হিন্দু দেবতা
প্রাচীন তত্ত্বাদর্শী ঋষিগণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবতেন
কার শক্তিতে মানুষ জীবন-ধারণ করে? কে মানুষকে লালন-পালন করছেন? কোন শক্তিতে
প্রকৃতি এমন শস্যপূর্ণা হয়ে উঠে? এই শক্তির উৎস্য কোথায়? কি এর রহস্য? এসব
প্রশ্নের উত্তর খুজতে খুজতে তাঁরা দেবতাদের সন্ধান পেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে,
প্রকৃতির সব কিছুর পশ্চাতে কেউ আছেন। প্রাচীনকালে মানুষ কৃষিকাজ ও পশুপালন করে
জীবিকা নির্বাহ করতেন। কৃষিকাজ আর পশুপালন ছিল সম্পূর্ণ প্রকৃতি-নির্ভর। সূর্য,
চন্দ্র, বৃষ্টি, আগুন প্রভৃতি ছাড়া শস্য উৎপাদন ও জীবন-ধারণ অসম্ভব। সূর্য,
চন্দ্র, বৃষ্টি, আগুন এরা কি জড় পদার্থ? ঋষিরা উপলব্ধি করতে পারলেন যে, এরা জড় বা
নিষ্প্রাণ নয়, এরা মূলত ঈশ্বরের চৈতন্যময় শক্তি। এই চৈতন্যময় শক্তি সর্বদা সত্যের
পক্ষে এবং অসত্যের বিপক্ষে ক্রিয়াশীল। ঈশ্বরের যে শক্তি জগতে আলো দিয়ে প্রাণিকুলকে
বাঁচিয়ে রাখেন তিনি সূর্য দেবতা, যে শক্তি জল দান করে প্রাণিকুলকে তৃষ্ণা নিবারণ
করান তিনি বরুণ দেবতা, যে শক্তি বৃষ্টি দান করে পৃথিবীকে শস্যপূর্ণা করে তোলেন
তিনি ইন্দ্র দেবতা, যে শক্তি উত্তাপ প্রদান করে খাদ্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করেন
তিনি অগ্নি দেবতা। দেবতাগণ ঈশ্বরের শক্তি তবে দেবতা অর্থ কিন্তু শক্তি নয়। ‘‘দেবতা’’
শব্দটি এসেছে ‘দিব’ ধাতু হতে যার অর্থ উজ্জ্বল। সূর্য, চন্দ্র, বিদুৎ, অগ্নি
প্রভৃতি উজ্জ্বল বলেই হয়তো ঋষিগণ তাঁদের দেবতা বলে ডাকতেন।
প্রাচীন ঋষিদের চিন্তা-চেতনা ছিল মহৎ ও উদার। তাঁরা
দেখলেন যে, দেবতাদের কৃপা ছাড়া তাঁদের জীবন-ধারণ অসম্ভব এবং তাঁরা উপলব্ধি করলেন
যে, দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে অধর্ম হবে। তাই তাঁরা দেবতাদের
উদ্দেশ্যে প্রশংসামূলক বাক্য নিঃসৃত করতেন এবং উৎসর্গ করতেন তাঁদের প্রিয় সব খাদ্য
সামগ্রী। সোমলতার রস, অজ বা ছাগলের মাংস, পুরোডাশ, মাখন, ঘৃত প্রভৃতি সে যুগের
মানুষদের খুব প্রিয় ছিল। তাই তাঁরা এসব খাদ্য-সামগ্রী দেবতাদের উৎসর্গ করতেন।
কিন্তু বেশির ভাগ দেবতাই তো থাকেন ঐ দূর আকাশে। তবে তাঁদেরকে এসব কিভাবে উৎসর্গ
করতেন? ঋষিরা দেখলেন যে, মর্ত্যে খুব সহজেই যে দেবতাকে পাওয়া যায়, তিনি হলেন অগ্নি।
তাঁরা উপলব্ধি করলেন যে, এই অগ্নিকে হবি (ঘৃত প্রভৃতি দ্রব্য) দিলেই সব দেবতা
পাবেন। অগ্নিই সকল দেবতার নিকট হবি পৌছে দেবেন কারণ অগ্নিই যেন দেবতাদের মুখ ও
পুরোহিত। এভাবে দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই যজ্ঞের সূচনা হয়েছে এবং সেই
দেবতাদের স্তুতি ও যজ্ঞের বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়ে বেদ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদিক যুগের শুরুতে দেবতাদের পৃথকভাবে স্তুতি ও যজ্ঞ করা
হত। পরে ঋষিরা উপলব্ধি করলেন যে, দেবতারা পৃথক নন। এক দেবতাই বিভিন্ন নামে বিভিন্ন
ও বিভিন্ন রূপে অবস্থান করেন। তাই ঋষি কণ্ঠে উচ্চারিত হল- ‘‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা
বদন্তি’’ অথাৎ সেই এক আদিত্যকেই মেধাবীগণ বহু নামে স্তুতি করেন। তাঁরা বুঝতে
পারলেন যে, ইন্দ্র, অগ্নি, সূর্য, মিত্র, বরুণ, রুদ্র, ঊষা প্রভৃতি দেবতা এক
দেবতারই বিভিন্ন নাম। এক ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তিই জগতে বিভিন্ন রূপে বিভিন্নভাবে
প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরের এই প্রকাশিত শক্তিই হল দেবতা। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং তাঁর
শক্তি অসীম। ঐ অসীম শক্তিকে মনন বা চিন্তা করা অসম্ভব আর ঐ অসীম শক্তির ভজনাও
দুঃস্যাধ্য। তাই ঈশ্বরের একেক রূপ বা একেক শক্তিকে একেক দেবতা হিসেবে কল্পনা করা
হয়েছে। সুতরাং দেবতগণ পৃথক নন, তাঁরা একেরই বিভিন্ন রূপ। ঈশ্বর যে এক ও অদ্বিতীয়,
তা ঋগ্বেদের ২য় ম-লের ১ম সূক্তের ৩য় ঋকে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আছে- ‘‘তমগ্ন
ইন্দ্রো বৃষভঃ সতামসি ত্বং বিষ্ণুরুরুগায়ো নমস্যঃ। ত্বং ব্রহ্মা রষিবিদ ব্রহ্ম রষিবিদ্ ব্রহ্মণস্পতে ত্বং বিধর্তঃ সচমে পুরুন্ধ্যা।।’’
অর্থাৎ হে অগ্নি, তুমি সাধুদের মঙ্গলকারী, অতএব তুমি ইন্দ্র, তুমি বিষ্ণু তুমি বহু
লোকের প্রশংসা পাও, তুমি নমস্কারযোগ্য। তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিবিধ পদার্থ সৃষ্টি কর ও বহু
প্রকার বৃদ্ধিতে অবস্থান কর। উক্ত মন্ত্রে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দেবতা বহু নয়।
অগ্নিই ইন্দ্র, অগ্নিই বিষ্ণু আবার অগ্নিই ব্রহ্মা। অতএব ঈশ্বর এক হলেও তিনি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রূপে জগতে প্রকাশিত
হন এবং তাঁর এক একটি রূপকে এক একজন দেবতা বলা হয়। তাই বলা চলে যে, বেদ
একেশ্বরবাদকেই সমর্থন করে। যেহেতু বেদে দেবতাদের পৃথকভাবে স্তুতি ও যজ্ঞ করা হয়েছে
তাই পৃথকভাবে তাঁদের পরিচয় জানা প্রয়োজন।
বেদে দেবতা মোট তেত্রিশ জন এবং তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত।
দ্বাদশ-আদিত্য একাদশ-রুদ্র এবং অষ্ট-বসু মিলে হয় একত্রিশ জন এবং এঁদের সাথে দ্যু ও
পৃথিবী যোগ করলে মোট তেত্রিশ দেবতা হয়। মহাভারতে বর্ণিত দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র এবং অষ্টবসুর নাম নিচের দেয়া
হল-
আদিত্য দেবতাগণঃ বিষ্ণু, অংশ, ভগ, মিত্র, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, জয়ন্ত, ভাস্কর, ত্বষ্টা, ইন্দ্র ও পূষা।
রুদ্র দেবতাগণঃ অজ, একপদ, অহির্ব্রধণ, পিনাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষাকপি, শম্ভু, হবন ও ঈশ্বর।
বসু দেবতাগণঃ ধর, ধ্রুব, সোম, সবিতা, প্রত্যূষ, প্রভাস, অনিল (বায়ু) ও অনল (অগ্নি)।
এছাড়াও বেদে বৃহস্পতি, যম-যমী, ত্রিত, আপ্ত্য,
বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি, ইলা, ভারতী, সরস্বতী, ঋভু, শ্রী, রাত্রী,
অদিতি, ঊষা, অশ্বিদ্বয় প্রভৃতি দেবতার পরিচয় পাওয়া যায়। দেবতাদের অনেকেরই একাধিক নাম
রয়েছে। তাই দেবতা ৩৩ জনের অধিক মনে হতে পারে কিন্তু বেদের মন্ত্রেই ৩৩ জন দেবতার
কথা বলা আছে।
যাস্ক ঋষির মতে বেদের দেবতার তিন শ্রেনীতে বিভক্ত, যথা-
মর্ত্যের দেবতা, অন্তরীক্ষের দেবতা এবং দ্যুলোকের দেবতা। মর্ত্যের দেবতারা হলেন-
অগ্নি, অপ, পৃথিবী ও সোম দেবতা। অন্তরীক্ষের দেবতারা হলেন- ইন্দ্র, বায়ু, রুদ্র,
মরুৎ, অপাং, নপাৎ, পর্জন্য প্রভৃতি এবং দ্যুলোকের দেবতা হলেন সূর্য, মিত্র, বরুণ,
দ্যু, পূষা, সাধতা, আদিত্য, অশ্বিদয়, উষা, রাত্রি প্রভৃতি।
এবার আসা যাক পৌরাণিক দেবতা প্রসঙ্গে। বেদে যে ঘটনার বীজ
বপন করা হয়েছে, পুরাণের মাধমে তা বিশাল শাখা-প্রশাখা সমন্বিত বটবৃক্ষে পরিণত
হয়েছে। বেদে ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা হলেও পুরাণে ইন্দ্র শুধু বৃষ্টির দেবতাই নয়,
তিনি স্বর্গের রাজাও বটে। তিনি যে কত উপাখ্যানের নায়ক তা বলে শেষ করা যাবে না। বেদে ইন্দ্রকে বলা হয়েছে শচীপতি। শচীপতি অর্থ শচী
নামক রমণীর পতি নয়। বেদে ‘‘শচীপতি’’ অর্থ যজ্ঞপতি অর্থাৎ যজ্ঞের অধীশ্বর। কিন্তু
পুরাণে বলা হয়েছে ইন্দ্রের স্ত্রীর নাম শচী। এরকম বেদের অনেক উপমাকে পুরাণে গল্পের
আকার দেয়া হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।
বেদে ঈশ্বর নিরাকার হলেও পুরাণে সাকার। মূলত পুরাণের হাত
ধরেই শুরু হয় ভক্তিবাদের। ঈশ্বরের অনন্ত-অসীম ভাবটি উপলব্ধি করা খুবই দুঃসাধ্য
কিন্তু সাকার রূপে তাকে সহজেই কল্পনা করা যায় এবং স্থান দেয়া যায় হৃদ-কমলে। অর্থাৎ
ঈশ্বরের সাকার রূপে যতটা ভক্তি উৎপন্ন হয়, নিরাকারে ততটা হয় না। তবে পুরাণে বর্ণিত
দেবতাদের ঐ রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর দর্শন এবং বিভিন্ন উপাখ্যানে রয়েছে
নানা নৈতিক শিক্ষার উপকরণ। বেদের শ্রী দেবতা পুরাণে হয়েছেন লক্ষ্মী, বেদের রাত্রী
দেবতা পুরাণে হয়েছেন কালী, বেদের রুদ্র দেবতা পুরাণে হয়েছেন শিব, সূর্য হয়েছেন
বিষ্ণু, বৃহস্পতি হয়েছেন ব্রহ্মা।
পৌরাণিক দেবতাদের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার একটা রূপক তাৎপর্য আছে। যেমন- দুর্গার
দশহাত দ্বারা দশদিক বোঝায়, কালীর চারহাত দ্বারা চতুর্বর্গ বোঝায়, ব্রহ্মার চার-মুখ চার-বেদ প্রকাশক। এরকম
প্রত্যেক পৌরাণিক দেবতার স্বরূপ সম্যকভাবে না বুঝতে পারলে শাস্ত্র পাঠ বৃথা।
পুরাণে দেবতাদের সংখ্যা নিদিষ্ট নয়। দেবতাদের পৃথক পৃথক
রূপের বর্ণনা থাকলেও পুরাণ স্বীকার করে যে, দেবতারা হলেন এক ঈশ্বরের শক্তি। অগ্নির
যে দহন-শক্তি রয়েছে তাকে অগ্নি থেকে পৃথক করা যায় না, তদ্রূপ ঈশ্বরের শক্তিকেও
ঈশ্বর থেকে পৃথক করা যায় না। অর্থাৎ ঈশ্বর এবং তাঁর শক্তি অভেদ। দেবতারা কেবল এক ঈশ্বরেরই
বিভিন্ন শক্তির নামান্তর মাত্র। পুরাণও এই কথাই বলে যে, ঈশ্বর যখন আলো দেন তখন
তিনি সূর্য, যখন জল দেন তখন তিনি বরুণ, যখন বৃষ্টি দেন তখন তিনি ইন্দ্র, যখন
সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা,
যখন পালন করেন তখন তিনি বিষ্ণু আর যখন লয় করেন তখন তিনি শিব। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব হলেন ঈশ্বরের তিন মূর্তি।
ব্রহ্মার শক্তি
সরস্বতী, বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী এবং শিবের শক্তি দুর্গা। আবার শাস্ত্রে পাই
মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী হলেন দেবী দুর্গা বা চণ্ডীরই অন্য রূপ আবার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবও একজনই। তাহলে বলা যায় কেবল
এক শক্তিমান ঈশ্বর ও তাঁর শক্তি রয়েছে। শক্তি ছাড়া শক্তিমানের অস্তিত্ব থাকতে পারে
না আবার শক্তিও শক্তিমানকে আশ্রয় না করে ক্রিয়াশীল হতে পারে না। তাই শক্তি ও
শক্তিমান পৃথকভাবে থাকতে পারে না। এক ঈশ্বরই বিষ্ণু হয়েছেন, আবার লক্ষ্মীও হয়েছেন।
অতএব পুরাণকে সুচারু রূপে বিশ্লেষণ করলে ঐ এক ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
পরমাত্মা থেকে ভগবান সৃষ্টি ভগবান থেকে দেব দেবী সৃষ্টি দেব দেবী প্রাণী জগৎ সৃষ্টি তাই 1 ভগবান ছাড়াই কিছু চিনি না
উত্তরমুছুনভগবানকে সাধনা করা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ তাইতো আমিও ভগবানকে ডাকছি আর তোমরা ও ভগবানকে ডাকো ।
উত্তরমুছুনআপনার লেখা পড়ে অনেক অজানা তথ্য অবগত হল। ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনপঞ্চভূতের দেবতা কারা?
উত্তরমুছুনক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম
হ্যা
মুছুনএই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅগ্নিদেবের জন্মরহস্য
উত্তরমুছুনhttps://www.youtube.com/watch?v=8zVLnbt4HwQ