7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

২৭ ডিসেম্বর, ২০২১

বৈদিক যজ্ঞ

যজ্ঞ কি

    দেবতার উদ্দেশ্যে প্রিয়বস্তু দান বা উৎসর্গ করাকে যজ্ঞ বলে। স্বর্গলাভ, পুণ্য-অর্জন, ধনলাভ, রোগমুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে যজ্ঞ করা হয়। তবে প্রাচীনকালে আর্য ঋষিগণ শুধুমাত্র স্বর্গপ্রাপ্তির আশায় যজ্ঞ করতেন না। যজ্ঞ করার আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। মূলত যজ্ঞের মাধ্যমেই তাঁরা দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তাঁরা দেবতাদের সন্তুষ্টি-বিধানের জন্য নিজেদের প্রিয়বস্তুকে যজ্ঞের মাধ্যমে উৎসর্গ করতেন। যা হোক, যজমান ও পুরোহিতের মাধ্যমে যজ্ঞকর্ম সম্পাদিত হয়ে থাকে। যাঁর কল্যাণ কামনায় যজ্ঞ করা হয় তাকে যজমান বলে। যিনি মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক সমগ্র যজ্ঞ সম্পাদন করেন তাঁকে ঋত্বিক বা পুরোহিত বলে। 

বৈদিক যজ্ঞের উপকরণ

   যজ্ঞের প্রধান উপকরণের মধ্যে রয়েছে অগ্নি, বেদি, সমিধ (কাষ্ঠ), ঘৃত, সোম-রস, পুরোডাশ (শস্যচূর্ণ দ্বারা প্রস্তুতকৃত রুটি), দর্বী (হাতা) প্রভৃতি। 

বৈদিক যজ্ঞের অগ্নি

প্রথমেই অগ্নি প্রসঙ্গে আসা যাক। অধিকাংশ দেবতা অন্তরীক্ষে বাস করেন এবং তাঁদেরকে কাছে পাওয়া দুষ্কর। তাই মর্তে্যর সহজলভ্য দেবতা অগ্নিকে সর্ব দেবতার প্রতিনিধি কল্পনা করে অগ্নিতেই ঘৃত, সোমরস প্রভৃতি উৎসর্গ করা হয়। অগ্নি যেন দেবতাদের মুখ স্বরূপ। অগ্নি হব্য (ঘৃত প্রভৃতি দ্রব্য) দেবতাদের নিকট পৌঁছে দেন। অগ্নির তিনটি রূপ, যথা গার্হপত্য, আহবনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি। সর্বদা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকে গার্হপত্য অগ্নি বলে। গার্হপত্য অগ্নি থেকে চয়নকৃত বা গৃহীত হব্যভোজী অগ্নিকে আহবনীয় অগ্নি বলে। যজ্ঞবেদির দক্ষিণে স্থাপিত অগ্নিকে দক্ষিণাগ্নি বলে। দক্ষিণাগ্নিও গার্হপত্য অগ্নি থেকে চয়ন করা হয়। গার্হপত্য অগ্নিতে হব্য বস্তু প্রস্তুত করা হয়, আহবনীয় অগ্নিতে হব্য আহুতি দেয়া হয় এবং দক্ষিণাগ্নিতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কব্য আহুতি দেয়া হয়। আহবনীয় অগ্নি পূর্বদিকে স্থাপন করলে গার্হপত্য অগ্নি পশ্চিমদিকে এবং দক্ষিণাগ্নি দক্ষিণদিকে স্থাপন করতে হয়। গার্হপত্য অগ্নির বেদি গোলাকার, আবহনীয় অগ্নির বেদি চতুষ্কোণ আকৃতির এবং দক্ষিণাগ্নির বেদি অর্ধচন্দ্রাকৃতির হয়ে থাকে। গার্হপত্য মূলত অগ্নি গৃহস্থের প্রতিনিধি স্বরূপ এবং এই অগ্নি সব সময় প্রজ্জ্বলিত রাখতে হয়।

যজ্ঞ

     অগ্নি প্রজ্জ্বলন করার জন্য মাটি খনন করে বেদি বা কুণ্ড (অগ্নিস্থান) নির্মাণ করা হয়। যজমানের চিবুক থেকে মুখ পর্যন্ত যতটুকু হয় ততটুকু মাটি খনন করা বিধেয়। বেদির পাঁচটি স্তর থাকে। যজ্ঞবেদির একটি গভীর তৎপর্য রয়েছে। যজ্ঞবেদি অন্তরিক্ষলোক, উখা (পাক করার চুলা) নির্মাণ জগৎসৃষ্টি এবং ইষ্টক (ইট) নিমার্ণ প্রজা সৃষ্টির সাথে তুল্য। অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করার কাষ্ঠকে সমিধ বলে। সমিধ লম্বায় এক বিঘত এবং বুড়ো আঙ্গুলের মত মোটা হতে হয়। যজ্ঞের সমিধ হিসেবে পলাশ, অশ্বত্থ, যজ্ঞডুমুর প্রভৃতি বৃক্ষের কাষ্ঠ প্রসিদ্ধ।

বৈদিক যজ্ঞের হবি

    যজ্ঞীয় দ্রব্যের সারবস্তুই ঘৃত। “ঘৃত” শব্দের আক্ষরিক অর্থ উজ্জ্বল জ্যোতি। তাই ঘৃত হৃদয়ের উজ্জ্বল জ্যোতির প্রতীক স্বরূপ। অগ্নিতে ঘৃত প্রদান করলে যজ্ঞকারীর হৃদয়ের উজ্জ্বল জ্যোতি যেন অগ্নির উজ্জ্বল জ্যোতিতে মিলিয়ে যায় এবং এই জ্যোতির দ্বারা অসুরদের বিনাশ হয়। শুধু যজ্ঞে বিঘ্ন উৎপাদনকারী অসুর নয় অন্তরের ষড়-রিপু নামক অসুরও বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাই অগ্নিতে ঘৃত উৎসর্গ করলে দেবতাগণও সন্তুষ্ট হন এবং সেই সাথে মনও নির্মল হয়। প্রাচীনকালে সোমরস ছিল যজ্ঞের মুখ্য উপকরণ। সোম নামক এক প্রকার লতাকে পেষণ করে যে রস প্রস্তুত করা হত, তাই সোমরস। চন্দ্র দেবতার অপর নাম সোম। চন্দ্র বা সোম দেবতা হলেন মনের অধিপতি। বস্তুত সোমরসকে বিশুদ্ধ মনের প্রতীক কল্পনা করা হয়। তাই অগ্নিতে সোমরস প্রদান করার অর্থ বিশুদ্ধ মনকে দেবতার উদ্দেশ্যে সমার্পণ করা। শুদ্ধ মনে যজ্ঞ করা একান্ত আবশ্যক। কারণ শুদ্ধ মনে যজ্ঞ না করলে সে যজ্ঞ সুফলের পরিবর্তে কুফল প্রদান করে। সোমরস মনের পরিশুদ্ধতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। 

বৈদিক যজ্ঞে আহুতি

    ঘৃত, সোমরস প্রভৃতি আহুতি দেওয়ার জন্য যে হাতা ব্যবহার করা হয়, তাকে দর্বী বলে। চরু এবং শস্যচূর্ণ দ্বারা তৈরী পুরোডাশ (পিঠা বা পরোটা) আর্যদের খুব প্রিয় ছিল বলে ঐসব দ্রব্যও অগ্নিতে উৎসর্গ করা হত। পশুযাগে দেবতাদের অজ (ছাগ), অশ্ব, মহিষ প্রভৃতি পশু উৎসর্গ করা হয়। যজ্ঞীয় দ্রব্য উৎসর্গ করার পূর্বে ঐ দ্রব্য মন্ত্র দ্বারা শোধন করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক অগ্নিতে হব্য প্রদান করাকে আহুতি বলে। আহুতি বলতে আত্মাহুতি বা আত্ম-বলিদান বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে দেবতাদের উদ্দেশ্যে আত্মা বা মনকে সমাপর্ণ করাই যজ্ঞের মূল উদ্দেশ্য।

বৈদিক যজ্ঞের পুরোহিত    

    এবার যজ্ঞের পুরোহিত প্রসঙ্গে আসা যাক। যে ব্রাহ্মণ দ্বারা যজ্ঞ পরিচালিত হয় সে ব্রাহ্মণকে পুরোহিত বলে। যজ্ঞের পুরোহিতকে ঋত্বিকও বলা হয়। “ঋতু” থেকে ঋত্বিক শব্দ গঠিত। যিনি ঋতু সম্পর্কে জানেন, তিনিই ঋত্বিক। প্রাচীনকালে ঋতু অনুসারে যজ্ঞ আরম্ভ হত। তাই যজ্ঞ সম্পাদনকারী পুরোহিতের ঋতু সম্পর্কে জানা আবশ্যক। যজ্ঞের মূল পুরোহিত চার জন, যথা হোতা, উদ্গাতা, অধ্বযুর্ এবং ব্রহ্মা। হোতা হলেন ঋগ্বেদীয় পুরোহিত এবং তিনি ঋগ্বেদ সংহিতার মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক দেবতাগণকে আহবান করেন। সামবেদীয় পুরোহিত উদ্গাতা সামবেদ সংহিতার মন্ত্র সুর করে পাঠ করেন। এরকম সুর করে পাঠ করাকে উদ্গান বা সামগান বলে। যজুর্বেদীয় পুরোহিত অধ্বযুর্ যজ্ঞের বেদি নির্মাণ, ঘৃতাদি যজ্ঞীয় দ্রব্য প্রস্তুত, আহুতি প্রদান প্রভৃতি যজ্ঞ সংশ্লিষ্ট সকল কার্য সম্পাদন করেন। ব্রহ্মা নামক পুরোহিত ত্রিবেদীয় অর্থাৎ ঋক্, সাম ও যজুঃ এই তিন বেদ সম্পর্কেই তাঁর জ্ঞান রয়েছে। ব্রহ্মা সমস্ত যজ্ঞকর্মটি পরিচালনা করেন এবং সব কিছু তত্ত্বাবধান করেন। ব্রহ্মা যজ্ঞকর্মের প্রধান পুরোহিত এবং হোতা উদ্গাতা ও অধ্বযুর্ থেকে অধিক সম্মানিত পুরোহিতও বটে। যজ্ঞকর্মে কোন ভুলত্রুটি বা বৈগুণ্য ঘটলে তার জন্য তিনিই দায়ী হবেন। মৈত্রাবরুণ, অচ্ছাবাক ও গ্রাবস্তুৎ এই তিনজন হলেন হোতার সহকারী পুরোহিত। উদগাতার সহকারী পুরোহিতগণ হলেন প্রস্ত্যেতা, পতিহর্তা ও সুব্রহ্মণ্য। অধ্বযুর্র সহকারী পুরোহিতগণ হলেন প্রতিপ্রস্থতা, নেষ্টা ও উন্নেতা। ব্রহ্মার সহকারী পুরোহিতগণ হলেন ব্রহ্মণাচ্ছংসী, অগ্নীদ্র ও পোতা। মূল চার জন্য পুরোহিত এবং তাদের সহকারী বার জন পুরোহিত নিয়ে মোট ষোল জন পুরোহিতের মাধ্যমে যজ্ঞ সম্পাদিত হয়। তবে কৌষীতকি ব্রাহ্মণ অনুসারে ঐ ষোলজন পুরোহিত ছাড়াও সদস্য নামে একজন পুরোহিত থাকে। যজ্ঞ শুরুর পূর্বে যজমানকে ঋত্বিক-বরণ করতে হয় এবং যজ্ঞের শেষে ঋত্বিকগণকে যথাসাধ্য দক্ষিণা প্রদান করতে হয়। দক্ষিণা প্রদান না করলে যজ্ঞকর্ম সম্পূর্ণ হয় না। দক্ষিণা প্রধানত চার প্রকার, যথা স্বর্ণ, গো, বস্ত্র এবং অশ্ব। তবে পুরুষমেদ যজ্ঞে যজমান সর্বস্ব দান করে যজ্ঞ শেষে বনে গমন করতেন। যজ্ঞের সময় যজমানের জলপান করে ক্ষুধা নিবারণ করাই শ্রেয়। কারণ শস্য দ্বারা তৈরি অন্ন ভোজনে ইন্দ্রিয় তৃপ্তি ঘটে এবং উপবাসে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। জলপান করলে ভোজনও হয় না আবার ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। তাই যজ্ঞের সময় উপবাস করে দেহকে কষ্ট না দিয়ে জলপান করা আবশ্যক।

বৈদিকযজ্ঞ কত প্রকার

   যজ্ঞ প্রধানত পাঁচ প্রকার, যথা হোম, ইষ্টি, পশু, সোম ও সত্র। যজ্ঞ বিকৃত বা রূপান্তরিত হয়ে যে সব যজ্ঞ সৃষ্টি হয়, তাকে বিকৃতি বা অঙ্গযাগ বলে এবং যে যজ্ঞ প্রধান বা যে যজ্ঞের বিকৃতি বা রূপান্তর ঘটে বিকৃতি যাগ সৃষ্টি হয়, তাকে প্রকৃতি বা প্রধান যাগ বলে। হোমের প্রকৃতি অগ্নিহোত্র, ইষ্টির প্রকৃতি দর্শপূর্ণমাস, পশুযাগের প্রকৃতি দক্ষ প্রাজাপত্য পশু, সোমযাগের প্রকৃতি অগ্নিষ্টোম এবং সত্রযাগের প্রকৃতি গবাময়ন। নিচে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল।

হোম যজ্ঞ

   এই যাগে দর্বী বা হাতার মাধ্যমে ঘৃত আহুতি দেয়া হয় বলে এ যাগকে দর্বী হোমও বলা হয়। প্রতিদিন প্রাতঃকালে এবং সন্ধ্যাকালে অগ্নিতে দুধ, ঘৃত, দধি, পুরোডাশ প্রভৃতি উৎসর্গ করে এই যাগ করা হয়। প্রাতঃকালে সূর্যের উদ্দেশ্য এবং সন্ধ্যাকালে অগ্নির উদ্দেশ্যে যজ্ঞীয় দ্রব্য প্রদান করা হয়। অগ্নিহোত্র নামক যজ্ঞ থেকে হোম যজ্ঞের উৎপত্তি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বশ্যের অর্থাৎ দ্বিজাতির প্রতিদিন হোম যজ্ঞ করা কর্তব্য। তবে ব্রাহ্মণের জন্য হোম-যাগ বাধ্যতামূলক। হোম যজ্ঞ স্বয়ং যজমানকে করতে হয় অর্থাৎ এই যাগে পুরোহিতের প্রয়োজন নেই। তবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ নিজে করতে অসমর্থ হলে পুরোহিত দ্বারা এ যাগ সম্পাদন করতে পারেন। হোম যজ্ঞ সস্ত্রিক করা বিধেয়। এজন্য কুমার ও বিপত্নীকদের এই যাগে অধিকার নেই। এই যাগে প্রাতেঃ “সূর্যঃ জ্যোতিঃ জ্যোতিঃ সূর্যঃ” এবং সন্ধ্যায় “অগ্নির্জে্যাতিঃ জ্যোতিরাগ্নিঃ” প্রভৃতি মন্ত্র পাঠ করতে হয়। তবে সূর্য অগ্নির সাথে প্রজাপতির উদ্দেশ্যেও হোম করা বিধেয়। হোম যজ্ঞের প্রকৃতি অগ্নিহোত্র যজ্ঞ অগ্নিহোত্র যজ্ঞে দুধ সংগহের জন্য একটি গাভী পালন করা হয়। ঐ গাভীকে অগ্নিহোত্রী গাভী বলে। অগ্নিহোত্র যজ্ঞের হাতার নাম অগ্নিহোত্রবনী। প্রাতেঃ হোম করার ক্ষেত্রে দুটি মত প্রচলিত। বহবৃচ শাখার ব্রহ্মাণগণ সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং তৈত্তিরীয় শাখার ব্রাহ্মণগণ সর্যোদয়ের পরে হোম করেন। সূর্যোদয়ের পূর্বে গার্হপত্য অগ্নি হতে অগ্নি চয়ন করে অগ্নিহোত্রের হোমকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করা আবশ্যক। যজমান ব্রাহ্মণ অসুস্থ থকলে পুত্র বা অন্য পুরোহিতের মাধ্যমে হোম করাতে পারবেন। তবে পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার দিন যজমান ব্রাহ্মণ অসুস্থ থাকলেও তাঁকে হোম করতে হবে।

ইষ্টি যজ্ঞ

    ইষ্টি যজ্ঞের প্রকৃতি-যাগের নাম দর্শপৌর্ণমাস। দর্শ অর্থ সূর্য ও চন্দ্রের সঙ্গম অর্থাৎ অমাবস্যা। পৌর্ণমাসী অর্থ পূর্ণিমা। আমাবস্যা ও পূর্ণিমায় যে যজ্ঞ করা হয়, তাকে দর্শপৌর্ণমাস বলে। অবিবাহিত ও বিপত্নীকগণ এ যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারবেন না। অমাবস্যায় দুই দিন এবং পূর্ণিমার দুই দিন এই ইষ্টি যজ্ঞ করতে হয়। পূর্ণিমা থেকে এই যজ্ঞের শুরু করতে হয় অর্থাৎ অমাবস্যা থেকে যজ্ঞ শুরু করা যায় না। এই যজ্ঞে ষোল জন পুরোহিতই প্রয়োজন। এ যজ্ঞে প্রধানত তিনটি আহুতি প্রদান করা হয়। অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে পুরোডাশ দ্বারা প্রথম আহুতি দেয়া হয়। বিষ্ণু প্রজাপতি, অগ্নি ও সোম এই চার দেবতার যে কোন একজন দেবতার উদ্দেশ্যে দধি দ্বারা দ্বিতীয় আহুতি দেয়া হয়। অগ্নি ও সোম দেবতাকে একত্রে দুগ্ধ দ্বারা তৃতীয় আহুতি দেয়া হয়। ইষ্টি যজ্ঞের শেষ সময়ে অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে অগ্নিস্বিষ্টকৃৎ নামক আহুতি দিতে হয়। তারপর যজ্ঞের আহুতি-কার্য সম্পন্ন করার পর যে দুগ্ধ, দধি, পুরোডাশ প্রভৃতি হব্য-দ্রব্য থেকে যায়, তা একত্রে মিশ্রিত করে ভক্ষণ করা হয়। এই অবশিষ্ট হব্য-দ্রব্য ভক্ষণকে ইড়া-ভক্ষণ বলে। ইড়া-ভক্ষণের পর একটি কুশপ্রস্তর নামক কুশ নির্মিত মূর্তি যজ্ঞাগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। ঐ কুশ নির্মিত মূর্তি মূলত যজমানের প্রতীক। মূর্তিটি অগ্নিতে পুড়ে যখন ভস্মে পরিণত হয়, তখন যজমান মনে করেন যে, তাঁর নশ্বর দেহ দগ্ধ হয়েছে এবং যজ্ঞের মাধ্যমে তাঁর আত্মা দেবতার সাযুজ্য লাভ করেছে অর্থাৎ দেবতার সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। ইষ্টি যজ্ঞ দুই ধরণের, যথা নিত্য এবং কাম্য। কোনও কিছু কামনা করে যে ইষ্ট যজ্ঞ করা হয়, তাকে কাম্য ইষ্টি যজ্ঞ বলে। এবং কোন কামনা না করে নিয়মিত পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় যে ইষ্টি-যজ্ঞ করা হয় তাকে নিত্য ইষ্ট যজ্ঞ বলে। এছাড়াও পুত্র কামনায় পুত্রেষ্টি, অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি আনার জন্য কারীরি-ইষ্টি, শস্যক্ষেত্রের প্রথম শস্য বা বৃক্ষের প্রথম ফল দেবতাকে অপর্ণ করার জন্য আগ্রায়ণ ইষ্টি প্রভৃতি যজ্ঞ প্রচলিত রয়েছে।

পশু যজ্ঞ

   পশু যজ্ঞকে নিরূঢ় পশুবন্ধও বলা হয়। পশু-যাগের প্রকৃতি দৈক্ষ বা প্রাজাপত্য পশু। পশু যজ্ঞ বছরে দুই থেকে ছয় বার পর্যন্ত করা যায়। পশু যজ্ঞ এক বার করলে বর্ষাকালে, দুই বার করলে দক্ষিণায়ণ ও উত্তরায়ণের সময় এবং ছয় বার করলে ছয় ঋতুর প্রত্যেক ঋতুতে এক বার করতে হয়। পশু যজ্ঞে সাধারণত ছাগকেই আহুতি দিতে হয়। ছাগের হৃদপিণ্ড, বপা (মেদ বা চর্বি) প্রভৃতি অগ্নিতে আহুতি দেয়া হয়। পশু যজ্ঞে যে ছয় জন পুরোহিতের প্রয়োজন, যথা অধ্বযুর্, প্রতিপ্রস্থাতা, হোতা, মৈত্রাবরুণ, অগ্নি ও ব্রহ্মা। পশু যজ্ঞে পশুবন্ধন করার জন্য পলাশ, খদির, বিল্ব ও রোহিতক এই চার প্রকার বৃক্ষের যে কোন একটি বৃক্ষের কাষ্ঠ দিয়ে যুপ নির্মাণ করা হয়। যজ্ঞ বেদির পূর্ব প্রান্তে যূপকাষ্ঠ স্থাপন করতে হয়। দৈহিক ত্রুটি বর্জিত পুরুষ ছাগ অর্থাৎ পাঠাই যজ্ঞের জন্য প্রয়োজন। ছাগটিকে বধের পূর্বে উপকারণ করা হয়। মন্ত্রপূত ছাগকে প্লক্ষবৃক্ষের শাখা দ্বারা ষ্পর্শ করে “অগ্নয়ে ত্বা জুষ্ট মুপাকরোমি” মন্ত্র পাঠ করাকে উপকারণ বলে। বলির পশুটিকে শ্বাসরোধ করে বধ করতে হয়। যজ্ঞ বেদির উত্তরপূর্ব দিকে শামিত্র স্থানে পশুর ব্যবচ্ছেদ এবং হাড় থেকে মাংস পৃথক প্রভৃতি কার্য করা হয়। একটি মাটির পাত্রে পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শামিত্র নামক বহ্নিকুণ্ডে (চুলায়) পাক করা হয়। পাককার্য চলাকলে যজ্ঞের অগ্নিতে পুরোডাশ আহুতি দেয়া হয়। পাক শেষে অধ্বযুর্ আমক পুরোহিত আহবনীয় অগ্নিতে আহুতি দেন। পশু যজ্ঞে পশুকে আহুতি দিলে সে পশুর আত্মা দেবতার সাথে লীন হয়ে যায়। আহুতির পর অবশিষ্ট পশুর মাংস কেউ কেউ ভক্ষণ করে আবার কেউ কেউ ভক্ষণ করে না। যারা ভক্ষণ করেন না, তাদের মতে পশু যজমানের প্রতীক। যজমান পশুর মাধ্যমে নিজেকেই আহুতি দিয়ে দেবত্ব লাভ করেন। তাই পশু-মাংস ভক্ষণ করলে তা যজমানের নিজের মাংস ভক্ষণতুল্য হবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পশু যজ্ঞের অধিকারী অর্থাৎ শুদ্রের পশু যজ্ঞের অধিকার নেই।

 সোম যজ্ঞ

    সোম যজ্ঞের প্রকৃতি অগ্নিষ্টোম বা জ্যোতিষ্টোম। সোম যজ্ঞের বারটি স্তোত্র-গীতের শেষ স্তোত্রটির নাম অগ্নিষ্টোম এবং এই শেষ স্তোত্রটির নাম অনুসারে সত্র যজ্ঞের নাম অগ্নিষ্টোম হয়েছে। সোম যজ্ঞে ষোল জন ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সোম যাগের অধিকার রয়েছে। বর্তমানে সোমলতা পাওয়া যায় না। সে কালেই সোমলতা দুষ্পাপ্য ছিল। সেজন্য সোমলতার অভাবে পূতিকা নামক লতার রস আহুতি দেয়ার বিধান ছিল। যজ্ঞের প্রথম দিন পুরোহিতদের অভিনন্দন জানিয়ে এবং দক্ষিণার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঋত্বিক-বরণ করা হত। দ্বিতীয় দিন প্রাতেঃ প্রায়ণীয় ইষ্টির মাধ্যমে যজ্ঞ শুরু করা হত। যে ইষ্টি দ্বারা যজ্ঞ আরম্ভ হয়, তাই প্রায়ণীয় ইষ্ট। প্রায়ণীয়েষ্টিতে পথ্যাস্বস্তি, অগ্নি, সোম, সবিতা ও অদিতি এই পাঁচ জন দেবতাকে আবাহন করা হত। অদিতির উদ্দেশ্যে পুরোডাশ এবং অপর চারজন দেবতার উদ্দেশ্যে আজ্য আহুতি দেয়া হত। আজ্য বলতে গলিত ঘৃত বোঝায় এবং ঘৃত বলতে মূলত ঘনীভূত ঘৃতই বোঝায়। এক বছর বয়স্ক বাছুর, স্বর্ণ, ছাগী, বাছুর সহ গাভী, ষাঢ়, বলদ, এঁড়ে ও বকনা বাছুর এবং এই দশ দ্রব্যের মাধ্যমে শুদ্রের নিকট সোমলতা ক্রয় করা হত। পুরোহিতগণ বলদ-বাহিত শকটে করে সোমলতা যজ্ঞস্থলে নিয়ে আসত। অতিথি সোমলতার উদ্দেশ্যে আতিথ্যেষ্টি নামক যজ্ঞ করা হত। তৃতীয় দিন যজ্ঞস্থলের পূর্বদিকে প্রাগবংশ বা প্রাচীনবংশ নামক একটি মহাবেদি নির্মাণ করা হত। চতুর্থ দিনে অগ্নি ও সোম দেবতার উদ্দেশ্যে একটি পশু-যাগ করা হত। তারপর সোমকে দক্ষিণদিকে নির্মিত হবির্ধান নামক বেদিতে নিয়ে যাওয়া হত। পঞ্চম দিনে অর্থাৎ শেষ দিনে সোমরস নিষ্কাশন করতে হত। সোমরস নিষ্কাশনকে সোম অভিষব বা সোম-সবন বলে। সূর্যোদয়ের পূর্বে পুরোহিতগণ সোমলতাকে একটি প্রস্তর-খণ্ডের উপর রেখে বসতীবারী নামক জল ছিটাতেন। অপর একটি প্রস্তর-খণ্ড দ্বারা সোমলতা থেঁতলিয়ে রস বের করে গ্রহ নামক পাত্রে ঐ সোমরস রাখা হত। পরে সোমরস, মেষলোম বা ছাগচর্ম নির্মিত দশাপবিত্র নামক ছাঁকনীর সাহায্যে ছেকে দ্রোণ-কলস নামক পাত্রে ঐ রস রাখা হত। প্রত্যেক দিন প্রাতেঃ, মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায় সোমরস নিষ্কাশন করা হত এবং এই তিন সবনকে যথাক্রমে প্রাতঃসবন, মাধ্যন্দিন-সবন এবং তৃতীয় সবন বলা হত। আহুতি দেয়ার পর অবশিষ্ট সোমরস যজমান ও পুরোহিত চামস বা হাতার সাহায্যে পান করতেন। মাধ্যন্দিন সবনের পর পুরোহিতকে দক্ষিণা স্বরূপ গরু, অশ্ব, গাধা, ছাগল, মেষ, তিল, মসুর, মাষকলাই, ধান, যব প্রভৃতি দেয়া হত। তৃতীয় সবনের পর অবভূথ স্নান করা হত। অবভূত স্নানের সময় জলাশয়ে বরুণ দেবতার উদ্দেশ্যে জলে পুরোডাশ অর্পণ করা হত। স্নান শেষে যজমান ও তাঁর পত্নী ব্রাহ্মণ প্রদত্ত নতুন বস্ত্র পরিধান করতেন। তারপর উদয়নীয় নামক এক প্রকার ইষ্টির মাধ্যমে যজ্ঞ শেষ হত। উদয়নীতে দুধ, মধু, দধি, শর্করা প্রভৃতির মিশ্রণে তৈরি চরু আহুতি দেয়া হত।

সত্র যজ্ঞ 

    যে যজ্ঞ একদিনে সম্পন্ন হয় তাকে একাহ, যে যজ্ঞ সম্পন্ন করতে একদিনের অধিক কিন্তু দ্বাদশ দিনের কম সময় লাগে তাকে অহীন এবং যে যজ্ঞ সম্পন্ন করতে দ্বাদশ দিনের অধিক সময় লাগে তাকে সত্র যজ্ঞ বলে। সত্র যজ্ঞের কোনটি একবর্ষব্যাপী, কোনটি দশবর্ষব্যাপী, কোনটি একশতবর্ষব্যাপী এবং কোনটি সহস্র-বর্ষব্যাপীও করা হত। সত্র যজ্ঞের প্রকৃতি গবাময়ন নামক যজ্ঞ। কথিত আছে, পুরাকালে গরুরা শৃঙ্গবিহীন ছিল। তারা শৃঙ্গ লাভের আশায় গবাময়ন-যজ্ঞ করেছিল। দশমাস পরে তাদের মস্তকে শৃঙ্গ উৎপন্ন হয়েছিল। গরু কতৃর্ক সম্পাদিত যজ্ঞই গবাময়ন-যজ্ঞ। গবাময়ন-যজ্ঞ করতে একবৎসর (৩৬১ দিন) সময় লাগত। সত্র যজ্ঞের সম্পাদন কালকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা প্রথমার্ধে ১৮০ দিন, দ্বিতীয়ার্ধে ১৮০ দিন এবং উভয় অর্ধের মধ্যে বিষয় নামক এক দিন। সত্র-যাগেও সোমলতার রস আহুতি দেয়া হত। সত্র যজ্ঞের মধ্যে ষড়হ (ছয় দিনে নিষ্পন্ন যাগ) রয়েছে। ষড়হের প্রথমদিনে জগতিষ্টোম, দ্বিতীয় দিনে গোষ্টোম, তৃতীয় দিনে আয়ুষ্টোম, চতুর্থ দিনে গোষ্টোম পঞ্চমদিনে আয়ুষ্টোম এবং ষষ্ঠ দিনে জ্যোতিষ্টোম পাঠ করা হত। ৩৬০ দিনের কম কিন্তু একাদশ দিনের অধিক কালব্যাপী যে যজ্ঞ সম্পাদিত হয়, তাকে দ্বাদশাহ বলে। সত্রের মত দ্বাদশাহ যজ্ঞেও প্রথম ও শেষ দিনে অতিরাত্র যাগ অনুষ্ঠিত হত। দ্বাদশাহ সম্পাদিত হতে ছত্রিশ দিন লাগত। প্রথম দ্বাদশ দিনে দীক্ষা, তার পরবর্তী দ্বাদশ দিনে উপসদ্ এবং শেষ দ্বাদশ দিনে সুত্যা অনুষ্ঠিত হত। দ্বাদশাহ প্রধানত দুই প্রকার, যথা ভরত-দ্বাদশাহ এবং ব্যূঢ়-দ্বাদশাহ। ভরত-দ্বাদশাহে প্রথম ও দ্বাদশ দিনে অতিরাত্র, দ্বিতীয় ও একদাশ দিনে অগ্নিষ্টোম এবং অবশিষ্ট দিন গুলোতে উকথ্য অনুষ্ঠিত হত। শেষ অতিরাত্রের আগের দিনকে মহাব্রত বলা হত। ব্যূঢ়-দ্বাদশাহে প্রথম ও শেষ দিন অতিরাত্র এবং দ্বিতীয় থেকে সপ্তম দিন পৃষ্ঠ-ষড়হ অনুষ্ঠিত হত। দশম দিনে অবিবাক্যম এবং অষ্টম, নবম ও একাদশ দিনে ছন্দোম অনুষ্ঠিত হত।

    পূবোক্ত পাঁচ প্রকার যজ্ঞ ছাড়াও রাজতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু যজ্ঞ রয়েছে, যথা রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেদ, বৃহস্পতিসব প্রভৃতি। রাজাসূয় যজ্ঞ করে রাজা, বাজপেয় যজ্ঞ করে সম্রাট এবং অশ্বমেদ যজ্ঞ করে সার্বভৌম নৃপতি হওয়া যায়। নিচে এসব যজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হল।

রাজসূয় যজ্ঞ

রাজসূয় যজ্ঞ তিনটি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হত। প্রথম পর্যয়ে প্রারম্ভিক যাগ-যজ্ঞ, দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজ-অভিষেক এবং তৃতীয় পর্যায়ে অভিষেকোত্তর অনুষ্ঠান সম্পন্ন হত। পবিত্র নামক অনুষ্ঠানের দ্বারা রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়ে একবছর ব্যাপী বিভিন্ন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। রাজসূয় যজ্ঞে ষষ্ঠী থেকে আটটি যাগ সম্পাদন করতে হত। ঐ সব যাগে অনুমিতি, নিঋর্তি, গার্হপত্য অগ্নি, অদিতি, বিষ্ণু, ইন্দ্র, সোম ও সরস্বতীর উদ্দেশ্যে হবি দিতে হত। রাজাকে ঋত্বিক, রাজন্য, রাজমহিষী, সেনাপতি, সারথি, গ্রাম্য নেতা, মন্ত্রী, কোষাধ্যক্ষ, কর আদায়কারী, দ্যুতকর এবং যজমানের গৃহে গিয়ে আহুতি প্রদান করতে হত। এসব যাগ সম্পন্ন হওয়ার পর রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে হত। অভিষেক অর্থ জল দ্বারা সিঞ্চন স্নান করানো। অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে পাঁচ দিন লাগত। অনুষ্ঠানের শুরুতে অগ্নি, সোম, সবিতা, রুদ্র, বৃহস্পতি, ইন্দ্র, মিত্র এবং বরুণ এই আট জন দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেয়া হত। রাজার অভিষেক বা স্নান করানোর জন্য নদীর জল, কূপের জল, স্থাবর জল, নীহার জল প্রভৃতি সংগ্রহ করা হত। অধ্বযুর্ রাজাকে একটি ধনুক ও তিনটি শর বা তির প্রদান করতেন। ধনুক মূলত রাজশক্তি ও শাসনকার্যের প্রতীক। তারপর রাজা রথ আহরণের পর পট্টবস্ত্র ও স্বর্ণমুকুট পরিধান করে ব্যঘ্রচর্মে ঢাকা সিংহাসনে বসতেন। রাজার মাথার উপর এবং পায়ের নিচে সোনার থালা রাখা হত। রাজা তিন বার পা ফেলে মর্ত্য, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গ জয় করেছেন এরকম মনে করতেন। অভিষেকের পর দশম দিনে দশপেয় নামক একটি সোমযাগ অনুষ্ঠিত হত। এক বৎসর পর্যন্ত রাজাকে নানা ব্রত পালন করতে হয় এবং তাঁকে ক্ষৌরকর্ম থেকে বিরত থাকতে হত। রাজসূয় যজ্ঞে পুরোহিতকে দক্ষিণা স্বরূপ গরু, স্বর্ণ, দর্পণ, স্বর্ণমাল্য, স্বর্ণালঙ্কার, বস্ত্র, যবপূর্ণ শকট (রথ), বলদ, অশ্ব, বৎসতরী (দু-বছরের গাভী) প্রভৃতি দেয়া হত।

অশ্বমেধ যজ্ঞ

    শক্তিশালী ক্ষত্রিয় রাজাগণ বিভিন্ন রাজ্য জয় করে দিগ্বিজয়ী হয়ে এই যজ্ঞ করার অধিকার অর্জন করতেন। এ যজ্ঞকে ক্ষত্রিয় যজ্ঞও বলা হয়। ফাল্গুন মাসের অষ্টমী অথবা নবমী তিথিতে অশ্বমেদ যজ্ঞ শুরু করতে হত। দেবতার উদ্দেশ্যে পশু যজ্ঞ করার পর একটি অশ্বকে পবিত্র জলে স্নান করিয়ে এক বৎসরের জন্য বিভিন্ন রাজ্য পরিক্রমার জন্য প্রেরণ করা হত। ঐ এক বৎসরব্যাপী যজমানকে কতগুলো হোম যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হত। এক বৎসর পর যজ্ঞীয় অশ্বটি প্রত্যাবর্তন করলে প্রথমে অগ্নিষ্টোম করতে হত। তারপর যজ্ঞভূমিতে অশ্বকে বেঁধে রাখার জন্য ছয়টি বিল্ব, ছয়টি খদির, ছয়টি পলাশ, দুইটি দেবদারু এবং একটি শ্লেষ্মাতক বৃক্ষ দ্বারা তৈরি যূপ স্থাপন করা হত। ঋতিকগণ বিভিন্ন পশুপক্ষী ও জলচর প্রাণীর সাথে ঐ যজ্ঞীয় অশ্বটিকেও যূপকাষ্ঠের সাথে বেঁধে রাখা হত। একেক দেবতার উদ্দেশ্যে একেক প্রকার প্রাণী উৎসর্গ করা হত। যেমন ইন্দ্রকে বরাহ, সূর্যকে বলাকা, বায়ুকে হংস, হিমালয়কে হস্তী, সমুদ্রকে মকর উৎসর্গ করা বিধেয় ছিল। অশ্বটিকে বধ করে তার দেহের বিভিন্ন অংশ পাক করে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। অশ্বমেদ যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা হিসেবে গো, অশ্ব, স্বর্ণ, রৌপ্য, বস্ত্র, অলঙ্কার, রত্ন, স্ত্রী প্রভৃতি প্রদান করা হত।

বাজপেয় যজ্ঞ

    বাজপেয যজ্ঞের প্রভৃতি সোম-যাগ। বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করতে সতের থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগত। সতের দিনের তের দিন দীক্ষা, একদিন সুত্য ও তিনদিন উপসদ্-যাগ অনুষ্ঠিত হত। যজ্ঞের শেষ দিন যজমান রাজা রথে আহরণ করতেন এবং তাঁর সাথে আরও ষোল জন রথী ষোলটি রথে আরোহন করতেন। তারপর শুরু হত রথ-চালনা প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার সময় সতেরটি বাদ্য-যন্ত্র বাজোনো হয় এবং ঐ সময় বৃহস্পতির উদ্দেশ্যে আহুতি দেয়া হত। তারপর যজমান সবার অগ্রে রথে চেপে বেদির নিকটে আগমন করতেন। বাজ, প্রসব, অপিজ, ক্রতু, বসু, মূর্ধা, ব্যশ্নিয়, আন্ত্যায়ন, আন্ত্য, ভৌবন, ভূবন ও অধিপতি এই দ্বাদশ প্রজপতির উদ্দেশ্য দ্বাদশ হোম করতে হত।

    উপরি-উক্ত যাগ-যজ্ঞ ছাড়াও প্রাচীনকালে পশুপক্ষীর মঙ্গল কামনায় চিত্রা-যাগ, প্রবাস গমনকালে কার্যসিদ্ধি কামনায় বাস্তোষ্পতীয় যাগ, আয়ু বৃদ্ধি ও রোক্তমুক্তি কামনায় চক্ষুষ্কাম যাগ, পুত্র সন্তান কামনায় পুত্রেষ্টি-যাগ, ধন ও ঐশ্বর্য কামনায় শ্রীযাগ প্রভৃতির প্রচলন ছিল। 

    গীতা অনুসারে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদে যজ্ঞ তিন প্রকার। ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে যজ্ঞ করতে হয় তাই করি, এই অবশ্য-কর্তব্যবোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্ত চিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাত্ত্বিক যজ্ঞ বলে। ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভ সহকারে ঐশ্বর্য, মহত্ব বা ধামির্কতা প্রকাশার্থ যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাকে রাজসিক যজ্ঞ বলে। শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নাদানবিহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন ও শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলে। ঋক্-বেদ সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ৯০ নং সূক্তের ৭ নং ঋকে পুরষ-যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। সেখানে আছে “যিনি সকলের অগ্রে জন্মেছিলেন, সে পুরুষকে যজ্ঞীয় পশুরূপে অগ্নিতে আহুতি দেয়া হল। দেবতগণ, সাধ্যবর্গ এবং ঋষিগণ তা দ্বারা যজ্ঞ করলেন”। ঐ পুরষ যজ্ঞে নিজেকেই আহুতি দিলেন অর্থাৎ পুরুষের আত্মাহুতির ফলে সৃষ্টিকার্য সম্পাদিত হয়েছে। শাস্ত্রে ব্রহ্ম যজ্ঞ বা ঋষি যজ্ঞ, পিতৃ যজ্ঞ, দৈব যজ্ঞ, ভূত যজ্ঞ এবং নৃ-যজ্ঞ এই পঞ্চযজ্ঞের কথার উল্লেখ আছে। ঋষি যজ্ঞ বা ব্রহ্ম যজ্ঞ বলতে সন্ধ্যা-উপাসনা, শাস্ত্র অধ্যয়ন, অধ্যাপনা প্রভৃতি বোঝায়। পিতৃ যজ্ঞ বলতে তর্পণ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি বোঝায়। দৈব যজ্ঞ বলতে হোম, সোম, সত্র যজ্ঞ প্রভৃতি বোঝায়। ভূত যজ্ঞ বলতে কাক আদি জীবজন্তুকে খাদ্য প্রদান এবং নৃ-যজ্ঞ বলতে অতিথি সৎকার বোঝায়। শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতার জ্ঞানযোগে দ্রব্যযজ্ঞ, তপোযজ্ঞ, যোগযজ্ঞ, স্বাধ্যায়-যজ্ঞ এবং বেদজ্ঞান যজ্ঞ এই পঞ্চ মহা যজ্ঞের উল্লেখ আছে। দ্রব্য-যোগ্য বলতে পূজা-অর্চনা, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, দান, শ্রৌতকর্ম (বৈদিক যাগ-যজ্ঞ) প্রভৃতি বোঝায়। তপোযজ্ঞ কৃচ্ছ্রতাসাধন পূর্বক উপবাস, ব্রত পালন প্রভৃতি বোঝায়। অষ্টঙ্গযোগ, লয়যোগ, হটযোগ প্রভৃতিকে যোগ-যজ্ঞ বলে। ব্রহ্মচর্য অবলম্বন পূর্বক শ্রদ্ধার সাথে যথাবিধি বেদ-বেদান্ত পাঠই স্বাধ্যায় যজ্ঞ। যুক্তি দ্বারা বেদের অর্থ নিশ্চয় করার নাম বেদজ্ঞান যজ্ঞ।

 (আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

ঈশ্বরতত্ত্ব










 হিন্দু দেবতা





0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন