ইন্দ্র
বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র প্রধান। বেদ অনুসারে
ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা। ইন্দ্রের দেহের বর্ণ পীত বা হলুদ। তাঁর এক হাতে পদ্ম এবং অন্য
হাতে বজ্র নামক অস্ত্র রয়েছে। তিনি সহস্রচক্ষু বিশিষ্ট এবং সর্বব্যাপী প্রভু। তাঁকে
দিকপাল বা দিকপতিও বলা হয়। দশজন দেবতা দশদিক ধারণ করে আছেন এবং নিয়ত দশদিক রক্ষা
করছেন। ইন্দ্র পূর্বদিক, অগ্নি অগ্নিকোণ, যম দক্ষিণদিক, নিঋর্ত নৈঋর্তকোণ, বরুণ পশ্চিমদিক,
মরুৎ বায়ুকোণ, কুবের উত্তরদিক, ঈশ (শিব) ঈশানকোণ, ব্রহ্মা ঊর্ধদিক এবং অনন্ত অধোদিকের
অধিপতি। সোমলতার রস ইন্দ্রের প্রিয় খাদ্য। সমুদ্র-মন্থনে উঠে আসা ঐরাবত
হস্তী তাঁর বাহন। ইন্দ্র তাঁর বজ্র দ্বারা বৃত্র, অহি, বল, অর্বুদ, উরণ, বিশ্বরূপ প্রভৃতি
অসুরদের বধ করেছেন। ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করে বৃত্রহা ও বৃত্রঘ্ন, বলকে বধ করে বলরিপু,
নমুচিকে বধ করে নমুচিসূদন এবং জম্বকে বধ করে জম্বভেদন নামে খ্যাত হয়েছেন।
ঋগ্বেদের
৪র্থ মণ্ডলের ২৬ নং সূক্তে ইন্দ্র বললেন “আমি মনু, আমি সূর্য, আমি কক্ষীবান ঋষি, আমি
অর্জনীর পুত্র কুৎস ঋষিকে অলঙ্কৃত করেছি, আমি কবি উশনা, আমাকে দর্শন কর। আমি আর্যকে
পৃথিবী দান করেছি। আমি হব্যদাতা মনুষ্যকে বৃষ্টিদান করেছি”। এখানে ইন্দ্রের বিভূতি
প্রকাশ পেয়েছে। বেদে ইন্দ্রের দানশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন— রাজা কক্ষীবান অনেকবার
রাজসূয় যজ্ঞ করলে ইন্দ্র খুশি হয়ে তাঁকে বৃচয়া নামক তরুণী স্ত্রী প্রদান করেছিলেন।
আবার ঋগ্বেদের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ইন্দ্র ধনবান বণিকদের সাথে সখ্য করেন না বরং
তাদের ধন হ্রাস ও নাশ করেন। বেদ মতে ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রানী। তবে পুরাণে ইন্দ্রের
স্ত্রী হিসেবে শচীর নাম রয়েছে। পুরাণ মতে ইন্দ্রের পুত্রের নাম জয়ন্ত ও বালী এবং
কন্যার নাম জয়ন্তী। ইন্দ্রের প্রাসাদের নাম বৈজয়ন্ত। ইন্দ্রের বিসান নামক রথ রয়েছে
যার চালক মাতলি। তাঁর অশ্বের নাম উচৈঃশ্রবা, ধনুর নাম ইন্দ্রচাপ এবং তরবারির নাম পারন্ধ।
বজ্র ছাড়াও ইন্দ্রের হ্রাদিনী ও দম্ভোলী নামক অস্ত্র রয়েছে।
ঋগ্বেদে
আছে— বল নামক অসুর দেবতাদের
গাভী অপহরণ করে কোন এক গহ্বরে গোপন করে রেখেছিল। ইন্দ্র তখন সৈন্য দ্বারা বেষ্টন করে
বলকে বধ করেন এবং গাভী উদ্ধার করে দোহন করেন। বৈদিক ঋষি-কবিরা এ কাহিনীটি রূপক
অর্থে ব্যবহার করেছেন। গো ধাতুর একটি অর্থ আলোক রশ্মি আর বল নামক অসুর মূলত মেঘ। মেঘ
কতৃর্ক আলো শোষিত হলে চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করেই অসুর বল
কতৃর্ক গাভী অপহরণের কাহিনী উৎপন্ন হয়েছে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বজ্র উৎপন্ন হয়,
ফলে আস্তে আস্তে মেঘ নিঃশেষিত হয়ে গেলে বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং অবশেষে আবার পৃথিবী
আলোকিত হয়। এটাই বজ্র দ্বারা বল বধ আর গাভী উদ্ধারের সূক্ষ্ম তাৎপর্য। বৈদিক ঋষিদের
নিকট ইন্দ্র হল এমন এক শক্তি যা বৃষ্টির দান করে পৃথিবীকে শস্যপূর্ণ করে তোলে। বেদের
দেবতারা নিরাকার তাই তাঁদেরকে ঘিরে বেদে যে কাহিনী তৈরী হয়েছে তা রূপক।
পুরাণে
ইন্দ্র কর্তৃক গৌতমপত্নী অহল্যার সতীত্ব হরণের কাহিনী রয়েছে। তবে পণ্ডিতদের মতে এ
কাহিনী রূপক অর্থৎ একটি বিশেষ ভাব প্রকাশ করার জন্য এ গল্পের সৃষ্টি হয়েছে। “অহল্যা”
শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ আছে। যা হলকর্ষণের অথার্ৎ লাঙ্গল দ্বারা চাষের যোগ্য নয় তাকে
অহল্যা বলে। তাই “অহল্যা” অর্থ অনুর্বর বা চাষের অযোগ্য জমি। জমি চাষ করতে গরু দরকার।
গো-তমের পুত্রের নাম গৌতম।
মূলত গৌতম বলতে গরুই বোঝায়। যেহেতু অহল্যা বলতে অনাবাদী জমি এবং গৌতম বলতে গরু বোঝায়
তাহলে ‘গরু দ্বারা অনাবাদী জমি চাষ’ কথাটির অর্থ দাড়ায় গৌতম অহল্যাকে চাষ করে অর্থাৎ
অহল্যার সাথে গৌতম মিলিত হয়। যেহেতু অহল্যার সাথে গৌতম মিলিত হয় সেহেতু অহল্যা গৌতমের
পত্নী। কিন্তু অনুর্বর জমি শুধু গরুর চাষে উর্বর হয় না; সে জন্য বৃষ্টিরও প্রয়োজন।
ইন্দ্র হলেন বৃষ্টিদাতা। অনুর্বর ভূমি বৃষ্টির সংস্পর্শে এলে অর্থাৎ ভূমির সাথে বৃষ্টির
মিলন ঘটলে ভূমি শস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটাই অহল্যার সতীত্ব হরণের রূপক কাহিনী।
আরও পড়ুন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন