7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১

দেবী দুর্গার স্বরূপ

 দেবী দুর্গা

    ঈশ্বরের চৈতন্যময়ী মহাশক্তি দ্বারা বিশ্ব-জগৎ নিয়ন্ত্রিত হয়। ঐ চৈতন্যময়ী মহাশক্তিই দুর্গা নামে অভিহিত। সৃষ্টির আদিতেও ঐ মহাশক্তি ছিল বলে তাকে আদ্যাশক্তি বলা হয়। ঈশ্বরের তিন শক্তি তিন প্রকার, যথা- জ্ঞান-শক্তি ইচ্ছা-শক্তি ও ক্রিয়া-শক্তি। জ্ঞান-শক্তিকে মহাসরস্বতী, ইচ্ছা-শক্তিকে মহালক্ষ্মী এবং ক্রিয়া-শক্তিতে মহাকালিকা বলে এবং এই তিন শক্তির সমন্বিত রূপ হলেন দেবী দুর্গা। দুর্গ অর্থ দুর্গতি বা দুঃখ। যিনি দুর্গতি নাশ করেন তিনিই দুর্গা। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আছে- দুর্গাসি দুর্গ ভবসাগরনৌরসঙ্গা অর্থাৎ তুমি দুর্গা, দুর্গম ভবসাগর পারের একমাত্র নৌকা। চণ্ডী অনুসারে দুর্গম্ নামক এক অসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা নামে খ্যাত হয়েছেন। আবার দুর্গা অর্থ দুর্জ্ঞেয়া বা অগম্য। তাই যাকে জানা দুঃসাধ্য তিনিই দুর্গা। শব্দকল্পদ্রম্নমে আছে ‘‘দ’’ অর্থ দৈত্যনাশক, ‘‘উ’’ কার বিঘ্ননাশক ‘‘রেফ’’ রোগনাশক ‘‘গ’’ পাপনাশক এবং ‘‘আ’’ কার ভয় ও শত্রুনাশক। সুতরাং যিনি দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় এবং শত্রু হতে রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। 
দেবী দুর্গা

   দুর্গার অপর নাম চণ্ডী। চণ্ডী অর্থ কোপময়ী বা ক্রোধান্বিতা। যিনি অসুর বধের জন্য ভয়ঙ্করী ও কোপময়ী মূর্তি ধারণ করেন তিনিই দেবী চণ্ডী। দুর্গা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এই তিন দেবতারই শক্তি। ব্রহ্মার শক্তি বলে দুর্গা ব্রহ্মাণী, বিষ্ণুর শক্তি বলে দুর্গা বৈষ্ণবী এবং শিবের শক্তি বলে দুর্গা শিবাণী নামে পরিচিতা। ভব, ভৌরব, শংকর, রুদ্র, মহাকাল, ঈশান প্রভৃতি শিবের বিভিন্ন নাম এবং দেবী দুর্গা শিবের শক্তি বলে ভবানী, ভৌরবী, শংকরী, রুদ্রানী, মহাকালী, ঈশানী নামে পরিচিতা। নারায়ণের শক্তি বলে দেবী দুর্গা নারায়ণী, ইন্দ্রের শক্তি বলে দেবী দুর্গা ইন্দ্রানী এবং বরুণের শক্তি হিসেবে দেবী দুর্গা বারুণী নামে পরিচিতা। যশ, মোক্ষ, জ্ঞান, ধন, বর প্রভৃতি দান করেন বলে দেবী দুর্গা যশোদা, মোক্ষদা, জ্ঞানদা, ধনদা, বরদা, প্রভৃতি নামে খ্যাত হয়েছেন। দুর্গা দেবীর আরেক নাম গৌরী। দেবীপুরাণ অনুসারে দেবী দুর্গা সূর্য-চন্দ্রের জ্যোতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম গৌরী। দেবী দুর্গা ভদ্রকালী ও উগ্রচণ্ডা এই দুই বিপরীত রূপে বিরাজমান। ভদ্রকালী রূপে দুর্গা মঙ্গল করেন এবং উগ্রচণ্ডা রূপে তিনি বিনাশ করেন। কালিকা পুরাণে বর্ণিত আছে- আমার যে মূর্তি উগ্রচণ্ডী, আমিই আবার ভদ্রকালী, যে মূর্তিতে তোমাকে বধ করব সে মূর্তি দুর্গা নামে কীর্তিতা। ভদ্র অর্থাৎ মঙ্গল, কাল অর্থ সময়। সুতরাং যিনি সকল সময়ে এবং মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল করেন তিনিই ভদ্রকালী। যিনি উগ্র ও ভীষণ মূর্তি ধারণ করে এবং ক্রোধান্বিতা হয়ে অসুর বিনাশ করেন, তিনিই উগ্রচণ্ডা। উগ্রচণ্ডা অষ্টদশভূজা, ভদ্রকালী ষোড়শভূজা এবং দুর্গা দশভূজা। 

দেবী দুর্গার স্বরূপ

প্রচলিত ধানমন্ত্রে দেবী দুর্গার যে রূপ পাওয়া যায় তা এরকম দেবী দুর্গার জটাযুক্ত কেশে অধর্চন্দ্র শোভিত রয়েছে। দেবী দুর্গা ত্রিনয়না। তাঁর বদন পূর্ণচন্দ্রের মত এবং দেহের বর্ণ অতসীফুলের মত হলুদাভ। দুর্গা ত্রিলোকে সুপ্রতিষ্ঠিতা, নব-যৌবনসম্পন্না, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা, সুন্দর ও সমুন্নত বক্ষবিশিষ্টা এবং সুচারুদর্শনা। তাঁর বামজানু, কটি ও গ্রীবা এই তিন স্থান কিঞ্চিৎ ত্রিভঙ্গভাবে স্থাপিত। দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী (মহিষাসুরকে যিনি মর্দন বা দলন করেন) এবং পদ্মের মৃণাল (পদ্মের বৃন্ত) তুল্য দশবাহু সমন্বিতা। দুর্গার ডান দিকের পঞ্চহস্তে ঊর্ধ হতে অধঃক্রমে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষ্ণ বাণ ও শক্তি রয়ছে এবং বাম দিকের পঞ্চহস্তে ঊর্ধ হতে অধঃক্রমে খেটক (ঢাল), ধনু, পাশ, অঙ্কুশ ও ঘণ্টা বা কুঠার রয়েছে। দেবী দুর্গার পদতলে ছিন্ন-মস্তক মহিষ এবং মহিষের স্কন্দদেশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে খড়গধারী এক দানব। দেবী দুর্গা শূল দ্বারা ঐ দৈত্যের বক্ষ বিদীর্ণ করেছেন। ফলে দৈত্যের শিরাসমূহ বিনির্গত এবং তার অঙ্গ রক্তাক্ত ও চক্ষু দুটি ক্রোধে রক্তিম হয়েছে। দেবী দুর্গা নাগপাশযুক্ত হস্ত দ্বারা অসুরের কেশাগ্র ধরেছেন। নাগপাশ বেষ্টিত হওয়াতে অসুরের মুখ দিয়ে রক্ত বহির্গত হয়ে উঠেছে। দেবী দুর্গার দক্ষিণ চরণ সিংহপৃষ্ঠে এবং বাম চরণের বৃদ্ধাঙ্গুলি অসুরের স্কন্ধ দেশে স্থাপিত। দেবী দুর্গা উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চণ্ডরূপা ও অতিচণ্ডিকা এই অষ্টশক্তি পরিবেষ্টিতা। দেবী দুর্গা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফল দান করে জগৎকে ধারণ করে আছেন। 

বেদে দুর্গা

বেদে দুর্গা বাক্ দেবী নামে পরিচিতা। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ সংখ্যক সূক্তকে দেবী-সূক্ত বলে। বেদের দেবী-সূক্তে দেবী বলেছেন- আমি রূদ্র ও বসু রূপে বিচরণ করি। আমি আদিত্য ও বিশ্বদেব রূপে বিচরণ করি। আমি মিত্রাবরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিদ্বয়কে ধারণ করি। আমি শত্রুনাশক সোমকে ধরে আছি, আমি ত্বষ্টা, পূষা ও ভগদেবকে ধারণ করি। যে যজমানের প্রচুর হবি আছে ও যা তিনি দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্পণ করেন ও যিনি বিধিমত সোমরস প্রদান করেন তাঁকে আমি যজ্ঞের ফল দান করি। আমি রাষ্ট্রী, রাষ্ট্রের অধীশ্বরী। রাজ্য রক্ষার্থ যে সম্পদের প্রয়োজন আমি তার বিধানকর্তা। সংসারে শান্তিলাভের জন্য যে ব্রহ্মজ্ঞান প্রয়োজন, আমি তাই জানি। আম এক হয়েও বহুরূপা। সর্বজীবে আমি বহুরূপে প্রবিষ্ট হয়ে আছি। দৈবী সম্পদশালী দেবতাগণ যা সাধন করেন সকলই আমার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়। যে অন্ন ভোজন করে, যে দর্শন করে, যে প্রাণ ধারণ করে, যে বাক্য শ্রবণ করে, সে ব্যক্তি আমা দ্বারাই ঐ সকল কর্ম সাধন করে থাকে। আমার এই সরূপতত্ত্ব যারা জানে না তারা হীনদশা প্রাপ্ত হয়। শোনো হে যশস্বী বন্ধু, বহু সাধনালব্ধ যে বার্তা তা তোমাকে বলছি। আমি নিজে সে কথা বলছি, যা দেবগণ ও মনুষ্যগণ সকলে জানার জন্য যত্নপরায়ণ। যে যেমন বাসনা করে তাকে তেমনটি আমিই করে থাকি। ব্রহ্মাও আমার সৃষ্টি; ঋষিও আমার সৃষ্টি এবং জ্ঞানীও আমার সৃষ্টি। আমি রূদ্রের ধনুকে জা-যুক্ত করে বিস্তার করি, যারা ব্রহ্মাদ্বেষী তাদের নাশের জন্য এবং সজ্জনের রক্ষার্থ আমি যুদ্ধ করি। স্বর্গ-মর্ত্যের সর্বত্র আমি সংপ্রবিষ্ট হয়ে আছি, সর্বোপরি যে জগতের পিতা তাঁকেও আমি প্রবসব করেছি। পরম জ্ঞান-সমুদ্রের অভ্যন্তরে আমার যোনিস্থান। সর্বভূবনে আমি অনুপ্রবিষ্ট। ভূলোকের ঊর্ধে যে দ্যুলোক আছে, তাও স্থির আছে আমি স্পর্শ করে আছি বলে। ভূলোক, ভূবলোকাদি নিখিল-বিশ্ব সৃষ্টি করতে করতে আমি তার উপর বায়ুর মত প্রবাহিত হই। মূলত আমি ভূলোক-দ্যুলোক সকলের ঊর্ধে। আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাতীত তথাপি নিজ মহিমায় জগন্ময়ী এই বিশ্বরূপধারিণী হয়ে আছি।     

বেদে দুর্গা

 উপনিষদে দুর্গা

    কেন উপনিষদে দেবী দুর্গার পরিচয় পাওয়া যায় হৈমবতী উমা নামে। হৈমবতী উমার আবির্ভাবের কাহিনীটি এরকম- এককালে দেবতারা তাঁদের শক্তি নিয়ে গর্ববোধ করতে লাগলেন। সর্বশক্তিমান ব্রহ্মা দেবতাদের দর্পচূর্ণ করার জন্য যক্ষ রূপে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। যক্ষরূপী ব্রহ্মা তাঁদের সম্মুখে একটি তৃণ রাখলেন এবং তাঁদের শক্তি প্রয়োগ করতে বললেন। দেবতারা ঐ তৃণকে তুচ্ছজ্ঞান করতে লাগলেন। কিন্তু বায়ু শত-চেষ্টার পরেও তৃণকে নড়াতে পাররেন না, অগ্নি শত-চেষ্টার পরও তৃণকে পোড়াতে পারলে না। তারপর ইন্দ্র তৃণের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে যক্ষরূপী ব্রহ্মা অদৃশ্য হন। তখন হৈমবতী উমা ইন্দ্রাদি দেবতার সম্মুখে দৃশ্যমান হয়ে বললেন যে- ঐ যক্ষই ব্রহ্ম। এখন উমা শব্দটি বিশেস্নষণ করা যাক। উমা শব্দটির ‘‘উ’’ দ্বারা গমন এবং ‘‘মা’’ দ্বারা দীপ্তি বা আলোক বোঝায়। সুতরাং উমা অর্থ গতিশীল আলোক অর্থাৎ উপনিষদের উমা জ্যোতির্ময়ী ব্রহ্মবিদ্যা যিনি ব্রহ্মকে প্রকাশ করেন। তবে উমা শব্দের পৌরাণিক অর্থ ভিন্ন। কালিকা পুরাণ মতে হিমালয় কন্যা পার্বতী কঠোর তপস্যায় রত হলে মা মেনকা বলেন- উ (অর্থাৎ হে কন্যা), মা (অর্থাৎ তপস্যা কর না)। মেনকা কর্তৃক তপস্যায় নিষিদ্ধা হয়ে পার্বতীর নাম হল উমা ও সোমা।

 দেবী দুর্গার সূক্ষ্ম তাৎপর্য

শক্তি নিরাকার এবং অদৃশ্যমান। তবে মহাশক্তি দুর্গার সাকার রূপ কেন? দেবী দুর্গার সাকার রূপের একটি সূক্ষ্ম অর্থ আছে। শুভ্র বা উজ্জ্বল বর্ণ সত্ত্বগুণ, লাল বর্ণ রজোগুণ এবং কাল বর্ণ তমোগুণকে নির্দেশ করে। দেবীর বর্ণ উজ্জ্বল এর অর্থ দেবী দুর্গা সত্ত্বগুণ সম্পন্না। দেবী দুর্গা দশহস্তে দশ প্রহরণ (অস্ত্র) ধারণ করেছেন এবং বস্ত্র ও অলঙ্কারে সজ্জিতা হয়েছেন। দেবীর এই রকম বেশ রজোগুণকে নির্দেশ করে। আবার দেবী দুর্গা ক্রোধান্বিতা হয়ে অসুরকে শূলবিদ্ধ করে বধ করেছেন। দেবী দুর্গার এ ভাবটি তমোগুণকে নির্দেশ করে। তাই দেবী দুর্গা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি এবং এই ভাবটি বোঝাতেই দেবী দুর্গার এরকম রূপের কল্পনা করা হয়েছে। দুর্গা শক্তি বা প্রকৃতিকে নারী জ্ঞান করা হয় কেন? নারী দ্বারাই স্থাবর ও জঙ্গম সব কিছু সৃষ্টি হয়। নারী সৃষ্টির প্রতীক। পরব্রহ্মের শক্তি বা প্রকৃতিকে নারী রূপে কল্পনা করা হয়। এজন্য চৈতন্যময়ী মহাশক্তি দুর্গাকে নারী রূপে কল্পনা করে নারীর বসন-ভূষণে সজ্জিতা করা হয়েছে। দেবী দুর্গার দশ হাত দশ দিক নির্দেশ করে। দেবী দুর্গা দশ দিকব্যাপী অর্থাৎ দেবী দুর্গা সর্বত্র বিরাজমানা এবং দশ হাতের দশ অস্ত্র দ্বারা দশ দিকের অসুরদের বিনাশ করে ভক্তের মঙ্গল করেন। দেবী সিংহের উপর দাড়িয়ে অসুর নিধন করছেন। সিংহ শব্দটির অর্থ যে হিংসা করে। হিংসা যেহেতু রজোগুণের কার্য সেহেতু সিংহ রজোগুণের প্রতীক। অসুর তমোগুণের প্রতীক। সিংহ অসুরকে বিবশ করছে আবার দেবী সিংহকে শাসন করছেন, এর অর্থ এই যে- রজঃ তমোকে নাশ করে এবং সত্ত্ব রজঃকে নাশ করে। রজঃ দ্বারা তমোকে এবং সত্ত্ব দ্বারা রজোকে নাশ করে সত্ত্বগুণে উন্নীত হওয়ার নাম সাধনা। তবে সাধনার উচ্চ স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য ত্রিগুণাতীত হওয়া আবশ্যক। দেবী দুর্গা ত্রম্বকা অর্থাৎ দেবী দুর্গার তিনটি অম্বক বা চক্ষু রয়েছে। দেবী দুর্গার তিন চক্ষু দ্বারা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই ত্রিকাল বোঝায়। তিনটি অম্বকের অধিকারিণী বলে দেবী দুর্গাকে অম্বিকাও বলা হয়।

দেবী দুর্গার উৎপত্তি

এবার দেবীর উৎপত্তি প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রকৃতপক্ষে দেবীর কোন উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। দেবীর উৎপত্তি বলতে বিশেষ কারণে দেবীর বিশেষভাবে প্রকাশিত হওয়া বোঝায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী চণ্ডীর উৎপত্তির কাহিনী এরকমপুরাকালে একশত বছর ধরে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। তখন অসুরদের অধিপতি ছিল মহিষাসুর। মহিষাসুর দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে এবং দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গের অধিপতি হয়। অগত্যা দেবগণ ব্রহ্মাকে অগ্রবর্তী করে শিব ও বিষ্ণুর নিকট উপস্থিত হন। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের স্বর্গরাজ্য অধিকারের বণর্না শুনে ভগবান শিব ও বিষ্ণু ক্রোধান্বিত হলেন এবং ভ্রুকুটিতে তাঁদের বদন কুটিল হল। তখন ক্রোধান্বিত ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও মহাদেবের বদন হতে জ্যোতি বা তেজঃ নির্গত হল। ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতার দেহ হতেও অতি প্রবল তেজঃ নির্গত হতে থাকল। তারপর সে তেজোপুঞ্জ একত্র হয়ে জ্যোতি দ্বারা ত্রিভুবন পরিপূর্ণ করে এক নারীতে পরিণত হল। শিবের তেজে সে নারীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুগুলো, চন্দ্রের তেজে স্তনযুগল, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে চরণদ্বয়, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দন্তসমূহ, অগ্নির তেজে নয়ন তিনটি, সন্ধ্যাদেবীদ্বয়ের (প্রাতঃ ও  সায়ং-সন্ধ্যা) তেজে ভ্রুদ্বয় এবং পবনের তেজে কর্ণদ্বয় গঠিত হল। সুতরাং দেবী চণ্ডী হলেন সর্বদেবদেবীর সমন্বিত শক্তি। দেবীকে দেখে সকল দেবতারা আনন্দিত হলেন। মহাদেব নিজ শূল হতে একটি শূল উৎপন্ন করে দেবী চণ্ডীকে উপহার দিলেন। তারপর বিষ্ণু দেবীকে চক্র, বরুণ শঙ্খ, অগ্নি শক্তি-অস্ত্র, পবন ধনু ও বাণপূর্ণ দুটি তুণী, ইন্দ্র বজ্র ও ঐরাবত হস্তীর গলার ঘণ্টা, যম দণ্ড, জলাধিপতি পাশ, প্রজাপতি অক্ষমালা (জপমালা), ব্রহ্মা কমণ্ডলু, সূর্য কিরণমালা, কাল খড়গ ও চর্ম (ঢাল), ক্ষীর সমুদ্র নানাবিধ বস্ত্রালঙ্কার, বিশ্বকর্মা কুঠার ও বর্ম, জলধি পদ্মমালা ও একটি মনোরম পদ্ম, কুবের সুরাপূর্ণ পানপাত্র এবং পৃথিবী অনন্ত নাগ উপহার দিলেন। দেবী বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে অট্টহাস্য সহকারে উচ্চনাদ করতে লাগলেন। ঐ উচ্চনাদের প্রতিধ্বনিতে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কম্পিত হতে লাগল। দেবগণ আনন্দে দেবীর জয়ধ্বনি করলেন। সেজন্য দেবীর নাম হল জয়া। পুরাণ মতে ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে দেবগণের তেজ মিলিত হয়ে দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল বলে দেবীর কাত্যায়ণী নামে পরিচিতা হলেন।

দেবী দুর্গার অসুর বধ

  দেবী দুর্গা মহিষাসুর, শুম্ভ-নিশুম্ভ, চণ্ড-মুণ্ড, রক্তবীজ, মধু-কৈটভ সহ নানা অসুন বধ করেন। নিম্নে সেসব অসুর বধের কাহিনী বর্ণনা করা হল। 

দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ

   রম্ভাসুরের ঔরসে মহিষীর গর্ভে মহিষাসুরের জন্ম। মহিষাসুর তপস্যা করে ব্রহ্মার নিকট বর লাভ করেছিলেন যে, কোন মনুষ্য, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব ও দেবতাদি তাকে বধ করতে পারবে না। তবে কোন পুরুষ তাকে বধ করতে না পারলেও নারীর হাতে সে বধ্য। কিন্তু মহিষাসুর ভাবলেন দেবতারা যেহেতু তাকে বধ করতে পারবে না, সামান্যা নারী তাকে কি বধ করবে? তাই সে অহংকারে উন্মত্ত হয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে দেবতাদের বিতাড়িত করে। তখন মহিষাসুর বধের নিমিত্তে মা দুর্গা আবিভূর্ত হয়ে অট্টহাস্য করতে থাকেন। তা শুনে মহিষাসুর ঐ শব্দের অভিমুখে চতুরঙ্গ (অম্ব, গজ, রথ ও পদাতিক) বাহিনী  সহকারে যুদ্ধ করতে উপস্থিত হন। তারপর শুরু হল দেবীর সাথে মহিষাসুর-বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় দেবীর নিঃশ্বাস থেকে উৎপন্ন হতে থাকল শত-শত গণদেবতা, অসুররা ঐ সকল গণদেবতা ও দেবীর সাথে ভোমর, ভিন্দিপাল, শক্তি, মূষল, খড়গ, পরশু (কুঠার), পট্টিশ, গদা প্রভৃতি অস্ত্র সহকারে যুদ্ধ করতে লাগল। দেবী অসুরদের সব অস্ত্র ছিন্ন করে একে একে সেনাপতি চিক্ষুর, চামর, উদগ্র, বাস্কল, উগ্রাস্য, উগ্রবীর্য, মহাহনু, বিড়ালাক্ষ প্রভৃতি অসুরবীরদের বধ করলেন। পরিশেষে মহিষাসুর মায়া দ্বারা মহিষের রূপ ধরে দেবীর নিকট অগ্রসর হল। মহিষরূপী অসুর শৃঙ্গ, মুখ, লাঙ্গল (লেজ) ও খুরের আঘাতে দেবীর গণদেবতাদের বধ করতে লাগল। মহিষাসুর শৃঙ্গ দ্বারা পর্বত নিক্ষেপ, খুর দ্বারা ভুতল বিদীর্ণ ও লাঙ্গুলের (লেজ) আঘাতে সমুদ্র সর্বদিকে প্লাবিত করতে লাগল। তখন দেবী মহিষাসুরকে পাশ দ্বারা বদ্ধ করলে মহিষাসুর মহিষ রূপ ত্যাগ করে সিংহমূর্তি ধারণ করে দেবীকে আক্রমন করল। দেবী সিংহরূপী মহিষাসুরের শিরচ্ছেদ করতে গেলে মহিষাসুর খড়গধারী এক পুরুষ রূপ ধারণ করল। দেবী বাণ দিয়ে তার বক্ষ বিদীর্ণ করলে সে এক মস্ত হস্তীর রূপ ধারণ করল। দেবী সে হস্তীরূপী মহিষাসুরের মস্তক ছেদ করলে সে পুনরায় মহিষ রূপ ধারণ করে দেবীকে আক্রমন করল। তখন দেবী সুরাপান করলেন এবং কুপিত হয়ে শূল দ্বারা মহিষকে আঘাত করলেন। ফলে মহিষাসুর ঐ মহিষের বদন হতে বহির্গত হল। তখন দেবী খড়গ দ্বারা মহিষাসুরের মস্তক ছেদন করে মহিষাসুর ভূতলে পতিত হল। মহিষাসুর বধের সাথে সাথে তার অন্য সব সৈন্যরাও বিনষ্ট হল এবং দেবতারা পরমানন্দে দেবী চণ্ডীর স্তব-স্তুতি করতে করলেন। 

দেবী দুর্গার শুম্ভ-নিশুম্ভ ও চণ্ড-মুণ্ড বধ

   এখন চণ্ড-মুণ্ড ও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনী বর্ণনা করা যাক। পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয় দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে এবং তাঁদের স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করে যজ্ঞভাগ কেড়ে নেয়। দেবতারা কোন উপায় না দেখে পর্বতরাজ হিমালয়ে এসে দেবী চণ্ডীর স্তবস্তুতি করতে থাকেন। তখন পার্বতী দেবী মন্দাকিনীর জলে স্নান করতে এসে দেবগণকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা এখানে কার স্তুতি করছ? তখন পার্বতীর দেহকোষ হতে এক দেবী নির্গতা হয়ে বললেন শুম্ভ এবং নিশুম্ভ কতৃর্ক যুদ্ধে পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে দেবগণ সমবেত হয়ে আমারই স্তব করছেন। যেহেতু ঐ দেবী পার্বতীর দেহকোষ হতে নির্গতা হয়েছেন তাই তিনি জগতে কৌষিকী (কৌশিকী) বলে খ্যাতা হলেন। কৌশিক দেবী নির্গত হওয়ার পর পার্বতী দেবীও কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গেলেন। তাই তিনি কালিকা নামে প্রসিদ্ধা হলেন। তখন চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয় ঐ কৌশিকী দেবীকে দেখে অসুররাজ শুম্ভকে গিয়ে বললেন যে, তারা এক অতি মনোহরা পরমা সুন্দরী নারীকে দেখেছে এবং তিনি শুম্ভের পত্নী হওয়ার যোগ্যা। তখন শুম্ভ সুগ্রীব নামক এক দূতকে দেবীর নিকট পাঠায়। অসুররাজ শুম্ভ দেবীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করতে চান একথা সুগ্রীবের নিকট শুনে দেবী বললেন, যিনি আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবেন তিনিই আমার পতি হবেন। সুগ্রীব শুম্ভের নিকট এসে ঐ কথা বললে শুম্ভ ক্রোধান্বিত হন এবং ধূম্রলোচন নামক অসুরপ্রধানকে সসৈন্যে পাঠান দেবীকে বলপূর্বক নিয়ে আসার জন্য। ধূম্রলন দেবীর হাতে নিহত হলে চণ্ড-মুণ্ড অসুরদ্বয় দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে আসে। চণ্ড-মুণ্ড ও তাদের চতুরঙ্গ সৈন্য দেখে দেবী ক্রোধান্বিত হলে তাঁর মুখ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। তাঁর ললাটদেশ ভ্রুকুটি করায় কুটিল হল এবং সেই ললাট হতে ভীষণবদনা অসি ও পাশধারিণী কালী দেবী নির্গতা হলেন। দেবী কালী চণ্ড ও মুণ্ডের মস্তক ছেদন করে দেবী চণ্ডিকাকে উপহার দিলেন। চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করেছেন বলে দেবীর নাম চামুণ্ডা নামে খ্যাতা হলেন। 

দেবী দুর্গার রক্তবীজ বধ

চণ্ড ও মুণ্ড নিহত হওয়ার পর শুম্ভের আদেশে রক্তবীজ নামক অসুর যুদ্ধ করতে এল। তখন দেবীকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী ও ঐন্দ্রী নামক শক্তির উৎপত্তি হল। কালী (চামুণ্ডা) সহ এই সব শক্তিকে একত্রে অষ্টশক্তি বলে। ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণীর হাতে জপমালা ও কমণ্ডলু এবং হংস তাঁর বাহন। মহেশ্বরের শক্তি মাহেশ্বরী চন্দ্রকলা ভূষিতা, সর্প বলয় রূপে পরিহিতা, ত্রিশুলধারিণী এবং বৃষবাহিণী। কুমারের (কার্তিক) শক্তি কৌমারী ময়ুরবাহিনী এবং শক্তি অস্ত্রধারিণী। বিষ্ণুর শক্তি বৈষ্ণবী শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মধারিণী এবং গরুড়াসীনা। বিষ্ণুর বরাহমূর্তির শক্তি বারাহীর রূপ নরসিংহের মত। ইন্দ্রের শক্তি ঐন্দ্রী সহস্রনয়না, বজ্রধারিণী এবং গজরাজ ঐরাবত বাহিনী। চামুণ্ডা দেবী শিবকে দূত হিসেবে শুম্ভের নিকট প্রেরণ করে তাঁকে বলতে বললেন যে, অসুরগণ যেন দ্রুত পাতালে গমন করে, না হলে তাদের সকলকে মরতে হবে। শিবকে দূত রূপে প্রেরণ করায় দেবী চামুণ্ডা শিবদূতী নামে পরিচিতা হলেন। তারপর শুরু হল অষ্ট-শক্তির সাথে রক্তবীজ ও তার অসুর সৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ। রক্তবীজ নামক অসুরের এমন বৈশিষ্ট্য যে, ঐ অসুরের রক্ত ভূমিতে পতিত হওয়া মাত্র অনুরূপ আর একটি অসুর সৃষ্টি হয়। ঐন্দ্রীর বজ্রের আঘাতে রক্তবীজের রক্ত ভূতলে পতিত হলে রক্তবীজের সমান আকৃতি ও বীর্য সম্পন্ন অনেক অসুর উৎপন্ন হল। দেবী চণ্ডিকা রক্তবীজকে শূল দ্বারা আঘাত করলে রক্তবীজের যে রক্ত ক্ষরিত হল দেবী চামুণ্ডা তা পান করতে লাগলেন। রক্ত পান করতে করতে এক সময় রক্তবীজ রক্তশূন্য হয়ে গেলে দেবী চণ্ডিকা বাণ ও অসি দ্বারা তাকে আঘাত করলেন। ঐ আঘাতে রক্তবীজ ভূতলে পতিত হল। রক্তবীজের মৃত্যুর পর শুম্ভের ভ্রাতা নিশুম্ভ যুদ্ধ করতে এলে তাকেও দেবী শূল দ্বারা বধ করেন। নিশুম্ভের মৃত্যুর পর শুম্ভ যুদ্ধ করতে এসে বললেন যে, অসুর বধ করে দেবী চণ্ডীর অহংকার সাজে না, কারণ তিনি অন্য শক্তির সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। একথা শুনে দেবী বললেন যে “একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট! মম্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ” অর্থাৎ আমিতো জগতে একাই। আমা ভিন্ন দ্বিতীয় নাই। ওরে দুষ্ট, দেখ এরা আমার বিভূতি (শক্তি), আবার আমাতেই প্রবিষ্ট হচ্ছে। তখন ব্রহ্মাণী, কৌমারী আদি অষ্টশক্তি দেবী চণ্ডীর দেহে লয়প্রাপ্ত হলেন এবং দেবী একাই অসুরের সম্মুখে রইলেন। পরিশেষে দেবী শুম্ভকে ভূমিতে পতিত করে শূল দ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তখন দেবতারা আনন্দ-উল্লাস করতে লাগলেন। 

দেবী দুর্মগার মধু-কৈটভ বধ 

এখন মধু-কৈটভ বধ প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রলয়কালে জগৎ যখন সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল তখন নারায়ণ শেষনাগের শয্যায় শায়িত হয়েছিলেন। মধু ও কৈটভ নামক দুই ভীষণ অসুর উদ্ভূত হয়ে বিষ্ণুর নাভিকমলে উপবিষ্ট ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গের জন্য যোগনিদ্রাকে (যোগমায়া) স্তুতি করলেন। যোগনিদ্রা তুষ্ট হলে তিনি বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ করেন। বিষ্ণু তখন অসুরদ্বয়ের সাথে বাহুযুদ্ধ করতে লাগলেন। পাঁচ হাজার বর্ষ যুদ্ধ করার পর মধু ও কৈটভ অসুরদ্বয় যোগমায়ার মায়ায় মোহিত হয়ে বিষ্ণুকে বলল, “তুমি আমাদের নিকট বর গ্রহণ কর”। তখন বিষ্ণু অসুরদ্বয়ের মৃত্যু-বর চাইলেন। অগত্যা অসুরদ্বয় যেখানে জল নেই এমন স্থানে তাদের বধ করতে বলল। তখন বিষ্ণু অসুরদের জঙ্ঘার উপরে রেখে তাদের মস্তক চক্র দ্বারা কেটে ফেললেন। এখানে এই অসুরবধে বিষ্ণু নিমিত্ত মাত্র। প্রকৃতপক্ষে যোগমায়াই অসুরদ্বয়কে মায়া দ্বারা বধ করেছেন। অসুররা মায়াবী এবং তমোগুণী, তাই তাদের বধ করতে মায়া প্রয়োজন। দেবী দুর্গাই মায়া দ্বারা জগৎকে আচ্ছন্ন করে আছেন। এজন্য তার নাম মহামায়া। বস্তুত সব মনুষের হৃদয়ে মায়াবী অসুরদের বাস। সে মায়াবী অসুরদের বধ করতে হলে অবশ্যই মহামায়ার শরণাপন্ন হতে হবে। মহামায়া যেমন মায়া দ্বারা মনুষকে আচ্ছন্ন করেন আবার তিনি তুষ্ট হলে মায়া দূর করেন এবং ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। যা হোক, দেবী উপরি-উক্ত অসুর ছাড়াও অন্ধক, বেত্র, কলিঙ্গ, দুর্গ প্রভৃতি অসুরদের বধ করেন। বরাহ পুরাণ মতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের শক্তি একত্রিত হয়ে এক দেবী উৎপন্ন হয় যিনি অন্ধকাসুরকে বধ করেন। বরাহ পুরাণের অন্যত্র আছে ব্রহ্মার স্তুতিতে তুষ্ট হয়ে দেবী যোগমায়া বেত্রাসুরকে বধ করেন। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে দেবগণের প্রার্থনায় ধুম ও অগ্নিজ্বালা রূপে শুক্লবসনা দেবী আবিভূর্ত হয়ে কলিঙ্গ নামক অসুরকে বধ করেন। 

নবদুর্গা

   পুরাণ শাস্ত্রে দুর্গার যে নয়টি রূপ উল্লেখ আছে তা হল শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চণ্ডঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়ণী, কালরাত্রী, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। এদেরকে একত্রে নবদুর্গা বলা হয়। শৈল অর্থ পর্বত। পর্বতরাজ হিমালয়ে ঘরে দুর্গা পুত্রী (কন্যা) রূপে শৈলপুত্রী নামে জন্মগ্রহণ করেন এবং কঠোর তপস্যা বলে ভগবান শিবকে পতি রূপে লাভ করেন। ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবগণকে ব্রহ্মের স্বরূপ প্রকাশ করার জন্য ব্রহ্মচারিণী আবিভূর্ত হয়েছিলেন। দেবতাদের নিকট ব্রহ্মজ্ঞান প্রকাশ করেছিলেন বলে তিনি ব্রহ্মচারিণী। তাঁর ঐ রূপটি হৈমবতী উমা নামেও পরিচিত। অসুর বধের জন্য দেবী প্রকটিতা হলে দেবরাজ ইন্দ্র দেবীকে একটি ঘণ্টা উপহার দিলেন, তখন দেবীর নাম হল চণ্ডঘণ্টা। সকল বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির সমষ্টি হল ঘণ্টা। ঐ ঘণ্টা ধ্বনি শুনে সব অশুভ শক্তি ভয়ে পলায়ন করে। উষ্মা অর্থ তাপ। কুষ্মা অর্থ কুৎসিত যে তাপ। আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপই হল কুষ্মা। যিনি কুষ্মা বহন করেন তিনি কুষ্মাণ্ডা। দেবী কুষ্মণ্ডারূপে সকল ত্রিতাপ জ্বালা ভক্ষণ করে উদরপূর্তী করেন। ফলে ভক্তগণ শন্তিলাভ করেন। কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ, সুতরাং দেবী যখন কার্তিকের মাতা হয়েছিলেন তখন তিনি স্কন্দমাতা নামে খ্যাতা হয়েছিলেন। ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে সর্বদেবতার তেজে যে দেবীর উদ্ভব হয়েছিল সে দেবীই কাত্যায়ণী। মূলত যোগনিদ্রা বা যোগমায়াই কালরাত্রী। কালরাত্রীতে বিষ্ণু নিদ্রাচ্ছন্ন থাকেন এবং দেবী জগতের লয় করেন। পুরাণ মতে দেবী কালিকা তপস্যার দ্বারা কালো বর্ণ ত্যাগ করে গৌরবর্ণ ধারণ করেন, তখন তাঁর নাম হয় মহাগৌরী। দেবী যে রূপে সাধককে সিদ্ধি দান করেণ সে রূপের নাম সিদ্ধিদাত্রী। 

দুর্গার অবতার

চণ্ডীতে দেবী দুর্গা নিজের মুখেই বিন্ধ্যপর্বতবাসিনী, রক্তদন্তিকা, শতাক্ষী শাকম্বরী, দুর্গা, ভীমা এবং ভ্রামরী রূপে আবির্ভূত হওয়ার কথা বলেছেন। আছে- চণ্ডীতে অষ্টবিংশ যুগে বৈবস্বত মন্বন্তরে দেবী দুর্গা নন্দগোপের গৃহে যশোদা দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন এবং শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করবেন। দুর্গা বিপ্রচিত্তি বংশীয় অসুরগণকে বধ করার জন্য পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন এবং অসুরগণকে ভক্ষণ করার কারণে তাঁর দন্তগুলো ডালিম ফুলের মত রক্তবর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য দুর্গা রক্তদন্তিকা নামে পূজিতা হবেন। পুনরায় শতবর্ষ ধরে অনাবৃষ্টি এবং জলাভাব ঘটলে মুনিগণের প্রার্থনায় দুর্গা অযোনিসম্ভবা হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণা হবেন। তখন তিনি শতনয়নে মুনিগণকে দেখবেন বলে তাঁকে শতাক্ষী নামে ডাকা হবে। অনাবৃষ্টির কারণে যখন দুর্ভক্ষ দেখা দেবে, তখন দুর্গা দুর্দশাগ্রস্ত মানবগণকে নিজ দেহ থেকে উৎপন্ন প্রাণ-ধারক শাক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন। এজন্য তিনি শাকম্বরী নামে খ্যাতা হবেন। সে সময় দুর্গা দুর্গম্ নামক এক মহাসুরকে বধ করে দুর্গা নামে পরিচিতা হবেন। পুনরায় দুর্গা হিমালয়ে মুনিগণের রক্ষার জন্য ভীষণা মূর্তি ধারণ করে রাক্ষসদের বধ করবেন। তখন তাঁকে ভীমা নামে ডাকা হবে। যখন অরুণ নামক এক অসুর ত্রিলোকে উৎপাত সৃষ্টি করবে, তখন দুর্গা ভ্রমরময় ভ্রমরের রূপ ধারণ করে ঐ মহাসুরকে বধ করবেন। এজন্য দুর্গা ভ্রামরী নামে খ্যাতা হবেন। (আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” নামক গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য নিচের <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন