7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৭ জানুয়ারী, ২০২২

মহাদেব শিব কে জানুন

 মহাদেব শিব

    ঈশ্বর যে রূপে সংহার বা ধ্বংস করেন, সে রূপের নাম মহাদেব শিব। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টি ও প্রলয় একুট অন্যটির পরিপূরক। সৃষ্টি না হলে প্রলয় হবে কেমন করে? আবার প্রলয় না হলে নতুন করে সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তা ও সংহারকর্তা উভয়ের মিলিত কার্যে সৃষ্টিপ্রবাহ বয়ে চলছে অনন্তকাল ধরে। ভগবান শিব বেদে রুদ্র নামে পরিচিত। ঋক্-বেদে রুদ্র হলেন ঝড়-বৃষ্টির দেবতা। আসলে ঝড়-বৃষ্টির সময়ই ঈশ্বরের প্রলয়ঙ্কারী রূপটা বেশি ফুটে ওঠে। ঝড়ের সময় মনে হয় যেন প্রকৃতি সব কিছুই ধ্বংস করে দেবেন। মূলত পৌরাণিক যুগেই ঝড়-বৃষ্টির দেবতা রুদ্র সংহারকর্তা শিব রূপে কল্পিত হলেন।

শিব


শিবের রূপ

    শারদা-তিলক নামক গ্রন্থে বর্ণিত ধ্যান-মন্ত্রে শিবের যে রূপের পরিচয় পাওয়া যায়, তা এরকম শিবের দেহ রজতগিরির মত উজ্জ্বল। রত্নময় ভূষণে তাঁর দেহ সজ্জিত এবং চন্দ্র দ্বারা লালাট শোভিত। তাঁর বাম হস্তদ্বয়ে পরশু (কুঠার) ও মৃগমুদ্রা এবং দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে বর ও অভয়মুদ্রা। তিনি বাঘের চামড়া পরিধান করে পদ্মাসনে প্রসন্নভাবে বসে আছেন। দেবগণ চতুর্দিক হতে তাঁর স্তুতি করছেন। তিনিই বিশ্বের আদি ও মূল কারণ এবং নিখিল ভয়নাশক। তাঁর পাঁচটি আনন বা মুখ এবং প্রতিটি আননে তিনটি লোচন বা চোখ রয়েছে। মৎস্য পুরাণ মতে শিব যেন ষোল বছরের যুবক। তিনি জটাধারী এবং ভূজঙ্গ (সাপ) তাঁর গলার হার। শারদা-তিলক গ্রন্থের অন্যত্র আছে শিব ত্রিশূলধারী এবং ডমরু নামক এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র রয়েছে তাঁর হস্তে।

অর্ধনারীশ্বর শিব

    বিভিন্ন পুরাণে শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। শিব তাঁর দেহকে দুভাগে বিভক্ত করে অর্ধনারীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর একভাগ পুরুষ এবং অপর ভাগ প্রকৃতি। একই অঙ্গে পুরুষ শিব ও প্রকৃতি শিবানী প্রমাণ করে যে, পুরুষ ও প্রকৃতি অভেদ অর্থাৎ শক্তি ও শক্তিমান অভেদ ঈশ্বর নারী ও পুরুষ উভয়ই। তিনি নারী হয়ে এই জগৎকে প্রসব করেছেন এবং পুরুষ হয়ে সে জগৎকে দর্শন করছেন। শারদা-তিলকে অর্ধনারীশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছে নীল প্রবালের বর্ণ সমন্বিত, তিন চক্ষুবিশিষ্ট চার হস্তে পাশ, রক্তপদ্ম, কপাল (মুণ্ড) ও ত্রিশূল ধারণকারী, অর্ধাংশে অম্বিকা এবং অর্ধাংশে শিব এই দুইভাগে বিভক্ত অলংকারযুক্ত, মুকুটে শিশুচন্দ্র শোভিত অর্ধনারীশ্বর রূপকে প্রণাম করি।

শিবের ভৈরব রূপ

    শিবের আরেক রূপ ভৈরব। ভূরি পরিমান রক্ত হতে যা উৎপন্ন হয়েছে তাই ভৈরব। মৎস্য পুরাণে বলা হয়েছে ভৈরবের চক্ষু ও নাসাগ্র তীক্ষ্ণ, বদন ভীষণ ও করাল। মহানির্বাণতন্ত্রে যে অষ্টভৈরবের উল্লেখ আছে তা হল অসিতাঙ্গ, রুরু, চণ্ড, ক্রোধোন্মত্ত, ভয়ঙ্কর, কপালী, ভীষণ ও সংহারী। আট প্রকার ভৈরবের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে শিবের অতি ভয়ঙ্কর রূপই ভৈরব। বামন পুরাণে ভৈরব সৃষ্টির  উপাখ্যান রয়েছে। সেখানে আছে অন্ধক নামক অসুরের সাথে শিব যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। যুদ্ধকালে অন্ধক গদা দ্বারা শিবের মস্তকে আঘাত করল। ফলে শিবের মস্তক হতে রক্তধারা বইতে লাগল। সেই ভূরি পরিমান রক্ত হতেই ভৈরবগণের জন্ম।

    মৎস্য পুরাণ মতে শিব চতুভূর্জ আবার কখনও অষ্টভূজ এবং তিনি যখন রয়েছে বৃষের উপরে বসে নৃত্য ও অভিনয়কালে দ্বিভূজ, তাণ্ডব নৃত্যকালে দশভূজ এবং ত্রিপুর দহনকালে ষোড়শভূজ। শিব অষ্টভূজ মূর্তি অষ্ট হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা, শাঙ্গর্, ঘণ্টা, ধনু, পিনাক ও বিষ্ণুময় শর ধারণ করেন। বিষ্ণু পুরাণে আছে, শিব শ্মশানে ঘূরে বেড়াতে পছন্দ করেন এবং ভূতি বা ছাই-ভস্ম লেপন করে আনন্দ পান।

শিবের রূপের তাৎপর্য

শিবের বর্ণ সাদা কেন?

    শিবের যে রূপের পরিচয় পাওয়া গেল, এখন সে রপের বিস্তারিত বর্ণনা করা যাক। শিবের বর্ণ শুভ্র বা সাদা কেন? শিবের আবাস কৈলাস শৃঙ্গে। কৈলাস হিমালয় পর্বতের একটি শৃঙ্গ যার উপরিভাগ বরফে আচ্ছন্ন থাকে। বরফের বর্ণ সাদা। অতএব শিব কৈলাসবাসী বলে তাঁর গাত্রবর্ণ সাদা হওয়া স্বাভাবিক। শিবের মাথায় জটা, এরও একটা তাৎপর্য আছে। হবে হলেন পরম যোগী। তিনি জগতের কল্যাণের জন্য যোগ শাস্ত্রের সৃষ্টি করেন। তিনি বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিত না থেকে যোগীর বেশে থাকতেই পছন্দ করেন। যোগীর মাথায় জটা থাকাটা স্বাভাবিক কারণ তাঁদের কেশ বিন্যাস করার সময় কোথায়? যোগীদের বিলাসিতায় করার ইচ্ছাও জাগে না কারণ বিলাসিতা সাধন পথের বাধা স্বরূপ। তাই তো যোগী শিব স্বর্ণবস্ত্র ছেড়ে বাঘের চামড়া পরিধান করে সন্ন্যাসীদের মত ভিক্ষা করে বেড়ান। কৃত্তি বা বাঘের চামড়া পরিধান করেন বলে তার এক নাম কৃত্তিবাস।

শিব শ্মশানে ঘুড়ে বেড়ান এবং দেহে ছাই-ভস্ম মাখেন কেন?

    শিব শ্মশানে ঘুড়ে বেড়ান এবং দেহে ছাই-ভস্ম মাখেনএরও একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। শ্মশান হল শবের শয়ন স্থান। মহাকাল শিব প্রলয়ের দেবতা এবং তিনিই জীবের মৃত্যু ঘটিয়ে তাকে শবে পরিণত করেন। মরণের পর জীবের শেষ আশ্রয়স্থল ঐ শ্মশান। তাই মরণের দেবতা শিবের শ্মশানচারী হওয়া যথোপযুক্ত। আবার শ্মশান রিক্ততা বা শূন্যতার প্রতীক। সাধকের হৃদয় যখন কামনা-বাসনা শূন্য হয় তখন ঐ হৃদয়-শ্মশানেই যোগেশ্বর শিব বাস করেন। পঞ্চভূতের গড়া দেহ মৃত্যুর পর অগ্নিতে দাহ করলে শুধুমাত্র কিছু ছাইভস্ম বা বিভূতি অবশিষ্ট থাকে। ঐ ছাই-ভস্ম মূলত পঞ্চভূতেরই সারবস্তু। শিব হলেন পঞ্চভূতের পতি। তাই ভূতনাথ শিব তাঁর অঙ্গে ছাইভস্ম লেপন করেন এর অর্থ মৃত্যুর পর পঞ্চভূত পঞ্চভূতের মিশে যাওয়া।

শিবের গলায় সর্প কেন?

    এই সর্প একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। সর্প হল কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। এই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার চক্রে সর্পের মত পেঁচানো অবস্থায় থাকে। কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করাই যোগের উদ্দেশ্য। তাই কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক সর্প শিবের গলায় থাকাতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, অহিভূষণ শিব এজন পরম যোগী।

শিবের মাথায় চন্দ্র কেন?

    শিব সমুদ্র-মন্থনের সময় উঠে আসা চন্দ্রকে ঠাই দিয়েছিলেন মস্তকে। শিবের মস্তকে সোম বা চন্দ্র শোভা পাচ্ছে বলে শিব চন্দ্রশেখর, সোমনাথ, সোমেশ্বর, শশিভূষণ প্রভৃতি নামে খ্যাত হয়েছেন। শিবপুরাণের অন্যত্র আছে, সতীর দেহত্যাগের পর শিব বিভিন্ন বন-জঙ্গলে, পাহাড়-পবর্তে তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। শিব যে যে স্থানে তপস্যা করছিলেন সেসব তপস্যাস্থল তাঁর তেজে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছিল এবং চন্দ্র-সূর্যও নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিল। তখন তাঁর তেজ কমিয়ে শান্ত করার জন্য দেবগণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তারপর ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মার নির্দেশে শিবকে দুটি কলস উপহার দিয়েছিলেন। একটি কলস ছিল অমৃতপূর্ণ এবং অন্য কলসটি ছিল গড়ল বা বিষে পূর্ণ। শিব দুইটি কলসই গ্রহণ করেছিলেন। একটি কলস থেকে অমৃত পান করেছিলেন এবং অপর কলস থেকে বিষ নিয়ে কন্ঠে লেপন করেছিলেন। অমৃত পান করে তিনি শান্ত হয়েছিলেন এবং অমৃত পানের পর তাঁর মস্তকে অর্ধচন্দ্র সৃষ্টি হয়েছিল। তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, চন্দ্র হল অমৃতের প্রতীক। অতএব শিবের মস্তকে চন্দ্রকে ধারণ করেছেন, এর অর্থ শিব অমৃত পান করেছেন এবং মৃত্যুকে জয় করে অমর হয়েছেন। তিনি সব কিছু বিনাশ করলেও তার বিনাশ নেই। ষোড়শ কলাবিশিষ্ট চন্দ্রের পঞ্চদশ কলা পঞ্চদশ তিথি রূপে প্রকাশিত হল। অবশিষ্ট এক কলা শিবের মস্তকে শোভা পেল। শিবের মস্তকের ঐ কলাকে অমাকলা বলে। অমাকলা মূলত মায়াশক্তির প্রতীক।

শিব কিভাবে নীলকণ্ঠ হলেন

    শিব কণ্ঠে বিষ লেপন করায় তার কণ্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করল। এভাবে তিনি নীলকণ্ঠ হলেন। তবে শিব পুরাণের অন্যত্র আছে সমুদ্র-মন্থনের সময় উঠে আসেছিল কালকুট বিষ। তখন লোক হিতার্থে শিব সে বিষ পান করে কণ্ঠে ধারণ করলেন। তারপর থেকে শিব নীলকণ্ঠ নামে খ্যাত হলেন। ঐ কালকুট বিষ করায় শিবের কোন ক্ষতি হল না কারণ শিব মৃত্যুকে জয় করেছেন। মৃত্যুকে জয় করেছেন বলে শিবের আরেক নাম মৃত্যুঞ্জয়।

শিবের ত্রিশূল

     শিবের হাতে ত্রিশূলের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ত্রিশূলের তিনটি ফলক সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণকে সূচিত করে। আর যে দণ্ডের অগ্রভাগে ঐ ফলক লাগনো থাকে সে দণ্ডটি নিগুর্ণ ব্রহ্মকে নিদের্শ করে। নিগুর্ণ ব্রহ্ম থেকে ত্রিগুণবিশিষ্ট প্রকৃতি সৃষ্টি হয়েছে,ত্রিশূল মূলত এই ভাবটিকেই প্রকাশ করে। আবার “ত্রিশূল” দ্বারা ত্রিবিধ বিঘ্নও বোঝায়। শিব আধিভৗতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিবিধ বিঘ্ন দ্বারা প্রাণিকুল সংহার করেন। তাই ত্রিশুল এই ত্রিবিধ বিঘ্নেরও প্রতীক।

ত্রিলোচন শিব

    তিনটি চক্ষু বলে শিবের নাম ত্রিলোচন। তাঁর তৃতীয় চক্ষুকে জ্ঞান-চক্ষু বলে। শিব তৃতীয় চক্ষু দ্বারা কামদেব বা মদনকে পুড়িয়ে ভস্ম করেছিলেন। জ্ঞান চক্ষু যখন বিকশিত হয়, তখন কাম দূরীভূত হয়। জ্ঞানের দ্বারাই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ষড়রিপুকে বিনাশ করা যায়। এজন্যই পরম জ্ঞানী শিব তার জ্ঞানচক্ষু দ্বারা কামদেবকে বিনাশ করলেন।

শিব পঞ্চানন অর্থাৎ শিবের পাঁচটি মুখ কেন

    পাঁচটি আনন (মুখ) রয়েছে বলে শিব পঞ্চানন নামে খ্যাত হয়েছেন। তাঁর পাঁচটি মুখ বিশেষ অর্থ বহন করে। ঐ পঞ্চ-মুখ মূলত পঞ্চভূতকে নির্দেশ করে। শিব হলেন ভূতনাথ বা ভূতপতি। এই ভূত অর্থ কোন প্রেত বা অশরীরী নয়। ভূত বলতে মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ এই পাঁচ পদার্থকে বোঝায়। এই পাঁচ প্রকার ভূত দিয়ে জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে। শিব হলেন এই পঞ্চভূতের পতি বা অধীশ্বর এবং তাঁর পঞ্চ আনন ঐ পঞ্চভূতকেই প্রকাশক করে।

    শিবের মৃগ মুদ্রার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। মৃগ শব্দের এক অর্থ খোজা। কিন্তু তিনি কাকে খোজেন? শিব খুব ভক্তবৎসল, তাই তিনি ভক্তকেই খুজে বেড়ান।

শিবের বিভিন্ন নাম

    এখন শিবের বিভিন্ন নাম ও রূপের আলোচনায় আসা যাক। পুরাণে শিবের  অষ্টমূর্তির উল্লেখ আছে। শিব যে আট প্রকার মূর্তিতে বিরাজমান তা হল রুদ্র, ভব, শর্ব, উগ্র, ভীম, পশুপতি, মহাদেব, ও ঈশান।

রুদ্র

    রোদন করেন বা রোদন করান যিনি, তিনি রুদ্র। রুদ্র বৈদিক দেবতা। বেদে রুদ্র হলেন ঝড়-বৃষ্টির দেবতা। ঝড়-বৃষ্টি হলে চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ হয়। ঐ শব্দকে উচ্চস্বরে রোদন করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। উচ্চস্বরে রোদন করার জন্যই ঝড়বৃষ্টির দেবতা রুদ্র নামে খ্যাত হলেন।

    “ভব” শব্দের অর্থ উৎস বা জন্মস্থান। শিব সকল ভূতের বা পদার্থের এবং সকল প্রাণীর উৎস, তাই তিনি ভব। শর্ব অর্থ পাপহন্তা। যিনি সকল জীবের পাপ দূর করেন, তিনিই শর্ব। সৌম্য বা শান্ত রূপে প্রলয়কার্য করা অসম্ভব তাই তিনি প্রলয়ের সময় উগ্র মূর্তি ধারণ করেন। শিব শক্তিশালী বা বলবান এজন্য তিনি ভীম। শিবের এক রূপ পশুপতি। এখানে পশু অর্থ কোনো বন্য জন্তু নয়। পশু অর্থ জীব। যিনি সকল পশুর বা জীবের পতি এবং সকল জীবের কল্যাণ করেন, তিনিই পশুপতি। দেবগণও ভগবান শিবকে বন্দনা করেন, তাই তিনি মহাদেব। সকল জীব তাঁর নিকট মহা-ঐশ্বর্য প্রাথনা করে বলে তিনি মহেশ্বর। শিবের আর এক রূপ ঈশান। ঈশান শব্দটি এসেছে ঈশ্ ধাতু হতে যার অর্থ প্রভূ বা অধিপতি। তাই যিনি সকল জীবের ঈশ্ বা প্রভূ তিনিই ঈশান।

শিব নামের অর্থ

    এবার আসা যাক শিব নামের তাৎপর্য প্রসঙ্গে। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময়। সুতরাং যিনি সর্বভূতের মঙ্গল সাধন করেন, তিনিই শিব। শিবের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, এজন্য তিনি স্বয়ম্ভু। শিব শং বা মুক্তি দান করেন বলে শংকর নামে খ্যাত হয়েছেন। শিব কখনও ব্যক্ত আবার কখনও অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত। কুয়াশা যেমন সূর্যকে আবরিত করে রাখে এবং আলো প্রকাশিত হতে দেয় না শিব তেমনি জ্ঞানকে আবরিত করে রাখে এবং মায়া বিস্তার করেন। তাঁর এ তামসিক ভাব মূলত তমগুণী অসুরদের বিনষ্ট করা জন্য।

    ধূমরূপী এবং ধূর্জ বা কুয়াশারূপী মায়া বিস্তার করেন বলে তিনি ধূর্জটি। নির্দিষ্ট সময় বা কাল অতিবাহিত হওয়ার পর প্রাণীকুলকে বিনাশ করেন বলে তিনি মহাকাল। সংহার করে কপাল (মস্তক) হস্তে ঘুরে বেড়ান, এজন্য তিনি কপালী। তিনি স্থির বা ধ্রুব বলে স্থাণু। ত্রিপুরাসুর বধ করেছেন বলে তিনি ত্রিপুরারি নামে খ্যাত হয়েছেন। সকলকে সুখ দান করেন, এজন্য তিনি শম্ভু। তিনি হস্তে ত্রিশূল ধরেছেন বলে ত্রিশূলপানি, পিনাক ধরেছেন বলে পিনাকপানি নামে খ্যাত হলেন। তিনি কৈলাস নামক গিরির অধিপতি বলে গিরীশ বলে পরিচিত হলেন। জগতের কল্যাণের জন্য যোগ শিক্ষা দিয়েছেন এজন্য তিনি যোগেশ বা যোগীশ্বর।

নটরাজ শিব

    শিবই নৃত্য, গীত ও বাদ্যের প্রবক্তা। শিবের নৃত্যকে তাণ্ডব বলে। প্রলয়কালে শিব ডমরুর ডিডিম-ডিডিম তালে এবং ববম্-ববম্ কণ্ঠ-ধ্বনি সহকারে নৃত্য করেন, এজন্য তিনি নটরাজ।

বৈদ্যনাথ শিব

    শিব যেমন সংহার করেন তেমনি আবার ভীষক (চিকিৎসক) রূপে জীবের জরা-ব্যাধির উপশমও করেন। তাঁর এই রূপের নাম বৈদ্যনাথ। রাবণ একবার হিমলয়ের দক্ষিণে বৃক্ষখণ্ডক নামক স্থানে শিবের তপস্যা শুরু করলেন। কিন্তু তপসায় শিব প্রসন্ন না হলে রাবণ নিজ মস্তক ছিড়ে পূজা আরম্ভ করলেন। এক এক করে নয়টি মস্তক ছেদন করলেন, তবুও শিবের দেখা পেলেন। তারপর অবশিষ্ট মস্তকটি ছিন্ন করতে যাবেন এমন সময় মহাদেব এসে উপস্থিত হলেন বৈদ্যনাথ রূপে। রাবণের এরকম কঠোর সধানায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে অতুল বল প্রদান করলেন এবং ছিন্ন মস্তকগুলো জোড়া লাগিয়ে দিলেন।

    শিব সকল দেবতাদের আদিতে বা পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তাঁকে বর্ষীয়ান, জ্যেষ্ঠ, পূর্বজ প্রভৃতি বলে ডাকা হয়। কণ্ঠ শ্বেত বলে তিনি সিতিকণ্ঠ। কেশ মুণ্ডিত হয়েছে বলে তিনি ব্যুপ্তকেশ এবং ব্যোম (আকাশ) যেন তাঁর কেশ স্বরূপ, এজন্য তিনি ব্যোমকেশ। কেশের বর্ণ তামার মত বলে তিনি হরিকেশ। ব্রজে স্থিত বলে ব্রজ্য এবং গোষ্ঠে স্থিত বলে গোষ্ঠা, হৃদয়ে জাত বলে হৃদয্য এবং ধ্বংস করেন বলে তিনি রৈষ্ম। শিবের একটা বড় গুণ হল আশুতে অথার্ৎ খুব শীঘ্রই তুষ্ট হন, এজন্য তিনি আশুতোষ।

শিব দিগম্বর কেন?

    দিক যার অম্বর বা বসন, তিনিই দিগম্বর। তিনি দশদিকেই রয়েছেন এবং ঐ দশদিক যেন তাঁর বসন। অসীম ও অনন্তকে বস্ত্র দ্বারা আবরিত করা যায় না, এজন্য তিনি দিগম্বর। ত্রি অম্বক বা তিন চক্ষু আছে বলে শিবের নাম ত্র্যম্বক। শিব জীবের দুঃখ হরণ করেন বলে তাঁর নাম হর।

শিবের অবতার

    এবার শিবের অবতার প্রসঙ্গে আসা যাক। শিব পুরাণে যে অষ্টবিংশতি ব্যাসের কথা বলা হয়েছে তাঁরা হলেন ঋভু, সত্য, ভৃগু, অঙ্গিরা, সবিতা, মৃত্যু, ইন্দ্র, ধর্ম, বশিষ্ঠ, সারস্বত, ত্রিধামা, শততেজা, নারায়ণ, স্বরক্ষ, আরুণি, কৃতঞ্জয়, দীর্ঘতমা, ভরদ্বাজ, গৌতম, বাচঃশ্রবণ, সূক্ষ্মায়ণি, শুচি, তৃণবিন্দু, কৃষ্ণশক্তি, পরাশর, জতুকর্ণ্য এবং বেদব্যাস। এই অষ্টবিংশতি ব্যাস কল্পে কল্পে শিবের অবতার হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। শিব পুরাণে বৈবস্বত মন্বন্তরের বরাহকল্পে যে আটাশ জন শিব অবতারের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন শ্বেত, সুতার, মদন, সুহোত্র, কক্ষ, লৌগাক্ষি, মহাময়, জৈগীষব্য, দধিবাহ, ঋষভ, উগ্র, অত্রি, সুবালক, গৌতম, বেদশিঃরা, গোকর্ণ, গুহাবাসী, শিখণ্ডী, জটা-মালী, অট্টহাস, দারুক, লাঙ্গলী, মহাকাল, দণ্ডী, মুণ্ডীশ, সহিষ্ণু, সোমশমার্ ও নকুলীশ্বর। এদের প্রত্যেকের চার-চারজন শিষ্য ছিল। শিব পুরাণে বলা হয়েছে মহেশ্বরের রূপ পাঁচ প্রকার। তাঁর প্রথম রূপ ঊর্ধরোম ও ভয়ঙ্কর এবং এরূপে তিনি ক্রিড়া করেন। তাঁর দ্বিতীয় রূপ সূর্য কিরণের মত এবং এরূপে তিনি তপস্যায় নিমগ্ন থাকেন। তাঁর তৃতীয় রূপ চন্দ্রকিরণের মত এবং এরূপে তিনি লোক সংহার করেন। তাঁর চতুর্থ রূপ কুবের। কুবের রূপে তিনি প্রজা সৃষ্টি করেন। তাঁর পঞ্চম রূপ ব্রহ্মা এবং এরূপে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আবৃত করে রাখেন।

শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ

    শিব বারটি স্থানে বারটি জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে অবস্থান করেন। সৌরাষ্ট্রে সোমনাথ, অন্ধপ্রদেশের কৃষ্ণা নদীর তীরে শ্রীবশল পর্বতের উপর মল্লিকাজুর্ন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জায়নী নগরীতে শিপ্রা নদীর তীরে মহকাল, মধ্যপ্রদেশের মান্ধাতা পর্বতের পাদদেশে নর্মদা নদীর তীরে অমলেশ্বর, হিমালয়ের মন্দাকিনী নদীর তীরে কেদারনাথ, পুণার উত্তরে গৌহাটির নিকটে ব্রহ্মপুর পাহাড়ের উপর ভীমশঙ্কর, উত্তর ভারতের কাশী নগরীতে শ্রীবিশ্বেশ্বর, মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার গোদাবরী নদীর তীরে ত্র্যম্বকেশ্বর, বিহারের বৈদ্যনাথ ধামে বৈদ্যনাথ, মহারাষ্ট্রের অবর গ্রামে নাগেশ্বর, দ্বারকার নিকটে দারুক বনে রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের বেরুল গ্রামে ঘুশ্মেশ্বর নামে জ্যোতিলিঙ্গ রয়েছে।

    শিব পুরাণ মতে সৌরাষ্ট্রদেশে সোমনাথ, শ্রীশৈলে মল্লিকাজুর্ন, উজ্জয়িনীতে মহাকাল ও ওঙ্কারেশ্বর, হিমালয় পার্শ্বে কেদারনাথ, ডাকিনীপুরে ভীমশঙ্কর, গোদাবরী তীরে ত্র্যম্বকেশ্বর, চিতাভূমিতে বৈদ্যনাথ, বারানসীপুরীতে বিশ্বনাীথ, দারুকাবনে নাগেশ্বর, সেতুবন্ধে রামেশ্বর এবং শিবালয়ে ঘুশ্মেশ্বর জ্যোতিলিঙ্গ অবস্থিত। এইসব জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে আবার কতগুলো উপলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। সোমেশ্বরের উপলিঙ্গ অন্ধকেশ, মল্লিকাজুর্নের রুদ্রক, মহাকালের দুগ্ধেশ, ওঙ্কারেশ্বরের কর্দমেশ, কেদারনাথের ভূতেশসংজ্ঞক, ভীমশঙ্করের ভীমেশ্বর, বিশ্বনাথের শরণেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বরের সিদ্ধেশ্বর, বৈদ্যনাথের বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বরের ভূতেশ্বর, রামেশ্বরের গুপ্তেশ্বর এবং ঘুশ্মেশরের উপলিঙ্গ ব্রাঘ্রেশ্বর।

শিব আটষট্টি স্থানে আটষট্টি রূপে

    শিব পুরাণ মতে শিব আটষট্টি স্থানে আটষট্টি রূপে বিরাজমান। যথা বারাণসীতে মহাদেব, প্রয়াগে মহেশ্বর, নৈমিষ-ক্ষেত্রে দেবাদিদেব, গয়ায় প্রাপিতামহ, কুরুক্ষেত্রে কালেশ, প্রভাসে শশিভূষণ, পুষ্করে অয়োগন্ধ, বিমলেশ্বরে বিশ্ব, অট্টহাসে মহানাদ, মরুকোটে মহোৎকট, শঙ্কুকর্ণে মহাতেজ, গোকর্ণে মহাবল, রুদ্রকোটীতে মহাযোগী, স্থলেশ্বরে মহালিঙ্গ, অবন্তীতে মহাকাল, মধ্যমেশ্বরে শর্ব, কেদারে ঈশান, হিমালয়ে রুদ্র, সুবর্ণাক্ষে সহস্রাক্ষ, বৃষে বৃষভধ্বজ, ভৈরবে ভৈরবাকার, ভদ্রপথে ভদ্র, কনখলে উগ্র, ভদ্রকর্ণ হ্রদে শিব, দেবদারু বনে ভিন্ন, কাভিজঙ্গলে চণ্ড, সুরণ্ডে ঊর্ধকেতু, মঙ্গলাণ্ডে কপর্দী, কৃত্তিবাসে বরদ, আম্বাড়িকেশ্বরে সূক্ষ্ম, কালঞ্জরে নীলকণ্ঠ, মণ্ডলেশ্বরে শ্রীকণ্ঠ, ধ্যানসিদ্ধেশ্বরে যোগ, উত্তরেশ্বরে গায়ত্র, কাশ্মীরে বিজয়, মরুকেশ্বরে জয়, যমের অঙ্গে স্থাণু, করবীরকে কপিল, কায়াবতারে লগুড়ি, দেবিকায় উমাপতি ও হরিশ্চন্দ্রেশ্বর, পরচন্দ্রে শঙ্কর, কালেশ্বরে জটী, কুক্কুটকেশরে সৌম্য, সন্ধ্যায় তাম্রক, বদরীতে ত্রিলোচন, জলেশ্বরে ত্রিশূল, শ্রীশৈলে ত্রিপুরান্তক, লেপনে পশুপতি, অঙ্গেশ্বরে দীপ্ত, গঙ্গাসাগরে অমর, অমরকণ্টকে ওঙ্কার, সপ্ত-গোদাবরীতে ভীম, পাতালে হাটকেশ্বর, কর্ণিকারে গণাধ্যক্ষ, কৈলাসে ত্রিপুরান্তক, হেমকূটে বিরুপাক্ষ, গন্ধমাদনে ভূভূর্ব, দিড়ীশ্বরে অনল, স্থলেশ্বরে জ্বলল্লিঙ্গ, ভূতেশ্বরে গণাধ্যক্ষ, কিরাতকে কৈরাত, বিদ্ধ্যাচলে দানব-বিনাশকারী বারাহ, গঙ্গহ্রদে হিমস্থান, বড়বামুখে মানব, তীর্থে শ্রেষ্ঠকোটীশ্বর, ইষ্টকাপথে বিশিষ্ট, কুকুসুপুরে প্রহাস এবং লঙ্কায় অলকেশ্বর।

কাশীতে শিবের বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ রূপ

    কাশীতে শিব বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পুণ্যক্ষেত্র কাশীর আয়তন পঞ্চক্রোশ। যা কর্ম-বন্ধন কর্ষণ অর্থাৎ নাশ করে তাই কাশী। তাই কাশী এমন এক তীর্থক্ষেত্র যেখানে গেলে কর্ম-বন্ধন নাশ হয়। কাশী ভক্তদের সাযুজ্য মুক্তিদান করে অর্থাৎ কাশীতে গেলে মৃত্যুর পর জীবাত্মা পরমাত্মায় (নিগুর্ণ শিবে) লয়প্রাপ্ত হয়। একদিন শিব পাবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হলে ব্রহ্মা শিবের পূজা ও সমাদর করলেন। তারপর ব্রহ্মা পঞ্চমুখে শিবের স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন কিন্তু স্তব-স্তুতি করার সময় ব্রহ্মার পঞ্চমুখের একমুখ অপভ্রংশ শব্দ উচ্চারণ করলে শিব ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মার ঐ মস্তক ছেদন করলেন। কিন্তু ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ, এজন্য ঐ মস্তক শিবের পৃষ্ঠে আটকিয়ে গেল। শিব যেখানে যায়, ঐ মস্তকও সেদিকে যায়। অবশেষ ঘুরতে ঘুরতে শিব যখন কাশী এলেন তখন শিবের পৃষ্ঠ হতে ব্রহ্মার ঐ মস্তক মোচন হল অর্থাৎ মস্তক খসে পড়ল। ব্রহ্মা স্বয়ং পাপ-মোচনের জন্য ঐ স্থানে কাশীক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন।

মহাদেব বা শিবের শক্তি

    এবার মহাদেবের পত্নী বা শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। মহাদেব দক্ষের জ্যেষ্ঠা কন্যা সতীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। একদিন কৈলাসে মহাদেবকে দেখতে সব দেবতারা এলেন এবং দেবতাদের সাথে দক্ষও এলেন জামাতাকে দেখতে। কিন্তু মহাদেব অন্যান্যদের যে রকম সমাদর করলেন দক্ষকেও সে রকম সমাদর করলেন। দক্ষ শ্বশুর হিসেবে একটু বেশি যত্ন পাবেন এই আশা করেছিলেন। তাই বেশি সমাদর না পাওয়ায় দক্ষ শিবের প্রতি মনে মনে ক্রুদ্ধ হলেন। তারপর একদিন দক্ষ এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সে যজ্ঞে দক্ষ শিব ও সতী বাদে সকল কন্যা ও জামাতাকে নিমন্ত্রন করলেন। সতী এ সংবাদ নারদের নিকট জানতে পেরে পিতৃগৃহে ছুটে আসলেন। কিন্তু দক্ষ সতীর কোন যত্ন করলেন না বরং শিবনিন্দা শুরু করলেন। সতী তাঁর পতির নিন্দা সইতে না পেরে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করলেন। শিব এ সংবাদ শুনে অত্যন্ত ক্রোধিত হলেন। তিনি দক্ষের যজ্ঞ বিনাশ করার জন্য বীরভদ্রকে সৃষ্টি করলেন। ঐসময় তাঁর তেজ হতে ভদ্রকালীর আবির্ভাব ঘটল। বীরভদ্র যজ্ঞস্থলে গিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করলেন। যজ্ঞে নিমন্ত্রিত দেবতারা বীরভদ্রের ভয়ে পলায়ন করতে লাগলেন। তারপর বীরভদ্র দক্ষের মুণ্ড ছেদন করলেন। তখন দেবতারা বুঝতে পারলেন যে, শিবকে যজ্ঞভাগ না দেওয়া দক্ষের কত বড় ভুল ছিল। বীরভদ্রের সংহারকার্যে ভদ্রাকালী সহায়তা করেছিলেন। দেবতারা তখন মহাদেবকে শান্ত করার জন্য তাঁর স্তব শুরু করলেন। দক্ষের স্ত্রী প্রসূতীও তাঁর পতির জীবনদান করার জন্য শিবের নিকট স্তব শুরু করলেন। অবশেষে শিব শান্ত হলেন এবং দক্ষের খণ্ডিত দেহে একটি ছাগমুণ্ড স্থাপন করে দক্ষকে প্রাণদান করলেন। তারপর শিব সতীর দেহকে পিঠে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগলেন এবং সেই সাথে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহকে খণ্ড-খণ্ড করতে লাগলেন। সতীর দেহের একান্নটি খণ্ড একান্নটি স্থানে পতিত হল এবং সেসব স্থান তীর্থে পরিণত হল। 

শিবপত্নী পার্বতীর তপস্যা এবং শিবের মদন ভস্ম

    সতী দেহত্যাগের পর হিমালয়ের ওরসে মেনার গর্ভে পার্বতী রূপে জন্ম নিলেন। শিব সতীর বিরহে যোগী-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে তপস্যায় নিমগ্র হলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি আর বিবাহ করবেন না। কিন্তু পার্বতী মহাদেবকে পতী রূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। কিন্তু তাতেও শিবের মন বিচলিত হল না। দেবতারাও চাইলেন যে, পার্বতী ও শিবের বিয়ে হোক। কারণ তারকা নামক এক অসুর বর পেয়েছিল যে, শিবের ঔরসজাত পুত্র ছাড়া অন্য কারও হাতে তার মুত্যু হবে না। শিবের তেজ ধারণ করার সামর্থ্য একমাত্র পার্বতীরই ছিল। মহাদেব পার্বতীকে বিবাহ না করলে তাঁর পুত্রের জন্ম হবে না এবং পুত্রের জন্ম না হলে তারকাসুরকে বধ করা যাবে না। তাই দেবতাগণ পার্বতীর প্রতি মহাদেবের অনুরাগ সৃষ্টির জন্য মদনকে পাঠালেন। মদন মহাদেবের দেহে কাম সৃষ্টির লক্ষ্যে পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করলেন। যোগী মহাদেব সব জানতে পেরে তাঁর তৃতীয় নয়ন দ্বারা মদনকে ভস্ম করলেন। কিন্তু মদন-ভস্ম করলেও পার্বতীর কঠোর তপস্যায় সারা না দিয়ে পারলেন না। মহাদেব জটিল নাম ধরে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে পার্বতীর সামনে উপস্থিত হলেন এবং শিবনিন্দা শুরু করলেন। জটিলের মুখে শিবনিন্দা শোনার পরও শিবের প্রতি তাঁর অনুরাগ একটুও কমল না এবং তিনি জটিলকে জানালেন যে, শিব ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করবেন না। তখন জটিলরূপী শিব পার্বতীর প্রতি প্রসন্ন হয়ে নিজ রূপে তাঁকে দর্শন দেন এবং তাঁকে বিবাহ করতে সম্মত হন। তারপর নারদ তাঁর পিতা হিমালয় ও মাতা মেনার নিকট গিয়ে তাঁকে শিবের সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। পার্বতীর পিতা-মাতাও রাজি হয়ে যান। তারপর মহা-আড়ম্বরে শিব-পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিছুকাল পর শিবের তেজে কার্তিকের জন্ম হয়। কার্তিক তারকাসুরকে বধ করে দেবতাদের বন্দিদশা হতে মুক্ত করেন। কার্তিক ছাড়াও গণেশ নামে শিবের এক পুত্র রয়েছে যিনি বুদ্ধি ও সিদ্ধিদাতা নামে পরিচিত।

শিবের অসুর বধ

শিবের ত্রিপুরাসুর বধ

    এবার শিবের অসুর বধ প্রসঙ্গে আসা যাক। ত্রিপুরাসুর বধ করে শিব ত্রিপুরারি নাম ধারণ করেছিলেন। ত্রিপুরাসুর বধের কাহিনীটি এরকম পুরাকালে ময় নামক দৈত্য বিদ্যুৎপ্রভ ও তারকাক্ষ নামক অসুরদ্বয়ের সাথে কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছিল। তাদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বর দিতে চাইলেন। তারা ব্রহ্মার নিকট অমর হওয়ার বর চাইল কিন্তু ব্রহ্মা তা দিতে সম্মত হলেন না। অমর হওয়ার বর না পেলেও তারা ব্রহ্মার নিকট এই বর লাভ করল যে, তারা তিনজন যে তিনটি পুরী নির্মাণ করবে, সে পুরী তিনটি যিনি এক বাণে দগ্ধ করতে পারবেন, একমাত্র তাঁর হাতেই তাদের মৃত্য হবে। বর পাওয়ার পর ময় দানব একটি লোহার, একটি রূপার ও একটি সোনার পুরী (প্রাসাদ) নির্মাণ করল। লোহার পুরীতে তারকাক্ষ, রূপার পুরীতে বিদ্যুৎপ্রভ এবং সোনার পুরীতে ময় দানব বাস করতে লাগল এবং দেবতাদের অনিষ্ট করতে করল। যা হোক, দেবগণ ঐ অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যখন ব্রহ্মার নিকট আসলেন তখন ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সর্ব দেবগণকে নিয়ে শিবের শরণাপন্ন হলেন। তারপর শিব দেবতাদের দুর্দশার কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে এক বাণে ত্রিপুর দগ্ধ করলেন এবং তারকাক্ষ ও বিদ্যুৎপ্রভকে বধ করলেন। তবে তিন অসুরদের মধ্যে ময় ছিলেন শিব ভক্ত। তাই শিব ময়কে বধ করলেন না।

শিব কর্তৃক জব্দ রাবণ

    রামায়ণে আছে রাবণ একবার কুবেরকে পরাস্ত করে কৈলাসে উপস্থিত হল। শিবের অনুচর নন্দী রাবণকে কৈলাসে প্রবেশ করতে বাধা দেন ফলে সে কুপিত হয়ে কৈলাস উত্তোলন করতে উদ্যত হয়। তখন শিব পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা রাবণের বাহু চেপে ধরলে সে গর্জন করে ওঠে। ঐ গর্জনে ত্রিলোক কেঁপে উঠেছিল। ভীষণ গর্জন বা রব করেছিলেন বলে দশাননের নাম হয়েছিল রাবণ। রাবণের মন্ত্রীগণ তাকে ঐ বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য শিবের স্তুতি করার পরামর্শ দেন। তখন সে শিব-স্তুতি শুরু করল। তার স্তুতিতে শিব তুষ্ট হয়ে সহস্র বৎসর পর তাকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করেন। শিব রাবণের প্রার্থনা অনুসারে তাকে চন্দ্রহাস নামক একটি খড়গও দান করেছিলেন।

শিবের ভীমাসুর বধ

    রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের ঔরসে কর্কটী নামক রাক্ষসীর গর্ভে ভীম নামক এক অসুরের জন্ম হয়েছিল। ভীম ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে পৃথিবীতে নানা অনাচার শুরু করল এবং যজ্ঞ-পূজা নিষিদ্ধ করে দিল। তারপর কামরূপের রাজা বিশুদ্ধকে তাড়িয়ে দিয়ে কামারূপের সিংহাসন অধিকার করল। রাজা বিশুদ্ধকে রানী দক্ষিণাকে নিয়ে পঞ্চকোশী নদীর তীরে এসে শিবলিঙ্গ গড়ে শিবের পূজা করতে লাগলেন। কিন্তু ভীম খবর পেয়ে সেখানে ছুটে গেল এবং এক বিরাট তলোয়ারের সাহায়্যে সে শিবলিঙ্গ চুর্ণ করতে উদ্যত হল। তখন শিব সে শিবলিঙ্গ ভেদ করে আবির্ভূত হলেন এবং ভীম অসুরকে বধ করলেন। তারপর থেকে তিনি পঞ্চকোশীর তীরে প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্লিঙ্গ ভীমেশ্বর নামে খ্যাত হলেন।

শিবের অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গী

    কৈলাসের শিবের অনেক অনুচর আছে। ভারভূতি, অম্বাশিব, হর, সোম, অজৈকপদ, অপাদ, নিকুম্ভ, শঙ্কুকর্ণ, নন্দিক, পিঙ্গাক্ষ, বিনায়ক, কুষ্মাণ্ড, ধ্রম্রকেশ, কুম্ভকর্ণ বিশ্ববল, ককুদ, কুম্ভ, সপ্তশিরা, অপস্মার প্রভৃতি গণপতিরা হলেন শিবের অনুচর। এদের মধ্যে নন্দী হলেন প্রধান এবং শিবের সব থেকে প্রিয়। নন্দীর পিতার নাম শিলাদ। নন্দী আযোনিসম্ভব অথ্যাৎ যোনি ভেদ করে তার জন্ম হয়নি। মহাদেবের তপস্যা করে নন্দী তাঁর প্রধান অনুচর হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। পূর্বজন্মে নন্দীর নাম ছিল বীরক এবং তিনি ছিলেন কৈলাসের রক্ষক। পুত্র জন্মের পর ঋষি শিলাদ খুব আনন্দিত হওয়ায় পুত্রের নাম রাখলেন নন্দী। নন্দী বামন হলেও দেখতে বিকট, করাল এবং তাঁর মস্তক মুণ্ডিত। তিনি মহাদেব কতৃর্ক গণনায়ক পদে অধিষ্ঠিত হন। সবর্দা তিনি মহাদেবের সেবায় ব্যস্ত থাকেন। মহাদেবের আরেক সহচর হল ভৃঙ্গি। দৈত্যরাজ হিরণ্যাক্ষের পুত্র অন্ধক মহাদেব কতৃর্ক নিহত হয়ে পরের জন্মে ভৃঙ্গি হয়ে মহাদেবের সেবা করার সুযোগ লাভ করেন।

শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক শিবের পূজা

    বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণও শিবের পূজা করেছিলেন। শিব পুরাণে আছে উপমন্যু নামক ঋষির পরামর্শে শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র-শস্ত্র লাভ করে শক্তিশালী হওয়ার জন্য সহস্র পদ্মফুলের দ্বারা শিবপূজা করেছিলেন। শিব কৃষ্ণের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে সুদর্শন চক্র দান করলেন। শাস্ত্রে একথাও আছে যে, কৃষ্ণ মহাদেবকে তুষ্ট করে জাম্ববতীর গর্ভে সাম্ভ নামক পুত্র লাভ করেন। ব্রক্ষা, বিষ্ণু ও শিব পরষ্পরকে পূজা, স্তুতি ও প্রশংসা করেছেন অর্থাৎ তাঁরা কেউ কারও থেকে ছোট নন। মূল কথা হল এই দেবতাত্রয় এক কিন্তু গুণ ও কার্যভেদে ভিন্ন হয়েছেন।

শিবের বর্ণমালায় প্রকাশ

    শিব শব্দময় এবং তিনি বর্ণমালায় প্রকাশিত হন। অ কার শিবের মস্তক, আ কার ললাট, ই-ঈ কার তাঁর দুই চক্ষু, উ-ঊ কার দুই কর্ণ, ঋ-ঋৃ কার দুই গাল, ৯-কার নাসিকা, এ-ঐ কার দুই ওষ্ঠ, ও-ঔ কার দুই দন্তপংক্তি। অনুস্বর ও বিসর্গ দুই তালুদ্বয়, ক হতে ঙ পর্যন্ত পাঁচটি বর্ণ তাঁর দক্ষিণ হস্ত, চ হতে ঞ পর্যন্ত পাঁচটি বর্ণ তাঁর বাম হস্ত, ট হতে ণ পর্যন্ত এই পাঁচটি বর্ণ দক্ষিণ পদ, ত হতে ন পর্যন্ত এই পাঁচটি বর্ণ বাম পদ, প-কার উদর, ফ থেকে স পর্যন্ত সাতটি বর্ণ তাঁর সপ্তধাতু, হ-কার নাভি এবং ক্ষ-কার নাদ প্রকাশক।

শিব লিঙ্গ কি

    বিভিন্ন পুরাণে শিবের লিঙ্গ রূপে আবির্ভাবের কাহিনী পাওয়া যায়। শিব-লিঙ্গ একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। শিব-লিঙ্গ সম্পর্কে অনেকেরই ভূল ধারণা রয়েছে। শিব-লিঙ্গ কিন্তু শিবের জননেন্দ্রিয় নয়। ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ চিহ্ন বা প্রতীক। শালগ্রাম শিলা যেমন বিষ্ণুর প্রতীক তেমনি শিব-লিঙ্গ শিবের প্রতীক অথার্ৎ শিব-লিঙ্গে পূজা করলে শিবেরই পূজা করা হয়। লিঙ্গের আরও একটি অর্থ আছে। যাতে সব কিছু লীন হয় তাই লিঙ্গ। প্রলয়ের পর জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়। এই লিঙ্গ পরমাত্নার প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ পরমাত্মারূপী শিবকেই নির্দেশ করে। প্রলয়ের পর আবার নতুন করে জীব জগত সৃষ্টি হয়। মূলত প্রলয় সৃষ্টিরই নামান্তর। কেউ কেউ গৌরীপট (যোনি-প্রতীক) সহ শিবলিঙ্গকে সৃষ্টির প্রতীক বলেন। শিব তো ধ্বংস করেন তবে তাঁর সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি? আগেই বলা হয়েছে ধ্বংসের আরেক নাম সৃষ্টি এবং সৃষ্টির আরেক নাম ধ্বংস। ব্রহ্ম পঞ্চভূতের যে স্থুল-শরীর সৃষ্টি করেন, মৃত্যুর পর সে স্থুল-শরীর পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায় এবং থাকে শুধু সূক্ষ্ম-শরীর। শিব মৃত্যুৎ ঘটান বলেই সূক্ষ্ম-শরীর সৃষ্টি বা ব্যক্ত হয়। তাই শিবকে সূক্ষ্ম-শরীরের সৃষ্টিকর্তা বলা চলে। নিগুর্ণ পরমাত্মা ত্রিগুণের দ্বারা ব্যক্ত হওয়ায় ফলে জীব-জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আবার এই জীব-জগৎ একদিন পরমাত্মার লীন হবে। তখন তিনি আবার অব্যক্ত হবেন। এই বিষয় গুলোই শিব-লিঙ্গের দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

শিব ও রুদ্রাক্ষ

    রুদ্রাক্ষ ফল শিবের খুব প্রিয়। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে যে মানবে শিবনাম, ভস্ম ও কল্যাণময় রুদ্রাক্ষ এই তিনটি বস্তু আছে যা দর্শন করা মাত্র প্রয়াগ তীর্থ স্নানের ফল হয়। অন্যত্র বলা হয়েছে যে স্থানে একমুখী রুদ্রাক্ষ থাকে সে স্থানে অষ্টসিদ্ধি বিরাজমান, কোন স্থানে দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ থাকলে সে স্থানে লক্ষ্মী নিকটবতীর্ হন, তিনমুখী রুদ্রাক্ষ থাকলে সেখানে বিদ্যার দেবী নিকটবতীর্ হন, চতুর্মুখী রুদ্রাক্ষ থাকলে সেখানে চতুর্বর্গ লাভ হয় এবং পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ থাকলে সেখানে সকল পাপ ধ্বংস হয়।

শিবরাত্রি বা শিবচতুর্দশী

    এবার শিব-পূজা প্রসঙ্গে আসা যাক। মাঘ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে রাত্রভাগের অষ্টগ্রহর ব্যাপী শিবে যে পূজা হয়, তাই শিবরাত্রি বা শিবচতুর্দশী নামে পরিচিত। শিব পুরাণে আছে, শিবপূজা, রুদ্রাধ্যায় জপ, অষ্টমী, সোমবার ও কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী এই তিন দিবস উপবাস এবং বারাণসীতে মরণ এই চার প্রকার কার্যে মুক্তি লাভ হয়। উক্ত চার কার্যের মধ্যে শিবরাত্রি ব্রত শ্রেষ্ঠ। রুরুদ্রুহ নামক ব্যাধ অজ্ঞাতসারে শিবরাত্রিব্রত পালন করে শিবের দর্শন পান।

 চম্পক (চাঁপা) ও কেতকী পুষ্প শিবপূজার নিষিদ্ধ কেন ?

    দ্রোণপুষ্প (ধুতুরা), কুন্দপুষ্প, জবা, নাগেশ্বর, জাতী, মল্লিকা, প্রভৃতি পুষ্প শিব-পূজায় ব্যবহৃত হয়। চম্পক (চাঁপা) ও কেতকী পুষ্প শিবপূজার নিষিদ্ধ। এর পিছনে পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। গোকর্ণ নামক এক ব্রাহ্মণ চম্পক পুষ্প দিয়ে শিব-পূজা করে শিবকে তুষ্ট করেছিলেন। চম্পক পুষ্পে শিব এতটাই তুষ্ট যে, গোকর্ণ নানা পাপকার্য করলেও চম্পক পুষ্প দ্বারা তাঁর পূজা করার ফলে তিনি তাকে পাপমুক্ত করতেন। একথা নারদ বুঝতে পারলেন। চম্পক পুষ্পের ফলে গোকর্ণ এত পাপকার্য করার পরও তার কোন ক্ষতি হত না, তাই চম্পক পুষ্পকে নারদ অভিশাপ দিলেন যে, ঐ পুষ্প আর শিব-পূজোয় লাগবে না। কেতকী পুষ্প নিষিদ্ধ হয়েছিল সীতা দেবীর অভিশাপে। রাজা দশরথের বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ এলেন ফল্গু নদীর তীরে। রাম বাৎসরিক শ্রাদ্ধ-কার্যের দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে লক্ষ্মণকে পাঠালেন। অনেকক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেলেও লক্ষ্মণ না আসায় রাম নিজেই  তাঁকে খুজতে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে শ্রাদ্ধের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে সীতা দেবী নিজেই হাতের কাছে যা কিছু ছিল তা দিয়ে শ্বশুরের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করলেন। রাজা দশরথ হাত বাড়িয়ে সীতার অর্ঘ্য নিলেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। এ ঘটনা রাম-লক্ষ্মণদের যাতে বিশ্বাস হয়, সেজন্য সীতা ফল্গু নদী, কেতকী পুষ্প, গরু ও অগ্নিকে সাক্ষী মানলেন। রাম ফিরে আসলে সীতা সব ঘটনা খুলে বললেন কিন্তু রাম বিশ্বাস করলেন না। সীতা তখন রামকে তাঁর সাক্ষীদের নিকট জিজ্ঞাসা করতে বললেন। কিন্তু সবাই মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ায় রাম নিজে শ্রাদ্ধকার্য শুরু করলেন। তখন দৈববাণী হল যে, সীতাই শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করেছেন। ঐ দৈববাণী শুনে রাম সীতাকে বিশ্বাস করলেন এবং সীতার জন্য গর্ব অনুভব করলেন। ঐ চার সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ায় সীতা তাদের অভিশাপ দিলেন। সীতার অভিশাপে ফল্গু নদী শুকিয়ে গেল, গরুর পশ্চাৎদেশ পবিত্র হলেও সম্মুখভাব অপবিত্র হল,  অগ্নি সর্বভূক হল এবং কেতকী পুষ্প শিব-পূজায় নিষিদ্ধ হল। বিল্ব-পত্র শিবের খুব পছন্দ। বিল্ব-পত্র মূলত শিবের ত্রিশূলের প্রতীক। বিল্বপত্রের তিনটি পত্রফলক রয়েছে যা ত্রিশূলের তিনটি ফলককে সূচিত করে।

শিবের বাহন

    শিবের বাহন বৃষ, এজন্য তিনি বৃষভ, বৃষধ্বজ প্রভৃতি নামে খ্যাত হয়েছেন। অনেকেই শিবকে শুধু সংহারকর্তা হিসেবেই জানে। কিন্তু শিব শুধু উগ্র নয়, তাঁর একটা শান্ত রূপও আছে। তাই তো শিবের আরেক নাম সৌম্য (ভদ্র)। বৃষ বা ষাড়েরও দুইটি রূপ। বৃষ সাধারণত শান্তই কিন্তু যখন রেগে যায় তখন লঙ্কাকাণ্ড করে ফেলতে পারে। শিব যেমন একাধারে উগ্র ও সৌম্য বৃষও ঠিক তাই। তাই শিবের বাহন বৃষ হওয়াই যথার্থ। আবার শিব অল্পতেই তুষ্ট হন। বৃষও সামান্য ঘাস ও লতাপাতা পেলেই তুষ্ট। বৃষ যেহেতু শিবের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, সেহেতু বৃষকেই শিবের বাহন কল্পনা করা হয়েছে।

শিব অর্থ

    শিব = শ + ই + ব। শ-কার অর্থ নিত্য সুখ, ই-কার অর্থ পুরুষ এবং ব-কার অর্থ অমৃত শক্তি। সুতরাং অমৃত শক্তির অধিকারী যে পুরুষ জীবকে সুখদান করেন তিনিই শিব। শিব আনন্দময় ও মঙ্গলময়। কিন্তু সংহারকার্যের মধ্যে কিসের আনন্দ? কিসের মঙ্গল? পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তা যদি ধ্বংস না হত তাহলে পৃথিবীতে জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে যেত। তাই পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই সংহারকার্য। মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মুক্তি লাভ করা। কিন্তু স্থুল-শরীর নিয়ে মুক্তি লাভ অসম্ভব। তাই পঞ্চভূতের স্থুল-শরীরের বিনাশ হওয়ার পর সূক্ষ-শরীর পরমাত্মার সাথে লীন হওয়াকেই মুক্তি বলে। শিব এই কার্যটি করে চলছেন প্রতিনিয়ত অথার্ৎ শিব এই পঞ্চভূতের শরীর বিনাশ করে প্রকৃতির পঞ্চভূতে মিশিয়ে দেন। ফলে সূক্ষ্ম-শরীর পরমাত্মার নিকট ধাবিত হয়। তাই সংহারকার্যের মধ্যেই রয়েছে মুক্তি। শিব মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়, তাই শিব মঙ্গলময়। যোগীরা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিরূপী কালীকে জাগ্রত করে পরমাত্মারূপী শিবের নিকট নিয়ে যান। এভাবে শিব ও কালীর মিলনে যোগীদের এক অতুলনীয় আনন্দলাভ হয়। তাই শিব আনন্দময়ও বটে।

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন