7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৯ জানুয়ারী, ২০২২

ভক্তি যোগ এর তাৎপর্য

ভক্তি যোগ কি

ঈশ্বরের সাথে ভক্তির দ্বারা যুক্ত হওয়াকে ভক্তি যোগ বলে। ভাগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন নিজের স্বরূপের অনুসন্ধান করার নাম ভক্তি। আমি কে? কোথা থেকে আমার সৃষ্টি? কোথায় আমার লয়? এভাবে নিজের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে ঈশ্বরকে জানা যায় এবং শেষে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম জন্মে। সাথে

  মোক্ষকারণসামগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী

  স্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে।

  স্বত্মতত্ত্বানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যপরে জগুঃ।।

  বিবেকচূড়ামনি (৩১)

মোক্ষের সাধনসমূহের মধ্যে ভক্তিই শেষ্ঠ। নিজের স্বরূপের সন্ধানকেই ভক্তি বলে অভিহিত করা হয়। আবার অনেকে আত্মার ও পরমাত্মার তত্ত্ব-বিচারকেই ভক্তি বলে। শাণ্ডিল্য সূত্রে বলা হয়েছে “সা পরানুরক্তিরীশ্বরে” অর্থাৎ পরমেশ্বরে পরম অনুরাগকে ভক্তি বলে।

ভক্তিযোগ

ভক্তি কাকে বলে

নারদীয় ভক্তি সূত্রে বলা হয়েছে “সা ত্বস্মিন্ পরমপ্রেমরূপা” অর্থাৎ একমাত্র ঈশ্বরের প্রতি পরম প্রেমকে ভক্তি বলে। নারদীয় ভক্তি সূত্রের অন্যত্র বলা হয়েছে “নারদস্তু তদর্পিতাখিলাচারতা তদ্ বিস্মরণে” অর্থাৎ যখন সকল চিন্তা, সকল কথা ও সকল কর্ম ঈশ্বরে সমার্পণ করা হয়, যখন ক্ষণিকের জন্য ঈশ্বরকে ভুলে গেলে অবস্থা শোচনীয় হয়, তখন ভক্তির সঞ্চার হয়। পরাশরপুত্র ব্যাসদেব বলেছেন “পূজাদিষানুরাগ” অর্থাৎ পূজাদি কর্মে অনুরাগই ভক্তি।  গর্গ মুনি বলেছেন “কথাদিষু” অর্থাৎ শ্রবণ ও কীর্তনে অনুরাগই ভক্তি। শাণ্ডিল্য বলেছেন “আত্মরত্যবিরোধেন” অথাৎ চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী চিন্তা ত্যাগ এবং আত্মাতে প্রীতিলাভ করাই ভক্তি। নারদীয় ভক্তি সূত্রের এক স্থানে বলা হয়েছে “যৎ প্রাপ্য ন কিঞ্চিদ বাঞ্ছতি ন শোচতি ন দ্বেষ্টি ন রমতে নোৎসাহী ভবতি” অর্থাৎ ভক্তি এমন বস্তু যা পাবার পর মানুষ অন্য কিছু পাবার ইচ্ছা করে না, তিনি কখনও শোক করেন না, তিনি ঘৃণা ও হিংসা হতে মুক্ত হন, তিনি জীবনে অসার বস্তুতে আনন্দলাভ করেন না এবং তিনি কোন বস্তু পাবার জন্য আগ্রহ করেন না।

ভক্তি লাভের উপায়

নারদীয় ভক্তি সূত্রে ভক্তি লাভের উপায় সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ভক্তি লাভ করতে হলে প্রথমেই বিষয়-বাসনা ত্যাগ করতে হবে এবং বিষয়ের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। সহজ কথায় সাংসারিক সুখের আশা ত্যাগ করতে হবে। ভগবানের ভজনা করতে হবে, সংসারে সকল কাজে নিযুক্ত থেকেও ভগবানের নাম-গুণ শ্রবণ ও কীর্তন করতে হবে, মহাপুরুষের সান্নিধ্য লাভ ও সাধুসঙ্গ করতে হবে, দুঃসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ত্যাগ করতে হবে এবং মায়াকে অতিক্রম করতে হবে। নারদীয় ভক্তিসূত্রের আর একটি শ্লোক প্রণিধানযোগ্য, যথা “তস্মিংস্তজ্জনে ভেদাভাবাৎ” অথার্ৎ ভক্তি লাভ করতে হলে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ভেদ জ্ঞান দূর করতে হবে।

ভক্তির প্রকারভেদ

এখন ভক্তির প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ভক্তিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা গৌণী বা অপরা এবং মুখ্যা বা পরা। গৌণী ভক্তিকে সগুণা আবার পরা ভক্তিকে নিগুর্ণা ভক্তিও বলে। বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণ ত্যাগ না করে এবং কোন কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে যে ভক্তি তাকে গৌণী ভক্তি বলে। সকল বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে অর্থাৎ নিষ্কামভাবে শুধুমাত্র ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যে তীব্র ব্যাকুলতা, তাই পরাভক্তি। পরাভক্তি জন্মিলে সাধক সর্বভূতে তাঁর প্রেমাস্পদকে দেখতে পান। ভক্তি-মার্গের সর্বোচ্চ স্তরে পরাভক্তি লাভ হয়। মুক্তির জন্য পরাভক্তি একান্ত আবশ্যক।

নববিধ ভক্তি

ভাগবতে নববিধ ভক্তির উল্লেখ আছে, যথা ভগবানের মাহাত্ম্য শ্রবণ করা, তাঁর গুণ-কীর্তন করা, তাঁর লীলা স্মরণ করা, তাঁর পূজা করা, তাঁর চরণ-সেবা করা, মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর অচর্না করা, তাঁর বন্দনা করা, দাস হয়ে তাঁর সেবা করা হয়, বন্ধু বা সখার মত তাঁকে ভালবাসা এবং তাঁর চরণে সব কর্ম সমর্পণ করে আত্মনিবেদন করা। এছাড়াও ভাগবতে তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক এই তিন প্রকার ভক্তির উল্লেখ আছে। হিংসা ও দম্ভ সহকারে ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি তাকে তামসিক ভক্তি বলে। যশ-খ্যাতি ও ঐশ্বর্য লাভের জন্য ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি জাগ্রত হয় তাকে রাজসিক ভক্তি বলে। ভক্ত সর্বকর্ম ভগবানে সমর্পণ করে মোক্ষলাভের জন্য যে ভক্তি প্রদর্শন করে তাকে সাত্ত্বিক ভক্তি বলে।

ভক্তির লক্ষণ

ভক্তিরসামৃতসিন্ধু নামক গ্রন্থ মতে উত্তম ভক্তির লক্ষণ দুইটি, যথা স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ। কৃষ্ণের অনুকুলে কর্ম করে যাওয়াকে ভক্তির স্বরূপ লক্ষণ এবং সকল কামনা-বাসনা ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাকে হল ভক্তির তটস্থ লক্ষণ বলে। উক্ত বৈষ্ণবগ্রন্থে অধম, মধ্যম ও উত্তম ভেদে ভক্তিকে সাধন-ভক্তি, ভাব-ভক্তি ও প্রেম-ভক্তি এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গণের প্রেরণা অর্থাৎ শ্রবণ, কীর্তন ও দর্শনাদির মাধ্যমে ভক্তের হৃদয়ে যে সামান্য ভক্তি জাগ্রত হয়, তাকে সাধন-ভক্তি বলে। সাধন-ভক্তি দুই প্রকার, যথা বৈধী ও রাগানুগা ভক্তি। অনুরাগ উৎপন্ন হয়নি, শুধু ভগবানের শাসন ভয়ে যে ভক্তি জন্মে, তাকে বৈধী ভক্তি বলে। ঈশ্বরের প্রতি কেবল স্বাভাবিক আকর্ষণবশত যে রাগ বা প্রীতি জন্মায়, তাকে রাগানুগা ভক্তি বলে। বৈধী ভক্তিতে শাস্ত্রের বিধি-নিষেধ থাকে কিন্তু রাগানুগা ভক্তিতে কোন শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ থাকে না। রাগানুগা ভক্তি দুই প্রকার। যথা সম্বদ্ধানুগা ও কামনানুগা। ঈশ্বরের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করে ঐ সম্বন্ধ অনুসারে তাঁর প্রতি যে প্রীতি জন্মে, তাকে সম্বদ্ধানুগা ভক্তি বলে। যেমন শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি ব্রজবাসীর সাথে কৃষ্ণের বন্ধুত্বের সম্বন্ধ ছিল। ঈশ্বরের প্রতি কামনা বা আকর্ষণবশত যে ভক্তি উৎপন্ন হয়, তাকে কামানুগা ভক্তি বলে। কামানুগা ভক্তি দুই প্রকার, যথা সম্ভোগেচ্ছাময়ী এবং তদ্ভাবেচ্ছাময়ী। সম্ভোগের ইচ্ছায় যে ভক্তি করা হয়, তাকে সম্ভোগেচ্ছাময়ী ভক্তি বলে। সম্পূর্ণ নিষ্কাম হয়ে শুধুমাত্র ঈশ্বরের ভাব বা ভালবাসা লাভের ইচ্ছার যে ভক্তি, তাকে তদ্ভাবেচ্ছাময়ী ভক্তি বলে।

পঞ্চপ্রেম বা পঞ্চভাব

এবার আসা যাক ভাব-ভক্তি প্রসঙ্গে। প্রেমের প্রাথমিক অবস্থকে ভাব বলে। ভাবই এক সময় গাঢ় হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। ভাব পাঁচ প্রকার, যথা শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর বা কান্তা। 

শান্ত ভাব

যাতে সুখ নেই, দুঃখ নেই, দ্বেষ নেই, যে প্রেম জন্মালে সর্বভূতে সমভাব বিরাজ করে এবং যে প্রেমের উন্মত্ততা বা গভীরতা নেই, তাকেই শান্ত ভাব বলে। সনকাদি ঋষিগণের মধ্যে শান্তভাব বিরাজ করত।

দাস্য ভাব

ভগবানকে প্রভূ এবং নিজেকে দাস মনে করে ভগবানের সেবাই হল দাস্য ভাব। হনুমান রামচন্দ্রকে দাস্য ভাবে সেবা করতেন।

বাৎসল্য ভাব

ভগবানকে পুত্র বা কন্যার ন্যায় ভালবাসাই হল বাৎসল্য ভাব। কৃষ্ণ ও যশোদার মধ্যে বাৎসল্য ভাব ছিল।

সখ্য ভাব

ভগবানকে বন্ধু বা সখার মত মনে করলে যে ভাবের উদয় হয় তাকেই সখ্য ভাব বলে। শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি গোপবালকগণের সাথে শ্রীকৃষ্ণের সখ্য ভাব ছিল। 

কান্তা বা মধুর ভাব

পতি-পত্নী বা প্রেমীক-প্রেমীকার মধ্যে যে ভালবাসা বা ভাব তাই কান্তা বা মধুর ভাব। ভগবানকে পতি ও নিজেকে পত্নী মনে করে ভজনা করলে কান্তা প্রেমের উদয় হয়। গোপীগণ, রুক্মিণী প্রভৃতি নায়িকার সাথে শ্রীকৃষ্ণের কান্তা ভাব বিরাজিত ছিল। কান্তা ভাব আবার দুই ধরনের। যথা স্বকীয়া-কান্তা আর পরকীয়া কান্তা। পতি ও পত্নীর মধ্যে যে ভালবাসা তাই স্বকীয়া-কান্তা। যেমন শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর মধ্যে স্বকীয়া-কান্তা ভাব ছিল। উপপতির সাথে কুলবধুর যে ভালবাসা তা পরকীয়া-কান্তা নামে খ্যাত। গোপিনীদের স্বামী-সন্তান থাকতেও তাঁরা কামনা-বাসনাশূণ্য হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ভালবেসে গেছেন। গোপীদের এই পরকীয়া-কান্তা প্রেমই শ্রেষ্ঠ। পত্নীরা পতিকে ভালবাসে আবার ভয়ও পায়। কিন্তু পরকীয়া প্রেমে প্রেমীকা সম্পূর্ণ লোকলজ্জার ভয় উপেক্ষা করে তাঁর প্রেমাষ্পদের নিকট ছুটে যায়। গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে ভয় করে না, কেবলই নিষ্কাম হয়ে ভালবাসে। শুধু একবার দর্শনের জন্য তাঁরা সংসারের সব কাজ ফেলে কৃষ্ণের নিকট ছুটে যান। যেহেতু পরকীয়া-কান্তায় বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণই ত্যাগ করতে হয় তাই পরকীয়া কান্তাই-শ্রেষ্ঠ।

মাতৃভাব

শাক্তরা মাতৃভাবে দেবী দুগার্কে উপাসনা করে। শাক্তদের নিকট দেবী দুর্গাই জগজ্জননী। মা যেমন সন্তানকে লালন-পালন করে দেবী দুগার্ও তেমনি জগৎকে লালন-পালন করেন। সন্তান যেমন মা মা বলে তার মায়ের নিকট ছুটে যায় মায়ের আদর পাবার জন্য, শাক্ত ভক্তরাও তেমনি দেবীকে মা বলে ডাকে মাতৃস্নেহ পাওয়ার জন্য। মা যেদিন সন্তানকে কোলে তুলে নিবেন সেদিনই হবে তার মুক্তি। শৈবরা ভগবান শিবকে পিতৃভাবে উপাসনা করেন। পিতা শিবই শৈবদের মুক্তিদাতা। এভাবে ভক্তরা ভগবানের সাথে বিভিন্ন সম্বন্ধ পাতিয়ে তাঁকে প্রেমডোরে বাঁধে।

প্রেমভক্তি

এবার আসা যাক প্রেমভক্তি প্রসঙ্গে। ভাবের পরিণত অবস্থাই প্রেম। অন্যের প্রতি মমতা পরিত্যাগ করে ভগবানে যে মমতা তার নাম প্রেম। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে ভাব হতে চিত্ত সম্পূর্ণ নির্মল হয় এবং যে ভাব অতিশয় মমতাসম্পন্ন, সে ভাব গাঢ় হলে তাকে প্রেম বলে। সুতরাং ভাবই পরিপক্ক হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে, আত্মেন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য যে কার্য করা হয় তাকে কাম বলে আর ঈশ্বরেন্দ্রিয় প্রীতির জন্য যে কার্য করা হয় তাকে প্রেম বলে। উজ্জ্বল-নীলমণি নামক বৈষ্ণবগ্রন্থে আছে ধ্বংসের কারণ সত্ত্বেও যার ধ্বংস হয় না এমন যুবক-যুবতীদ্বয়ের পরস্পর ভাববন্ধনকে প্রেম বলে। ভক্তরা প্রেমের দ্বারাই ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে চান।

ভক্ত কে

এখন প্রশ্ন হল ভক্ত কে? নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে যিনি বিচলিত হন না, যিনি আপন ও পরে সমভাব দেখান, যিনি পরদ্রব্য হরণ করেন না, যিনি কোন জীবে হিংসা করেন না, যার অন্তর ক্রোধশূন্য ও অতি নির্মল তাকেই বিষ্ণুভক্ত বলে জানবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যিনি নির্জনে স্বর্ণ দেখেও তৃণ মনে করে উপেক্ষা করেন, যিনি অন্য চিন্তা পরিত্যাগ করে কেবল ভগবানের চিন্তা করেন, সেই পুরুষকে বিষ্ণুভক্ত বলে বিবেচনা করবে। গীতা অনুসারে তিনিই শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়ভক্ত, যিনি কাউকে হিংসা করেন না, সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও দয়াবান, যিনি সুখে-দুঃখে সমদর্শী ও অহংকারশূন্য, যিনি সদা সন্তুষ্ট, যোগী, সংযত স্বভাবযুক্ত, দৃঢ় বিশ্বাসী, যার মন-বুদ্ধি ঈশ্বরে অর্পিত, যিনি সব বিষয়ে অনাসক্ত, শৌচসম্পন্ন, কর্তব্য-কর্মে অনলস, পক্ষপাতশূন্য, যাকে কিছুতেই মন পীড়া দিতে পারে না, যিনি কর্মফল ত্যাগ করে সর্বকর্ম করেন, যিনি ইষ্টলাভে হৃষ্ট হন না, অপ্রাপ্য বস্তুলাভে আকাক্সক্ষা করেন না, যিনি কর্মের শুভাশুভ ফলাকাক্সক্ষা ত্যাগ করেছেন, যিনি শত্রু-মিত্রে, মান-অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখে-দুঃখে সমদর্শী হন, প্রশংসা ও নিন্দায় যিনি সমভাব প্রদর্শন করেন, যিনি বাকসংযমী, যিনি গৃহাদিতে মমত্ববুদ্ধি-বর্জিত এবং স্থির চিত্তের অধিকারী।

গীতায় উল্লেখিত চার প্রকার ভক্ত

গীতায় চার প্রকার ভক্তের কথা বলা হয়েছে, যথা আর্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী ও জ্ঞানী। যিনি রোগ বা বিপদ হতে মুক্তির আশায় ঈশ্বর ভজনা করেন তিনি আর্ত, যেমন দ্রৌপদী। যিনি আত্মজ্ঞান লাভের জন্য ঈশ্বরের ভজনা করেন তিনি জিজ্ঞাসু, যেমন মুকুন্দ, জনক প্রভৃতি। যিনি ইহলোক ও পরলোকে সুখভোগের জন্য ভজনা করেন তিনি অর্থার্থী, যেমন সুগ্রীব, বিভীষণ প্রভৃতি। যিনি তত্ত্বাদর্শী এবং কোন কিছু লাভের আশায় নয়, শুধু ভগবানকে জেনেছেন এজন্য তাঁকে ভজনা করেন তিনি জ্ঞানী ভক্ত, যেমন প্রহ্লাদ, শুকদেব, সনক প্রভৃতি। জ্ঞানী ভক্তের প্রেম নিষ্কাম অর্থাৎ তারা কোন ধনসম্পত্তি চান না এবং তারা শুধুই ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু-পুরাণে আছে

ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতা বা জগদীশ কাময়ে।

মম জন্মানি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ী।।

অর্থাৎ হে ঈশ্বর, স্বর্ণরত্নাদি ধন, ভৃত্যাদি জন, সুন্দরী স্ত্রী কিংবা পাণ্ডিত্য প্রভৃতি কিছুই চাই না। কিন্তু হে ঈশ্বর, জন্মে-জন্মে যেন তোমার প্রতি আমার কামনা-বাসনাশূন্য ভক্তির উদয় হয়। এরকম নিষ্কাম ভক্তিই ভক্তকে ভগবানের অতি নিকটে নিয়ে যায়।

ভক্তের নিকট ঈশ্বর কেমন

ভক্ত ঈশ্বরকে নিরাকার ভাবতে চান না। তাই ভক্তের নিকট ঈশ্বর সাকার। ভক্ত ঈশ্বরের নানা মূর্তির কল্পনা করে তাঁকে ভজনা করেন। ভক্ত মনে করেন তিনি মন্ত্র-তন্ত্র কছুই জানেন না, সাধনার পদ্ধতিও জানেন না, তিনি শুধু প্রেমের দ্বারা ভগবানকে কাছে পেতে চান। ভগবানও ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না এবং তাঁকে সাকার রূপেই দর্শন দেন।

কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়

অনেক ভক্তরা বলেন, জ্ঞানযোগ হল মিছরির মত অর্থাৎ মিষ্ট কিন্তু নিরস। আবার অনেক জ্ঞানীরা বলেন, ভক্তিযোগ হল দুধের মত, সরস ও সুপেয় বটে কিন্তু মিষ্টতা নেই। যদি দুধের সাথে মিছরি মিশানো হয় তবে তা একটি সরস মিষ্ট খাদ্যে পরিণত হয়। সুতরাং জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়ে সাধনা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ জ্ঞানবিহীন ভক্তি অমিষ্ট এবং ভক্তিবিহীন জ্ঞান নিরস। প্রকৃতপক্ষে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি পৃথকভবে থাকতে পারে না। যিনি পরাভক্তি অর্জন করেছেন তিনি কি জ্ঞানী নন? আবার জ্ঞানী ও ভক্তের কেউই কর্ম না করে থাকতে পারেন না, তাই তাঁরা কর্মীও বটে। এখন প্রশ্ন হল জ্ঞানী কি করে ভক্ত হন? আবার ভক্তই বা কি করে জ্ঞানী হন? জ্ঞানীর ঈশ্বর নিরাকার এবং তিনি যখন সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করেন, তখন হিংসা ভুলে যান, কারণ কাকে হিংসা করবেন? সব কিছুইতো ঈশ্বর। আবার ভক্তের ঈশ্বর সাকার হলেও তিনি যখন পরাভক্তি অর্জন করেন তখন তিনি ঈশ্বরকে বিশেষ কোন স্থানে না দেখে সর্বভূতেই তাঁর রূপ দর্শন করেন। তাই সাধনার চূড়ান্ত স্তরে জ্ঞান ও ভক্তির পার্থক্য কোথায়? জ্ঞানী যখন নিরাকার ঈশ্বরকে সর্বভূতে উপলব্ধি করেন তখন তিনি ভক্ত হন আবার ভক্ত যখন তাঁর সাকার ঈশ্বরকে সর্বভূতে দর্শন করে তখন তিনি জ্ঞানী হন। কর্ম করলে জ্ঞান হয় আর জ্ঞান হলে পরাভক্তি জন্মে। সুতরাং কর্মের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান যখন ভক্তির সাথে যুক্ত হবে তখন মুক্তি আসবে। সাধক তাঁর পছন্দমত এবং সাধ্যানুসারে কর্ম বা জ্ঞান বা ভক্তিযোগ অবলম্বন করে সাধন-জীবন শুরু করলেও সাধনার শেষ স্তরে এসে তিনি দেখেন কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি একাকার হয়ে গেছে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণও কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ যার মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তি উভয়ই আছে, তিনিই শ্রেষ্ঠ। 

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)


এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন



2 comments: