ দ্বারে, ইন্দ্রজীৎকে পশ্চিম দ্বারে নিযুক্ত করে সে নিজে উত্তরদ্বারের দায়িত্ব নিল। বিভীষণ অনল, পনস, সম্পাতি ও প্রমতি এ চার অমাত্যের সাহায্যে রাবণের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সৈন্য বিভাগের খবর পেয়ে রামকে জানালেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৩। লঙ্কা-যুদ্ধ শুরু।

    রাম-লক্ষ্মণ ও অন্যান্য বানরসেনারা সুবেল পর্বতে আশ্রয় নিয়ে লঙ্কা দেখতে লাগলেন। রাবণকে দেখতে পেয়ে সুগ্রীব হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তার কাছে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে রাবণের শক্তি যাচাই করে আবার সুবেল পর্বতে ফিরে আসল। সুবেল পর্বত থেকে নেমে রাম শুভকালে যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিলেন। রামের আজ্ঞায় বালীপুত্র অঙ্গদ আকাশপথে রাবণের নিকট গিয়ে কিছু রাক্ষস নিধন করে আবার রামের নিকট ফিরে আসলেন। বানর-সেনারা লঙ্কার প্রাচীর ভেঙ্গে লঙ্কা পুরীতে প্রবেশ করে রাক্ষসদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। প্রথম দিনে রামের ছয় বাণে যজ্ঞশত্রু, মহাপার্শ্ব, মহোদর, বজ্রদংষ্ট্র, শুক ও সারণ এই ছয় রাক্ষসবীর মৃতপ্রায় হয়ে পলায়ন করল। অঙ্গদের হাতে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ পরাজিত হয়ে ক্রদ্ধ হল এবং মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে আবার যুদ্ধ করতে লাগল। রাম-লক্ষ্মণ নিহত হয়েছে, এ সংবাদ সীতার নিকট পৌঁছালে সীতা শোকার্ত হন। তখন সীতার নির্দেশে ত্রিজটা পুষ্পক রথে করে তাঁকে রণক্ষেত্র দর্শন করান। সীতা দেখলেন যে, রণক্ষেত্রে অনেক বাণর-সেনার মৃত্যদেহ পড়ে আছে। রাম-লক্ষ্মণ অচৈতন্য হয়ে আছেন। সীতা বিলাপ করতে থাকলে ত্রিজটা তাঁকে এই বলে স্বান্তনা দেন যে, রাম-লক্ষ্মণ নিহত হননি এবং তাঁরা সকলে সুস্থ হয়ে শীঘ্রই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসবেন। ত্রিজটার স্বান্তনাবাক্যে সীতা নিশ্চিন্ত হয়ে অশোক বনে ফিরে আসেন।

    বিভীষণের মাধ্যমে সুগ্রীব জানতে পারেন যে, রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ ছল করে রাম-লক্ষ্মণকে নাগপাশে বদ্ধ করেছে। কিছুক্ষণ পর গরুড় উপস্থিত হলে রাম-লক্ষ্মণকে বন্ধনকারী নাগেরা ভয়ে পালিয়ে গেল এবং তাঁরা নাগপাশ মুক্ত হওয়ার পর রামকে আলিঙ্গন ও প্রদক্ষিণ করে গরুড় প্রস্থান করলেন। তারপর আবার যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধে হনুমানের হস্তে ধূম্রাক্ষ ও অকম্পন, অঙ্গদের হাতে বজ্রদংষ্ট্র এবং নীলের হাতে প্রহস্ত নিহত হল। প্রহস্তের মৃত্যুর পর রাবণ যুদ্ধ করতে এল। রাবণ সুগ্রীবকে পরাজিত করলে লক্ষ্মণ এলেন তার সাথে যুদ্ধ করতে। রাবণ লক্ষ্মণকে একটি শিবদত্ত শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়েন। রাবণ লক্ষ্মণের দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে আসলে হনুমান তাকে মুষ্টিপ্রহার করে, ফলে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে হনুমান লক্ষ্মণকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেলেন। পরে সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে রাবণ আবার ঘোরতর যুদ্ধ শুরু করল। তাই রাম নিজেই তার সম্মুখে এসে যুদ্ধ শুরু করলেন। রাম রাবণের রথ, অশ্ব, সারথি, শূল ও খড়গ ছেদন করে রাবণের বক্ষে শরবিদ্ধ করায় সে মোহগ্রস্থ হল এবং তার হাত থেকে ধনু পড়ে গেল। তবে রাবণ রণক্লান্ত বলে রাম ঐদিন তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দিলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৪। কুম্ভকর্ণ বধ।

    রাবণ রামের হাতে পরাজিত হয়েছে বলে লজ্জিত হল এবং সিংহাসনে বসে ব্রহ্মার বর ও পূর্বের বিভিন্ন কৃতকর্মের কথা চিন্তা করতে লাগল। ব্রহ্মা রাবণকে বর দিয়েছিলেন যে, কোন রাক্ষস ও দেবতা তাকে যুদ্ধে বধ করতে পারবে না কেবল মানবের হাতেই তার মৃত্যু হবে। রাবণ আরও স্মরণ করতে লাগল যে, পূর্বকালে ইক্ষ্বাকুবংশীয় অনরণ্য তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, ইক্ষ্বাকুবংশে এমন একজন মনুষ্য জন্মগ্রহণ করবে যার হাতে তাকে সবংশে নিধন হতে হবে। এছাড়া রাবণের কুকর্মের জন্য উমা, নন্দীশ্বর রম্ভা ও বরুণকন্যা পুঞ্জিকস্থলাও তাকে শাপ দিয়েছিল। এসব ভেবে রাবণ ভীত হয়ে পড়লেন এবং তার মনে হতে লাগল হয়তো রামের হাতেই তার মৃত্যু হবে। তাই রাবণ তার ভ্রাতা কুম্ভকর্ণকে নিদ্রা হতে জাগানোর সিদ্ধান্ত নিল। কুম্ভকর্ণ জন্মগ্রহণ করেই ক্ষুধার্ত হয়ে সহস্রর প্রজা খেয়ে ফেলেছিল। তখন ব্রহ্মা তাকে শাপ দিলেন এবং ঐ শাপে সে মৃতের মত শুয়ে থাকল। তখন রাবণ তার ভ্রাতার শাস্তি লঘু করার প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা বললেন যে, কুম্ভকর্ণ ছয় মাস নিদ্রিত থেকে এক দিনের জন্য জাগবে এবং সেইদিন সে বহু লোক ভক্ষণ করবে। যা হোক, বিরাটাকার কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গের জন্য রাক্ষসরা উচ্চস্বরে চিৎকার, উচ্চরবে বাদ্য বাজানো, গদা ও মুষ্টি দ্বারা বক্ষে আঘাত, কর্ণকুহরে শতশত কলস জল ঢালা প্রভৃতি নানা কার্য করতে লাগল। তাতে ঘুম না ভাঙলে সহস্র হস্তী তার দেহের উপর উঠে চলাচল করলে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গে। কুম্ভকর্ণ রাবণের নির্দেশে যুদ্ধ করতে আসলে বানর-সেনারা তাকে দেখে ভয়ে পালাতে লাগল। কুম্ভকর্ণ বহু বানর ও ভল্লুককে ভক্ষণ করতে লাগল এবং সুগ্রীব, নীল, শরভ, গবাক্ষ, প্রলয়মেঘ, অঙ্গদ প্রভৃতি বীরদের পরাজিত করে রামের নিকট যুদ্ধ করতে এল। রাম বায়ব্য ও ঐন্দ্রাস্ত্রে কুম্ভকর্ণের দুই হস্ত এবং অর্ধচন্দ্র বাণে পদদ্বয় ছেদন করলেন। পরিশেষে ঐন্দ্র নামক শর দ্বারা রাম কুম্ভকর্ণের মস্তক ছেদন করলেন এবং তখন তার দেহ সমুদ্রে পতিত হল।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৫। মেঘনাথ বধ। 

    কুম্ভকর্ণের মৃত্যুতে রাবণ শোকে হতজ্ঞান হল। তারপর রাবণ দেবান্তক, নরনরান্তক, ত্রিশিরা ও অতিকায় নামক চার পুত্র এবং মহোদর ও মহাপার্শ্ব নামক ভ্রাতাকে যুদ্ধে পাঠাল। হনুমান দেবান্তক ও ত্রিশিরাকে, অঙ্গদ নরান্তককে, নীল মহোদরকে, ঋষব মহাপার্শ্বকে এবং লক্ষ্মণ ব্রহ্মাস্ত্রে অতিকায়কে বধ করলেন। রাবণের দুই ভ্রাতা ও চারপুত্র মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিৎ মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে মেঘের আড়ালে বসে যুদ্ধ শুরু করল। মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করতে সমর্থ বলে ইন্দ্রজিতের আর এক নাম মেঘনাথ। ইন্দ্রজিৎ মন্ত্রসিদ্ধ প্রাস, শূল ও তীক্ষ্ণ বাণের দ্বারা হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ জাম্বুবান, সুষেণ প্রভৃতি বীরগণকে বিদ্ধ করে রাম-লক্ষ্মণের দিকে বাণ নিক্ষেপ করতে লাগল। ইন্দ্রজিৎ স্বয়ম্ভু প্রদত্ত ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা রাম-লক্ষ্মণকে বিবশ করে পিতা রাবণের নিকট গিয়ে বিজয়সংবাদ বিবৃত করল। রাম-লক্ষ্মণ ব্রহ্মাস্ত্রের দ্বারা বধ্য নয় কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের সম্মান রক্ষার্থে তাঁরা বিবশ হয়ে পড়ে থাকলেন। তখন রাম-লক্ষ্মণের নিরাময়ের জন্য জাম্বুবান হনুমানকে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সাবর্ণ্যকরণী ও সন্ধানী এই চার প্রকার মহৌষধি আনার নির্দেশ দিলেন। হিমালয়ের কাঞ্চনময় ঋষভ ও কৈলাস পর্বতশিখরের মধ্যে দীপ্তিমান যে ঔষধি-পর্বত রয়েছে সেখানে ঐসব মহৌষধি রয়েছে। হনুমান ঔষধি-পর্বতে গেলে ঐ দীপ্তিমান ঔষধিসমূহ অদৃশ্য হওয়ায় হনুমান তা খুজে পেল না। তখন তিনি ক্রদ্ধ হয়ে ঐ ঔষধি-পর্বতকেই মাথায় উঠিয়ে নিয়ে আকাশপথে ফিরে এলেন। ঔষধির গন্ধ নিয়ে রাম-লক্ষ্মণ ও অন্যান্য বানর-সেনারা সুস্থ হয়ে ওঠল এবং হনুমান ঔষধি-পর্বত যথাস্থানে রেখে ফিরে আসলেন। বানরগণ পুণরায় যুদ্ধক্ষেত্রে এলে রাবণ কুম্ভ ও নিকুম্ভকে যুদ্ধে পাঠালেন। তাদের সাথে যূপাক্ষ, শোণিতাক্ষ, প্রজঙ্ঘ ও কম্পন যোগ দিল কিন্তু তারা সকলেই যুদ্ধে নিহত হল। পরে খরের পুত্র মক রাক্ষস যুদ্ধ করতে এলে রামের শরাঘাতে নিহত হয়। তারপর ইন্দ্রজিৎ এক মায়া দ্বারা সীতার মূর্তি নির্মাণ করে সেই মূর্তি রথে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। ইন্দ্রজিৎ হনুমানের সম্মুখে ঐ মায়াসীতার মুণ্ড ছেদন করে নিকুম্ভিলার যজ্ঞ-ভূমিতে হোম করতে চলে গেল। হনুমান শোকার্ত হয়ে রামের নিকট সীতাবধের সংবাদ দিলে রাম শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তখন বিভীষণ এসে বুঝালেন যে, এসব ইন্দ্রজিতের মায়া কারণ রাবণ কখনও সীতাকে বধ করার নির্দেশ দেবে না।

    ইন্দ্রজিৎ নিকুম্ভিলায় যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারলে তাকে বধ করা অসম্ভব হবে। তাই বিভীষণের উপদেশমত লক্ষ্মণ, হনুমান ও বিভীষণ বানর-সেনা নিয়ে নিকুম্ভলার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। যজ্ঞস্থল অসংখ্য রাক্ষস-সেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। লক্ষ্মণ ও হনুমান সেখানে গেলে ঐসব রাক্ষসসেনা তাঁদের আক্রমন করল। তারপর লক্ষ্মণ ও হনুমান রাক্ষস-সেনাদের বধ করতে শুরু করলেন। ইন্দ্রজিৎ তা টের পেয়ে অস্ত্রসহ যুদ্ধ করতে এল। লক্ষ্মণও হনুমানের পিঠে বসে যুদ্ধ শুরু করল। লক্ষ্মণ ও ইন্দ্রজিতের মধ্যে অনেকক্ষণ যাবৎ তুমুল যুদ্ধ হল। পরিশেষে ঐন্দ্রবাণে লক্ষ্মণ ইন্দ্রজিতের মস্তক দেহচ্যুত করলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৬। লক্ষ্মণকে শক্তি-শেল নিক্ষেপ।

    পুত্র ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রাবণ মুর্ছিত হল এবং পরে সংজ্ঞা লাভ করে ক্রোধিত হয়ে সীতাকে বধ করতে গেল। কিন্তু অমাত্য সুপার্শের পরামর্শে রাবণ সীতাকে বধ করা থেকে বিরত হল। পরের দিন অমাবশ্যা তিথিতে রাবণ সহস্রর হস্তী, রথ এবং অসংখ্য রাক্ষসবীর সমেত রামের সাথে যুদ্ধ করতে এল। তারপর রাম ও রাবণের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্মণ রাবণকে আক্রমন করলেন। লক্ষ্মণ রাবণের ধ্বজ, ধনু এবং সারথির মস্তক ছেদন করলে রাবণ ক্রদ্ধ হয়ে লক্ষ্মণকে উদ্দেশ্য করে ময়দানব নির্মিত অষ্টঘণ্টাযুক্ত শক্তি-শেল নিক্ষেপ করল। ঐ শক্তি-শেল লক্ষ্মণের বক্ষভেদ করলে লক্ষ্মণ ভূতলে পড়ে গেলেন। রামের নির্দেশে সুগ্রীব ও হনুমান লক্ষ্মণকে যুদ্ধস্থল থেকে নিয়ে গেলেন। তারপর রাম ক্রোধ ও পরাক্রমের সাথে রাবণের প্রতি শরবষর্ণ করতে লাগলেন। তখন রাবণ নিপীড়িত হয়ে রণস্থল ত্যাগ করল। রাম লক্ষ্মণের শোকে বিহ্বল হয়ে বললেন, “দেশে দেশে পত্নী পাওয়া যায়, দেশে দেশে বন্ধুও মেলে কিন্তু এমন দেশ দেখি না, যেখানে লক্ষ্মণের মত সহোদর ভ্রাতা পাওয়া যায়”। তখন সুষেণ রামকে স্বান্তনা দিয়ে শান্ত করলেন এবং হনুমানকে বলল জাম্বুবান পূর্বে যে ঔষধি-পর্বতের কথা বলেছিল তার দক্ষিণ শিখর থেকে বিশল্যাকরণী, সাবর্ণ্যকরণী, সঞ্জীবকরণী ও সন্ধানী এই চার প্রকার মহৌষধি শ্রীঘ্র নিয়ে আসতে। হনুমান দ্রুত সেখানে গিয়ে পর্বতের শৃঙ্গ সমেত মহৌষধি নিয়ে এলেন। সুষেণ ওষধি পেষণ করে লক্ষ্মণকে আঘ্রাণ করালে লক্ষ্মণ সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং রাম আনন্দে আত্মহারা হলেন। তখন ইন্দ্র রামের জন্য একটি রথ, ঐন্দ্র মহাধনু, শর, কবচ ও শক্তি পাঠালেন। রাম সে রথে আরাহন করে রাবণের সাথে যুদ্ধ করতে গেলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৭। রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং রাবণ বধ।

    আবার শুরু হল রাম-রাবণের ঘোরতর যুদ্ধ। রাম রাবণের গান্ধর্ব ও দৈবাস্ত্র অনুরূপ অস্ত্র দ্বারা এবং সর্পাস্ত্র গরুড় অস্ত্র দ্বারা ছিন্ন করলেন। দেবতা ও অসুররাও রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখতে এলেন। আগস্ত ঋষি যুদ্ধ দেখতে এসে রামকে একটি স্তোত্র পাঠ করতে বললেন যা রাবণবধ তরান্বিত করবে। রাম সূর্যের উদ্দেশ্যে ঐ স্ত্রোত্র পাঠ করে রাবণের সাথে তুমুল যুদ্ধ করতে লাগলেন। রাম তীক্ষ্ণ শরাঘাতে রাবণের মস্তক ছেদন করলেও অনুরূপ আর একটি মস্তক উৎপন্ন হল। যতবার মস্তক ছেদন করা হয় ততবার নতুন মস্তক উৎপন্ন হতে থাকে। তারপর রাম সারথি মাতলির পরামর্শে রাবণের প্রতি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলে তা রাবণের বক্ষ ভেদ করে এবং রাবণ ভূতলে পতিত হয়। রাবণবধের পর দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৮। সীতার অগ্নি-পরীক্ষা।

   রাবণের মৃত্যুতে বিভীষণ শোকার্ত হলেন। রাবণের জ্যেষ্ঠা পত্নী ময়কন্যা মন্দোদরী সহ অন্যান্য পত্নীগণও বিলাপ করতে লাগল। তখন রাম তাদের স্বান্তনা দিলেন। রামের নির্দেশে বিভীষণ রাবণের অগ্নি-সৎকার করলেন। তারপর রাম-রক্ষ্মণকে বিভীষণকে লঙ্কার রাজা পদে অভিষিক্ত করলেন। হনুমান সীতার নিকট গিয়ে রাবণবধের সংবাদ দিলেন সীতা আনন্দে বিহ্বলা হলেন এবং রামকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। হনুমান রামকে গিয়ে সীতার কথা বললেন। তখন রাম বিভীষণকে নির্দেশ দিলেন সীতাকে স্নান করিয়ে তাঁর নিকট নিয়ে আসতে। বিভীষণ সীতার নিকট গিয়ে রামের সংবাদ শোনালে সীতা স্নান করে বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে রামের নিকট এলেন। রাম ও সীতা পরস্পরকে দর্শন করতে লাগলেন। কিন্তু রাম সীতার চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করে সীতাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। তখন সীতা লজ্জায় ও শোকে অগ্নিতে প্রবেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। “রাম যাকে দুষ্টা মনে করেন সে আমি যদি শুদ্ধচরিত্রা হই, তবে লোকসাক্ষী অগ্নিদেব, আমাকে রক্ষা করুন” এই বলে সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। সমবেত রাক্ষস, বানর ও স্ত্রীগণ উচ্চস্বরে রোদন করতে লাগল। তখন কুবের, যম, পিতৃগণ, ইন্দ্র, বরুণ, মহাদেব ও ব্রহ্মা উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা রামকে বললেন যে, সীতা সতী এবং রাম স্বয়ং শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী নারায়ণ। তারপর অগ্নি সীতাকে ক্রোড়ে নিয়ে চিতা থেকে উঠলেন এবং রামের হাতে সীতাকে সমর্পণ করে বললেন, “এই নিষ্পাপ বিশুদ্ধ-স্বভাবা মৈথেলীকে অসংকোচে গ্রহণ কর”। তারপর রাম ক্ষণকাল চিন্তা করে বললেন, “সীতা রাবণগৃহে দীর্ঘকাল ছিলেন, সেজন্য তাঁর শুদ্ধি আবশ্যক নতুবা লোকে বলবে দর্শরথপুত্র রাম মুর্খ ও কামুক। আমি জেনেছি, সীতা অনন্যহৃদয়া, ইনি নিজের তেজেই রক্ষিতা, রাবণ তাঁকে মনে-মনেও ধর্ষণ করতে পারেনি। নিজের কীর্তির ন্যায় সীতাকে আমি ত্যাগ করতে পারি না। আপনারা সকলে যে হিতবাক্য বললেন তা অবশ্যই আমি পালন করব”।

    সীতার অগ্নিপরীক্ষার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। সীতা যে সতী ও পতিব্রতা, তা রাম মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করেন। কিন্তু লোকসম্মুখে তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন যে, তাঁর পত্নী কতটা সতী। অগ্নিপরীক্ষার পূর্বেই রাম জানতেন যে, অগ্নিতে সীতা দগ্ধ হবেন না কিন্তু সবার কাছে সীতার মাহাত্ম্য ও সতীত্বকে প্রকাশ করতেই এই নাটক করলেন। রাম দেবী সীতাকে কলঙ্ক দেওয়ার ছলে আরও মহিমান্বিত করলেন। তারপর স্বর্গ থেকে দশরথ এসে রাম-সীতাকে দর্শন দিলেন। বনবাসের চতুর্দশ বর্ষ উত্তীর্ণ হওয়ায় দশরথ রামকে অযোধ্যায় গিয়ে অভিষিক্ত হতে বললেন। লক্ষ্মণকে রাম-সীতার সেবা করার নির্দেশ দিলেন। সীতাকে দশরথ বললেন, “পুত্রী, তুমি রামের উপর রুষ্ট হয়ো না, তোমার হিত কামনায় এবং শুদ্ধির নিমিত্তই রাম তোমাকে ত্যাগের কথা বলেছিলেন। তুমি যে অসামান্য চরিত্র-লক্ষণ দেখিয়েছ, তাতে অন্য সকল নারীর যশ পরাভূত হবে”। দশরথ সকলকে আশীর্বাদ করে স্বর্গে প্রস্থান করলেন। ইন্দ্র রামের ইচ্ছায় মৃত সব বানরদের জীবিত করে বিদায় নিলেন। তারপর বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান এবং তাঁদের সহচরদের (বানর ও রাক্ষস) সাথে পুষ্পক রথে করে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা অয্যেধ্যায় ফিরে আসলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-১৯। রাম-সীতার অযোদ্ধায় প্রত্যবর্তন

    প্রথমে তাঁরা ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে এলেন এবং হনুমান গিয়ে ভরতকে সব সমাচার জানালেন। রাম বনে যাওয়ার পর ভরত অযোধ্যা থেকে এক ক্রোশ দূরে নন্দীগ্রামে জটা ধারণ করে রামের পাদুকাদ্বয় সম্মুখে রেখে রাজ্য পরিচালনা করতেন। হনুমানের সংবাদ শুনে ভরত আহ্লাদিত হয়ে শত্রুঘ্নকে রামের সংবর্ধনার আয়োজন করতে বললেন। তারপর সেই বহুপ্রতীক্ষিত শুভক্ষণ। রাম-সীতা-লক্ষ্মণের সাথে ভরত-শত্রুঘ্ন ও তাঁদের মাতাদের মিলন ঘটল। তারপর রাম-সীতাকে বস্ত্র ও স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করে পাচঁশত নদীর জলে অভিষিক্ত করা হল। রামের রাজা পদে অভিষেকের পর সুগ্রীব ও বিভীষণ তাঁদের অনুচরদের নিয়ে নিজ নিজ দেশে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। ভরতকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করা হল। রাম রাজা হয়ে দশ বার অশ্বমেদ যজ্ঞ সহ বিবিধ যজ্ঞ করতে লাগলেন। রামের রাজত্বে প্রজারা অতি সুখে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। ঋষি বাল্মীকি এ পর্যন্তই রামায়ণ রচনা করেছিলেন।

রামায়ণ কাহিনী : পর্ব-২০। উত্তর কাণ্ড।

    উত্তর কাণ্ড বাল্মীকি প্রণীত নয় এবং এটা রামায়ণের পরে রচিত হয়েছে। উত্তর কাণ্ডের কাহিনী এরকম রাম রাজা পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর প্রজাদের পরম স্নেহে লালন-পালন করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদিন পর যখন সীতা দেবীর গর্ভ-লক্ষণ দেখা গেল তখন সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রজাদের অনেকেই সংশয় প্রকাশ করল। সীতা সতী ও নিষ্পাপ জেনেও রাম লোকনিন্দার ভয়ে প্রজাদের মনরক্ষার জন্য তাঁকে ত্যাগ করলেন। তাই লক্ষ্মণ সীতাকে রামের নির্দেশে গঙ্গার অপর পারে তমসা নদীর তীরে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে রেখে আসলেন। সেখানে সীতা লব ও কুশ নামের দুই জমজ পুত্র প্রসব করেন। তারপর রাম অশ্বমেদ যজ্ঞ করলে সে যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে বাল্মীকি তাঁর শিষ্যগণ ও লব-কুশকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। বাল্মীকির নির্দেশে লব-কুশ বীণাযন্ত্র সহযোগে যজ্ঞে উপস্থিত সকলকে রামায়ণ গান শোনালেন। ঐ রামায়ন গান শোনার পর রাম লব-কুশের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা নিজেদের বাল্মীকির শিষ্য বলে পরিচয় দেন। কিন্তু রাম বুঝতে পারেন যে, এ বালকদ্বয় তাঁরই পুত্র। তখন রাম বাল্মীকির অনুমতি নিয়ে সীতাকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে আসার জন্য দূত পাঠালেন। রাম চাইলেন সকলের সামনে সীতা আত্মশুদ্ধির জন্য শপথ করুক এবং মনে মনে স্থির করলেন আত্মশুদ্ধির পর তিনি সীতাকে পুনরায় পত্নী রূপে গ্রহণ করবেন। কিন্তু পরের দিন সীতাদেবী যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে সকলের সামনে বললেন, “আমি যদি রাঘব ভিন্ন অন্য কাউকে মনে-মনেও চিন্তা করে থাকি, তবে মাধবী দেবী (পৃথিবী) বিদীর্ণ হয়ে আমাকে আশ্রয় দিন”। তখন মাধবী দেবী উপস্থিত হয়ে সীতাকে সিংহাসনে বসিয়ে রসাতলে নিয়ে গেলেন। সীতার এমন সতীত্ব দেখে উপস্থিত সবাই ধন্য-ধন্য করতে লাগলেন।

    রাম সীতার শোকে কাতর হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন এবং ধরিত্রীদেবীর নিকট হতে সীতাকে উদ্ধার করে আনার শপথ করলেন। তখন ব্রহ্মা দেবগণের সাথে এসে রামকে বললেন যে, রাম স্বয়ং বিষ্ণু এবং সীতা লক্ষ্মী। সময় হলে স্বর্গে দুজনার আবার মিলন হবে। ব্রহ্মার কথা শুনে রাম শান্ত হলেন এবং ব্রহ্মার নির্দেশে রাম বাল্মীকির নিকট রামায়ণের উত্তর কাণ্ড শুনতে চাইলেন। তখন বাল্মীকি উত্তর কাণ্ড রচনা করেন এবং লবকুশ তা রামকে শোনান। তারপর রাম পুনরায় বিবাহ না করে সীতার মূর্তি পাশে রেখে দশ বৎসর যাবৎ অশ্বমেদ, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম প্রভৃতি যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। তারপর ব্রহ্মার নির্দেশে কাল এসে রামকে জানালেন যে, তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করার সময় এসে গেছে। তখন রাম উত্তর কাণ্ডের কাহিনী অনুসারে লক্ষ্মণকে বর্জন করলেন। লক্ষ্মণ তখন সরযূ নদীর তীরে যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। রাম লক্ষ্মণের শোকে কুশকে দক্ষিণ কোশল এবং লবকে উত্তর কোশল রাজ্যের ভার অর্পণ করে সরয়ূ তীরে গেলেন। ভরত ও শত্রুঘ্নও রামের সাথে সরযূ তীরে গেলেন। রাম তাঁর অনুজগণের সঙ্গে সশরীরে বৈষ্ণবতেজে প্রবিষ্ট হলেন। এভাবে রামায়ণের সমাপ্ত হল।

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

ঈশ্বরতত্ত্ব










 হিন্দু দেবতা




0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন