7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

মহাভারতের কাহিনী

মহাভারতের কাহিনী

    সংক্ষিপ্তরূপে মহাভারতের কাহিনী শুরু করছি। মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ মহাভারত রচনা করেন। মহাভারতে ধর্ম, রাজনীতি, রণকৌশল, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, গার্হস্থ্যধর্ম, রাজধর্ম প্রভৃতি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এজন্য কথিত আছে “যা নেই মহাভারতে তা নেই ভারতে”। মহাভারতে মূলত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন, ভরণী নক্ষত্রে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে আঠার দিন পর অমাবস্যা তিথিতে শেষ হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় যুধিষ্ঠিরের বয়স ছিল ৭২ বছর, ভীমের ৭১ বছর, অজুনের ৭০ বছর এবং নকুল ও সহদেবের ৬৯ বছর। মহাভারতের চারটি স্তম্ভ, যথা ধর্শ, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মহাভারতের আঠারটি পর্বে মোট এক লক্ষ শ্লোক রয়েছে। ১৮টি পর্বের নাম আদি, সভা, বন, বিরাট, উদ্যোগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, সৌপ্তিক, স্ত্রী, শান্তি, অনুশাসন, অশ্বামেধিক, আশ্রমবাসিক, মৌষল, মহাপ্রস্থানিক ও স্বর্গারোহন পর্ব। সম্পূর্ণ মহাভারত রচনা করতে মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যাসদেবের তিন বৎসর সময় লেগেছিল। গণেশ মহাভারতের লিপিকার। নিচে মহাভারতের সংক্ষিপ্ত কাহিনী বর্ণনা করা হল।

মহাভারত

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১

    চন্দ্রপুত্র বুধের ঔরসে মনুর কন্যা ইলার গর্ভে পুরূরবা নামক এক পুত্রের জন্ম হয়। পুরূরবার পুত্রের নাম আয়ু এবং আয়ুর পুত্রের নাম নহুষ। নহুষপুত্র যযাতি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। যযাতির ঔরসে এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু নামের তিনটি পুত্রের আর দেবযানীর গর্ভে তুর্বসু ও যদু নামের দুইটি পুত্রের জন্ম হয়। এই যদু হতেই যদু বংশের এবং কনিষ্ঠ পুত্র পুরু হতে পুরু বংশের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুবংশের রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে বিয়ে করেন এবং শকুন্তলার গর্ভে জন্ম নেন মহারাজ ভরত। বর্তমান ভারতবর্ষের নামটি এসেছে রাজা ভরতের নাম অনুসারে। ভরতের বংশে হস্তী নামের এক রাজা ছিলেন। তিনি নিজের নামানুসারে হস্তিনাপুর নামক এক নগর স্থাপন করেন। হস্তীর তিন পুরুষ পরে রাজা হন সম্বরণ। সম্বরণের ঔরসে এবং সূর্যকন্যা তপতীর গর্ভে জন্ম নেন রাজা কুরু। রাজা কুরু যে স্থানে তপস্যা করেছিলেন সে স্থানের নাম হয় পবিত্র কুরুক্ষেত্র। যেহেতু কুরুক্ষেত্র ছিল তপস্যার স্থান সেহেতু কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্রও বলা হয়।

    মহারাজ কুরুর ছয় পুরুষ পরে জন্য নেন প্রতীপ। রাজা প্রতীপের শান্তনু নামক এক পুত্র হয়। একদিন রাজা শান্তনু গঙ্গাতীরে এক পরমা সুন্দরী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন। কন্যাটিও শান্তনুকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কিন্তু একটি শর্তে, তাঁর কোন কাজে বাঁধা দেয়া হলে তিনি তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। শান্তনু তাঁর শর্ত মেনে নিয়ে সংসার করতে শুরু করলেন। তারপর রাজা শান্তনুর সাতটি পুত্রের জন্ম হল। কিন্তু ঐ সাতটি পুত্রকেই তাঁর স্ত্রী এক এক করে জলে ফেলে দিলেন আর তিনিও শর্তের কথা ভেবে বাধা দিতে পারলেন না। অষ্টম পুত্র জলে ফেলে দেয়ার সময় শান্তনু বাধা দিলে শর্তানুযায়ী তাঁর স্ত্রী সবকিছু ছেড়ে অষ্টম পুত্রকে নিয়ে চলে যান। আসলে যিনি শান্তনুর স্ত্রী হয়েছিলেন, তিনিই দেবী গঙ্গা আর ঐ অষ্টম সন্তান হলেন অষ্টবসু। ব্রহ্মার শাপে গঙ্গাকে মর্তে্য শান্তনুর স্ত্রী হতে হয়েছিল এবং বশিষ্ঠ মুনির শাপে অষ্টবসুগণকে মর্তে্য এসে মনুষ্য রূপে জন্ম নিতে হয়েছিল। শান্তনুর অষ্টম পুত্র ছিলেন দ্যু নামক বসু। গঙ্গা একদিন তাঁর অষ্টম পুত্রকে লালন-পালন করের এবং বশিষ্টের নিকট হতে বেদ অধ্যয়ন করতে পাঠান। তারপর একদিন গঙ্গা ঐ পুত্রকে শান্তনুর কাছে রেখে চলে গেলেন। এই অষ্টম পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল দেবব্রত যিনি পরে ভীষ্ম নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২

    শান্তনু একদিন যমুনা তীরবর্তী বনে বেড়াতে গিয়ে মৎস্যগন্ধা নামক এক রূপবতী নারীর সন্ধান পান। ধীবরের (জেলের) কন্যা মৎস্যগন্ধা খেয়া পারাপার করতেন অর্থাৎ তিনি পাটনী ছিলেন। মৎস্যগন্ধা সত্যবতী নামেও পরিচিতা ছিলেন। শান্তনু সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁর পিতা দাসরাজের কাছে গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানকেই রাজা করতে হবে এই একটি শর্তে দাসরাজ মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শান্তনু তাঁর পুত্র ভীষ্মের কথা ভেবে ঐ শর্তে রাজি না হয়ে মনঃকষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। পিতাকে চিন্তিত দেখে ভীষ্ম রাজমন্ত্রীকে পিতার চিন্তার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। রাজমন্ত্রী তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। তারপর ভীস্ম দাসরাজের কাছে গিয়ে পিতার জন্য সত্যবতীকে প্রার্থনা করলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, সত্যবতীর গর্ভের সন্তানই রাজা হবে। কিন্তু তাতেও দাসরাজ সন্তুষ্ট নন এই ভেবে যে, যদি ভীষ্মের পুত্র রাজা হতে চান তবে সত্যবতীর পুত্র রাজা হতে পারবে না। তখন ভীষ্ম প্রতীজ্ঞা করলেন যে, তিনি কখনও বিবাহ করবেন না। ভীষ্মের এই প্রতীজ্ঞা শুনে দেবগণ ও পিতৃগণ পুষ্প-বৃষ্টি করতে লাগলেন। রাজা শান্তুনু ভীষ্মের পিতৃভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন। তারপর সত্যবতীর সাথে রাজা শান্তনুর বিয়ে হল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৩

    সত্যবতীর গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামের দুই পুত্রের জন্ম হয়। পুত্রদের শৈশবকালেই রাজা শান্তনু গত হন। গন্ধর্বরাজের সাথে যুদ্ধে চিত্রাঙ্গদ প্রাণ হারালে বিচিত্রবীর্য সিংহাসনে বসেন। ভীষ্ম ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে নিয়ে আসলেন। জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বা জানালেন যে, তিনি শাল্বরাজকে ভালবাসেন। তাই ভীষ্ম অম্বাকে ছেড়ে দিলেন এবং অপর দুই বোনের সাথে বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দিলেন। সাত বৎসর পর কোন সন্তান হওয়ার আগেই বিচিত্রবীর্য মারা যান। তাই বংশরক্ষার জন্য সত্যবতী ভীষ্মকে ঐ দুই বিধবা ভ্রাতৃবধুকে বিয়ে করতে বললেন। কিন্তু ভীষ্ম তাঁর প্রতীজ্ঞা লঙ্ঘন করতে অসম্মত হলেন। অগত্যা সত্যবতী বংশরক্ষার জন্য তাঁর পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে ডাকলেন। সত্যবতী যখন কুমারী ছিলেন তখন পরাশরের ঔরসে তাঁর গর্ভে কৃষ্ণদ্বৈপায়নের জন্ম হয়েছিল। দ্বীপে জন্ম এবং গায়ের বর্ণ কালো বলেষ্ণ তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন নামে পরিচিত হলেন। পরে তিনি বেদকে চার খণ্ডে বিভক্ত করে ব্যাসদেব নামে খ্যাত হলেন। যা হোক, সত্যবতীর অনুরোধে পুত্র উৎপাদনের জন্য অম্বিকা ও অম্বালিকা কৃষ্ণদ্বৈপায়নের নিকট গেলেন। অম্বিকা কৃষ্ণদ্বৈপায়নের গৃহে গিয়ে ভয়ে চোখ বুজে ছিলেন বলে তাঁর গর্ভের সন্তান জন্মান্ধ হল আবার অম্বালিকা কৃষ্ণ-দ্বৈপায়নকে দেখে পাণ্ডু বর্ণ ধারণ করেছিলেন বলে তাঁর গর্ভের পুত্রের পাণ্ডু বর্ণ ধারণ করল। অম্বিকার পুত্রের নাম রাখা হল ধৃতরাষ্ট্র আর অম্বালিকার পুত্রের নাম রাখা হল পাণ্ডু। অম্বিকা ঋতুবতী হলে সত্যবতী তাঁকে পুনরায় ব্যাসের কাছে যেতে বললেন কিন্তু অম্বিকা নিজে না গিয়ে পাঠালেন এক দাসীকে। ঐ দাসীর গর্ভে জন্ম নিলেন বিদুর। যিনি পরম ধার্মিক হিসেবে জগতে খ্যাত হয়েছিলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৪

    ধৃতরাষ্ট্র জেষ্ঠ পুত্র হলেও জন্মান্ধ বলে রাজা হলেন পাণ্ডু। ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সথে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে দিলেন। তারপর ভীষ্ম শূরের কন্যা কুন্তীর সাথে পাণ্ডুর বিয়ে দিলেন। এবার একটু কুন্তীর ইতিহাস বর্ণনা করা যাক। পূর্বে কুন্তীর নাম ছিল পৃথা। শূর তাঁর কন্যা পৃথাকে দান করেন পিসতুত ভাই কুন্তিভোজকে। কুন্তিভোজ নিঃসন্তান ছিলেন বলে পরম যত্নে পৃথাকে লালন-পালন করেছিলেন। কুন্তিভোজের ঘরে পালিত হয়েছেন বলে পৃথার নাম কুন্তী নামে পরিচিতা হলেন। একদিন দর্বাসা মুনি কুন্তীর অতিথিসেবায় তুষ্ট হয়ে বর দিলেন যে, কুন্তী যে দেবতাকে আহবান করবেন, সে দেবতা তাঁকে দর্শন দেবেন এবং ঐ দেবতার কৃপায় তিান পুত্র লাভ করবেন। কুন্তী কুমারী অবস্থায় কৌতুহলবশত সূর্যকে আহবান করেছিলেন। তখন সূর্য এসে দেখা দিলেন এবং পুত্র লাভের বর দিলেন। তারপর কুন্তীর একটি পুত্র জন্ম নিল। পুত্রটি কবচ ও কুণ্ডল নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। কলঙ্কের ভয়ে কুন্তী তাঁর পুত্রকে পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দিলেন। সূত-বংশীয় অধিরথ এবং তাঁর পত্নী রাধা সেই শিশুকে পেয়ে লালন-পালন করতে থাকেন এবং তাঁর নাম রাখেন বসুষেণ। এই বসুষেণ পরে কর্ণ নামে খ্যাত হন। কর্ণ খুবই দানশীল ছিলেন। একদিন ইন্দ্র ব্রাহ্মণ বেশে এসে তাঁর কাছে কবচ (বর্ম) ও কুণ্ডল চাইলেন। কর্ণ সে কবচ দেহ থেকে কেঁটে বের করে এনে ইন্দ্রকে দান করলেন। ইন্দ্র তুষ্ট হয়ে তাঁকে একটি শক্তি অস্ত্র দিলেন। অস্ত্রটির বৈশিষ্ট্য এমন এটি যাকে উদ্দেশ্য করে নিক্ষেপ করা হবে তিনি অবশ্যই মরবেন এবং মরার পর ঐ অস্ত্র আবার তার কাছে ফিরে আসবে। যা হোক, কুন্তীর স্বয়ংবর-সভায় কুন্তী পাণ্ডুর গলেই বরমাল্য দিলেন। তারপর পাণ্ডু কুন্তীকে বিয়ে করে হস্তিনাপুর নিয়ে এলেন। কিছুদিন পর ভীষ্ম মদ্ররাজ শল্যের বোন মাদ্রীর সাথে পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহ দিলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৫

    ব্যাসদেব গান্ধারীকে বর দিয়েছিলেন তিনি শতপুত্রের জননী হবেন। কিন্তু গান্ধারী গর্ভবতী হওয়ার পর দুবছর পর্যন্ত কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়নি। গান্ধারী এ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নিজেই গর্ভপাত ঘটালেন। ফলে তিনি একটা লোহার মত মাংস-পিণ্ড প্রসব করলেন। ব্যাসের উপদেশে মাংস-পিণ্ড জলে ভিজিয়ে রাখলে তাতে একশত ভ্রুণ উৎপন্ন হল। ঐ একশত ভ্রুণকে একশত ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখা হল। এক বৎসর পর দুর্যোধনাদি শতপুত্র এবং এক কন্যা দুঃশলার জন্ম হল। দুর্যোধনের জন্মের পূর্বেই কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হল। কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভে পাঁচ পুত্র জন্মেরও এক ইতিহাস আছে। একদিন পাণ্ডু বনে মৃগয়ায় গিয়ে এক হরিণযুগলকে মৈথুনরত অবস্থায় শরবিদ্ধ করেছিলেন। কিমিন্দম মুনিই হরিণের রূপ ধারণ করে পুত্র লাভের আশায় মৈথুন করছিলেন। কিমিন্দম মুনি ব্রাহ্মণ হত্যার অপরাধে পাণ্ডুকে শাপ দিলেন যে, তিনিও ভার্যাগমনকালে মৃত্যুবরণ করবেন। পাণ্ডু শাপগ্রস্ত হয়ে খুব চিন্তিত হলেন এবং নিজেকে সংযম করে মুনি-ঋষির মত অরণ্যবাসী হতে চাইলেন। কিন্তু পত্নীদের অনুরোধে তাঁদেরকেও সাথে নিলেন। তারপর পাণ্ডু একদিন কুন্তীর নিকট বংশরক্ষা বিষয়ে আলোচনা করলেন। পাণ্ডু চাইলেন তাঁদের যেভাবে জন্ম হয়েছিল, কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভেও সেভাবে পুত্র উৎপন্ন করতে। তখন কুন্তী তাঁকে দুর্বাসার দেয়া বরের কথা বললেন। তারপর পাণ্ডুর সম্মতিতে কুন্তী ধর্মকে আহবান করলেন, ফলে ধর্মের ঔরসে জন্ম নিলেন যুধিষ্ঠির। তারপর কুন্তী বায়ু ও ইন্দ্রকে আহবান করায় তাঁদের ঔরসে ভীম ও অর্জুনের জন্ম হল। এরপর কুন্তী মাদ্রীর গর্ভেও সন্তান উৎপাদন করতে চাইলেন এবং মাদ্রীকে কোন এক দেবতাকে আহবান করতে বললেন। মাদ্রী তখন অশ্বিদ্বয়কে আহবান করায় তাঁদের বরে নকুল ও সহদেব নামে জমজ পুত্রদ্বয় লাভ করলেন। তারপর একদিন মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সংযম হারলেন এবং ঐ মুনির বাক্য অনুযায়ী মৃত্যুবরণ করলেন। মাদ্রী সেই শোকে তাঁর দুই পুত্রকে কুন্তীর হাতে তুলে দিয়ে সহমরণে চলে গেলেন। আশ্রমে কিছুদিন কাটানোর পর ঋষিদের সহায়তায় কুন্তি পাঁচপুত্র সহ হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন। তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোল, ভীমের পনের, অজুর্নের চৌদ্দ এবং নকুল-সহদেবের তের বৎসর।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৬

    হস্তিনাপুরে পণ্ডুর পুত্ররা পাণ্ডব এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা কৌরব নামে পরিচিত ছিলেন। পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষার হাতেখড়ি ঘটে কৃপাচায্যের্র নিকট। পরে ভীষ্ম দ্রোণের অস্ত্র-প্রতীভায় মুগ্ধ হয়ে দ্রোণকেই পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রগুরু হিসেবে নিযুক্ত করলেন। দ্রোণ কিন্তু ব্রাহ্মণের সন্তান। তাঁর পিতা হলেন গঙ্গোত্তরী প্রদেশের ভরদ্বাজ ঋষি। তাঁর জন্ম হয়েছিল দ্রোণের (কলস) মধ্যে সে জন্য তিনি দ্রোণ নামেই খ্যাত হলেন। দ্রোণ অগ্নিবেশ্য মুনির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। তিনি পরশুরামের নিকটও অনেক অস্ত্র লাভ করেন। অস্ত্রবিদ্যায় রাজকুমারদের মধ্যে সব থেকে পারদর্শী ছিলেন অজুর্ন। তাই দ্রোণ সব শিষ্য থেকে অজুর্নকে বেশি ভালবাসতেন।

    ভীষ্ম, বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিতে দ্রোণাচার্য একদিন রাজকুমারগণের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। একে একে সব রাজকুমারগণ অস্ত্র-কৌশল প্রদর্শন করলেন। অস্ত্র-কৌশল প্রদর্শন অনুষ্ঠানে কর্ণও উপস্থিত ছিলেন। অজুর্ন যে সব অস্ত্র-কৌশল প্রদর্শন করলেন, দ্রোণের অনুমতি নিয়ে কর্ণও তা করে দেখালেন। তারপর কর্ণ অজুর্নের সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অজুর্নও কর্ণকে যুদ্ধের আমন্ত্রন জানালেন। দ্রোণের অনুমতিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হল। দুর্যোধন ও তার ভ্রাতাগণ কর্ণের পক্ষে যোগ দিল। ভীষ্ম, বিদুর, কৃপাচার্য ও দ্রোণাচার্য রইলেন অজুর্নের পক্ষে। কুন্তী কর্ণকে চিনতে পেরে মূর্ছিত হলেন। ফলে সকলের নিকট পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে গেল। রাজাগণ নীচ জাতি এবং রাজা ভিন্ন অন্য কারো সাথে যুদ্ধ করেন না। তাই কৃপাচার্য কর্ণের পরিচয় জানতে চাইলেন। তখন দুর্যোধন বললেন, “অজুর্ন যদি রাজা ভিন্ন অন্য করো সাথে যুদ্ধ করতে না চান তবে কর্ণকে আমি অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করছি”। দুর্যোধন কর্ণর্কে রাজা করায় যুদ্ধে আর বাধা থাকল না। কিন্তু হঠাৎ করে কর্ণের পালক পিতা সূতবংশীয় অধিরথ সেখানে উপস্থিত হলে কর্ণর্ তাকে প্রণাম করে আলিঙ্গন করলেন। তখন সবাই জেনে গেল যে, কর্ণ সূতপুত্র। ভীম কর্ণর্কে সূতপুত্র বলে তিরস্কার করলেন। নীচ জাতির সাথে কোন রাজার যুদ্ধ হতে পারে না, তাই শেষ পর্যন্ত অজুর্ন ও কর্ণের্র যুদ্ধ হল না। তবে সকলেই জেনে গেল যে, কর্ণের্র তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে বিরল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৭

    পাণ্ডবরা ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ণ অথচ কৌরবরা ছিলেন ঠিক তাঁদের বিপরীত। কৌরবরা কখনই পাণ্ডবদের ভাল চাইত না। দুর্যোধন একবার গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে ছল করে ভীমকে বিষ খাইয়ে অচেতন করে জলে ফেলে দিলেন। ভীম তখন জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে চলে গেলেন। পরে নাগরাজ বাসুকির সহায়তার সুস্থ হয়ে অযুত হস্তীর বল লাভ করে ফিরে এলেন। কিছুদিন পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। এতে দুর্যোধনাদি কৌরবগণ ঈর্ষান্বিত হলেন। পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য দুর্যোধন তার মাতুল সুবলপুত্র শকুনি ও কর্ণের সাথে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। দুর্যোধন ও তার মাতুল শকুনির মন্ত্রণায় ধৃতরাষ্ট্র পঞ্চ-পাণ্ডব ও কুন্তীকে পশুপতি উৎসব দেখার নাম করে বারণাবত নামক নগরে পাঠান। সেখানে তাঁদের বসবাসের জন্য দুযোর্ধন পুরোচন নামক এক মন্ত্রীর সহায়তায় জতুগৃহ (গালা দ্বারা তৈরী গৃহ) নির্মাণ করে রাখেন। দুর্যোধনের অভিপ্রায় ছিল পুরোচনের সাহায্যে ঐ জতুগৃহে আগুন দিয়ে পাণ্ডবদের মেরে ফেলা। কিন্তু পাণ্ডবরা বিদুরের অনুচরের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে, কৃষ্ণ-চতুর্দশীর রাতে পুরোচন জতুগৃহে আগুন দেবেন। তাই তাঁরা বিদুরের ঐ অনুচরের সহায়তায় গৃহের মধ্যে সুরঙ্গ তৈরী করে রাখেন। পাণ্ডবগণ কৃষ্ণ-চতুর্দশী আসার আগেই জতুগৃহে আগুন দিয়ে সুরঙ্গপথে গঙ্গা পেরিয়ে গহীন অরণ্যে পলিয়ে গেলেন। দুর্যোধনাদি অন্য ছয় জনের দগ্ধ মৃতদেহ দেখে ভাবলেন পাণ্ডবগণ ও কুন্তী মারা গেছেন। মূলত ঐ ছয় জন ব্যক্তি ছিলেন এক নিষাদ-স্ত্রী ও তার পাঁচ পুত্র যারা ঐ দিন ঐ গৃহে এসেছিলেন ভোজন করতে। খবর শুনে হস্তিনাপুরে শোকের ছায়া নেমে এল। কেবল বিদুরই প্রকৃত ঘটনা জানতেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৮

    পাণ্ডবরা যে বনে ঘুমাচ্ছিলেন তার কিছু দূরেই একটি শালগাছে হিড়িম্ব ও হিড়িম্বা নামে দুই রাক্ষস-রাক্ষসী বাস করত। তারা ছিল ভাই-বোন। পাণ্ডবদের দেখে হিড়িম্ব তার বোন হিড়িম্বাকে পাঠাল তাঁদের ধরে নিয়ে আসতে। কিন্তু হিড়িম্বা সুপুরুষ ভীমকে দেখে তাঁর প্রেমে পড়ে যায় এবং পাণ্ডবদের বধ করার কথা ভুলে যায়। হিড়িম্বা সুন্দরী রমণীর বেশ ধরে ভীমের কাছে যায় এবং পাণ্ডবদের বাঁচানোর জন্য হিড়িম্বের দুরভিসন্ধির কথা বলে দেয়। হিড়িম্বার মুখে সব কথা শুনে ভীম হিড়িম্বের নিকট যান এবং হিড়িম্বকে একাই বধ করেন। হিড়িম্বা কুন্তীর নিকট ভীমকে পতি হিসেবে প্রার্থনা করলে কুন্তীও সম্মত হন। তারপর ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার গর্ভে এক পুত্রের জন্ম হয়। তার মাথা ঘটের মত এবং চুল খাড়া বলে তার নাম দেয়া হয় ঘটোৎকচ। যখন তাকে ডাকা হবে, তখনই সে হাজির হবে একথা বলে ঘটোৎকচ চলে গেল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-৯

    পাণ্ডবরা বল্কল ও মৃগচর্ম পরিধান করে তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় পিতামহ ব্যাসের সাথে দেখা হয়ে গেল। তখন ব্যাস তাঁদের একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে রেখে আসলেন। সেই নগরে একবার বক-রাক্ষসের দৌরাত্ম্যে লোকজন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মাতার আদেশে ভীম বক-রাক্ষসকে বধ করেন। পরে তাঁরা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যোগদানের জন্য পাঞ্চালদেশে যাত্রা শুরু করেন। একদিন পর তাঁরা গঙ্গাতীরে সোমাশ্রয়ণ তীর্থে যান। সেখানে গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ সস্ত্রীক ভ্রমণে এসে পাণ্ডবদের দেখে হিংসিত ও কুপিত হলেন। চিত্ররথ তাঁদের আক্রমন করলে অজুর্ন তা প্রতিহত করেন এবং গন্ধর্বরাজের রথ দগ্ধ করে ফেলেন। অজুর্ন যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে গন্ধর্বরাজের প্রাণভিক্ষা দেওয়ায় গন্ধর্বরাজ তাঁদের বন্ধু হয়ে গেলেন। গন্ধর্বরাজ পাণ্ডবদের চাক্ষুষী-বিদ্যা ও আগ্নেয়াস্ত্র দান করে প্রস্থান করেন। পরে পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণের বেশে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যোগদান করেন।

    দ্রৌপদী কিন্তু রাজা দ্রুপদের ঔরসজাত কন্যা নয়। একবার রাজা দ্রুপদ দ্রোণের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ও পুত্র কামনায় যাজ ও উপযাজ নামক দুই ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হন। তাঁদের নির্দেশমত তিনি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলে যজ্ঞের অগ্নি থেকে অগ্নিবর্ণের, বর্ম-মুকুটভূষিত, খড়গ-ধনুর্বাণধারী এক কুমার এবং শ্যামবর্ণের এক পরমা সুন্দরী কুমারী উঠে আসলেন। ঐ অগ্নিবর্ণের কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শ্যামবর্ণের কুমারী কৃষ্ণা নামে খ্যাত হলেন। দ্রুপদের কন্যা বলে কৃষ্ণা দ্রৌপদী নামে পরিচিতা হলেন। দ্রুপ দ্রুৌপদীকে অজুর্নের সাথে বিবাহ দিতে চাইলেন। তাই তিনি এমন এক ধনু নির্মাণ করালেন যাতে গুণ পড়ানো দুঃসাধ্য। তিনি শূন্যে স্থাপিত একটি যন্ত্রের উপর একটি লক্ষ্যবস্তু রাখলেন এবং শর্ত দিলেন যে, যিনি এই ধনুতে গুণ লাগিয়ে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করতে পারবেন তিনিই হবেন তাঁর কন্যার বর। রাজা দ্রুপদ দ্রৌপদীকে বিবাহ করার কঠিন শর্ত দিলেন কারণ তিনি জানতেন যে, ঐ লক্ষ্যভেদ একমাত্র অজুর্ন ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

    দ্রৌপদীর সয়ংসভার দিন সভায় উপস্থিত রাজারা একে একে লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই লক্ষ্যভেদ তো দূরের কথা, ধনুতে গুণই লাগাতে পারলেন না। কর্ণ সেই ধনুতে গুণ লাগিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে যাবেন এমন সময় দ্রৌপদী উচ্চস্বরে বললেন, আমি সূতজাতীয়কে বরণ করব না। কর্ণ অগত্যা লজ্জিত হয়ে ধনু পরিত্যাগ করলেন। তাঁরপর ব্রাহ্মণবেশী অজুর্ন সেই ধনুতে গুণ লাগিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন এবং দ্রৌপদীর বরমাল্য গ্রহণ করলেন। তারপর পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে নিয়ে তাঁদের আশ্রয়দাতা কুম্ভকারের গৃহে এসে আনন্দিত মনে কুন্তীকে জানালেন যে, তাঁরা ভিক্ষা এনেছেন। কুন্তী না দেখেই গৃহের ভেতর থেকে বলে বসলেন, “তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর”। পরে দ্রৌপদীকে দেখে কুন্তীর ভুল ভাঙল। কিন্তু মাতৃআজ্ঞা পালনের জন্য পঞ্চ-ভ্রাতাই দ্রৌপদীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করলেন। এ কার্যে অজুর্নেরও সম্মতি ছিল। পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফলে দ্রৌপদীর পঞ্চ-স্বামী লাভ করেছেন। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী ছিলেন মুনিকন্যা। তিনি তপস্যা করে মহাদেবকে তুষ্ট করলেন এবং বর চাইলেন যে, তিনি যেন সর্বগুণান্বিত পতি লাভ করেন। তিনি পাঁচবার এই বর চাওয়ায় মহাদেব তাঁকে বললেন, “পরজন্মে ভরতবংশীয় পাঁচপুুত্র তোমার পতি হবেন”। পূর্বজন্মের এই বরেই তিনি পঞ্চস্বামী লাভ করলেন। কিন্তু রাজা দ্রুপদ তা মেনে নিতে চাইলেন না। তাই ব্যাস তাঁকে বোঝালেন যে, এই পঞ্চ-পাণ্ডব মূলত ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বীদ্বয়ের ঔরাসজাত পুত্র। মহাদেবের ইচ্ছায় ঐ পঞ্চ-দেবতা মনুষ্যগর্ভে পুত্র উৎপাদন করেছেন। সেই সাথে তিনি পূর্বজন্মে মহাদেবের বরে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী লাভ করার কথাও বললেন। সব শুনে রাজা দ্রুপদ পাণ্ডবদের প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং পঞ্চ-পাণ্ডবের সাথে পৃথকভাবে দ্রৌপদীর বিয়ে দিলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১০

    দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় কর্ণ ও দুর্যোধন ছিলেন। তাই তাদের মাধ্যমে ধৃতরাষ্ট্র সহ কুরুকুলের সকলেই জেনে গেল যে, পাণ্ডবরা বেঁচে আছেন। তারপর ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুরের পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবগণ, কুন্তী ও দ্রৌপদীকে হস্তিনাপুর নিয়ে আসলেন। ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “তোমরা অর্ধরাজ্য নাও এবং খাণ্ডবপ্রস্থে বাস কর, তাহলে আমাদের মধ্যে আর বিবাদ হবে না”। পাণ্ডবগণ তাতে সম্মত হয়ে কৃষ্ণকে সাথে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে গেলেন। সেখানে তাঁরা একটি নগর স্থাপন করলেন যা ইন্দ্রপস্থ নামে পরিচিতি পেল। ইন্দ্রপস্থে পাণ্ডবগণ সুখে-শান্তিতে বাস করতে লাগলেন।

    পাণ্ডবগণ নিয়ম করলেন যে, দ্রৌপদী এক জনের ঘরে এক বৎসর বাস করবেন এবং ঐ সময়ে অন্য কোন ভাই ঐ ঘরে ঢুকলে তাঁকে ব্রহ্মচারী হয়ে বার বৎসর বনবাসে যেতে হবে। দ্রৌপদী যখন যুধিষ্ঠিরের ঘরে ছিলেন তখন অজুর্ন ব্রাহ্মণদের গোধন রক্ষার জন্য অস্ত্র আনতে যুধিষ্ঠিরের গৃহে গিয়েছিলেন। ফলে নিয়ম লঙ্ঘন হওয়ায় অজুর্ন স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচারীর বেশে বনবাসে চলে গেলেন। অজুর্ন ব্রহ্মচারীর বেশে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করতে লাগলেন। তিনি ঘটনাক্রমে নাগরাজকন্যা উলূপীর সাথে মিলিত হন এবং তাঁর নিকট হতে বিদায় নিয়ে মণিপুর রাজ্যের চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেন। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহন নামক এক পুত্রের জন্ম হয়। পরে তিনি কুমীররূপা অপ্সরা বর্গা ও তাঁর চার সখীকে শাপমুক্ত করেন। তারপর অজুর্ন কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় যান। কৃষ্ণের ইচ্ছায় তিনি সুভদ্রাকে হরণ করে বিয়ে করেন এবং বার বৎসর পুর্ণ করে সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রন্থে ফিরে আসেন। সুভদ্রার গর্ভে এক পুত্রের জন্ম হল। পুত্রটি মন্যুমান (তেজস্বী) বলে তাঁর নাম রাখা হল অভিমন্যু। অভিমন্যু ছাড়াও দ্রৌপদীর গর্ভে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতনীক ও শ্রুতসেন নামের পাঁচটি পুত্রের জন্ম হল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১১

    শ্বেতকি রাজার যজ্ঞের ঘৃত পান করে অগ্নিদেবের ক্ষুধামন্দা হয়েছিল। তিনি ক্ষুধামন্দা দূর করার জন্য ব্রহ্মার পরামর্শে খাণ্ডব বন দহন করতে চাইলেন। কিন্তু ইন্দ্র বর্ষণের মাধ্যমে খাণ্ডব-দহন কার্যে বাধা সৃষ্টি করলেন। তখন অগ্নিদেব কৃষ্ণ ও অজুর্নের শরণাপন্ন হলেন। তারপর অগ্নি বরুণকে স্মরণ করলে বরুণ এসে অজুর্নকে চন্দ্রপ্রদত্ত গাণ্ডীব ধনু, দুই অক্ষয় তূণী ও কপিধ্বজ রথ দিলেন এবং কৃষ্ণকে একটি চক্র ও কৌমোদকী গদা দিলেন। কৃষ্ণ ও অজুর্ন ঐ সব অস্ত্রের সাহায্যে ইন্দ্রকে পরাজিত করে অগ্নিকে খাণ্ডব-দহনে সাহায্য করলেন। খাণ্ডব-দহনে কেবল তক্ষকপুত্র অশ্বসেন, নমুচির ভ্রাতা ময় দানব এবং চারটি শাঙ্গর্ক পক্ষী জীবিত ছিল। অজুর্নের জন্য মহাশিল্পী ময়দানবের প্রাণ রক্ষা পেল। তাই কৃতজ্ঞতাসরূপ তিনি যুধিষ্ঠিরের জন্য এক সভাগৃহ নির্মাণ করে দিলেন।

   ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করার কথা চিন্তা করলেন। রাজাসূয় যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য কৃষ্ণ ও ভীম মিলে জরাসন্ধকে বধ করলেন। যজ্ঞের নিয়ম অনুযায়ী পাণ্ডবরা বিভিন্ন রাজ্য জয় করে ধন-সম্পদ নিয়ে আসলেন। রাজসূয় যজ্ঞে কৌরবরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য হতে রাজা-মহারাজারা উপস্থিত হলেন। যজ্ঞ চলাকালে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালের উদ্ধত আচরণে ক্রদ্ধ হন এবং সুদর্শন চক্র দিয়ে তাঁকে বধ করেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১২

    রাজসূয় যজ্ঞে পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে দুর্যোধন ও শকুনি হিংসিত হলেন। শকুনি ছিলেন দ্যূতক্রীড়ায় (পাশা খেলা) পারদর্শী। শকুনি চাইলেন দ্যূতক্রীড়ার মাধ্যমে পাণ্ডবদের সর্বশান্ত করতে। এজন্য সে ধৃতরাষ্টকে কুমন্ত্রণা দিতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র শকুনির মন্ত্রণায় বিদুরের নিষেধ অমান্য করে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানান। যুধিষ্ঠির শকুনির সাথে পাশা খেলাতে চাননি কিন্তু পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রন উপেক্ষা করতে পারেননি। পাশা খেলায় বিভিন্ন ধনসম্পত্তি পণ রাখতে হত। পাশা খেলায় সুচতুর শকুনির নিকট যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়ে সব ধন-সম্পত্তি হারালেন। শেষে শকুনির কথায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন। কিন্তু তখনও যুধিষ্ঠির হেরে যান, ফলে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় ডেকে এনে দুর্যোধনাদি কৌরবরা অপমান করতে থাকলেন এবং দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে টানতে লাগলেন। দ্রৌপদী লজ্জা নিবারণের জন্য কৃষ্ণকে স্বরণ করতে লাগলেন। তখন স্বয়ং ধর্ম বস্ত্রের রূপ ধরে তাঁকে আবৃত করলেন, ফলে দুঃশাসন বারংবার বস্ত্র আকর্ষণ করলেও তাঁর শরীরের বস্ত্র ফুরালো না। সভায় তখন সবাই দ্রৌপদীর প্রশংসা এবং দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন। ভীম দুঃশাসনের এই পাপাচারে কুপিত হয়ে শপথ করলেন যে, তিনি দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ করে রক্ত পান করবেন। পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি সদয় হয়ে ধন সমেত ফিরে যেতে বললেন এবং পাণ্ডবগণ ইন্দ্রপস্থে ফিরে গেলেন।

    দ্যূতক্রিড়ায় ধনসম্পদ হস্তগত না করতে পেরে দুর্যোধন দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনি পুনরায় দ্যূতক্রিড়ার আয়োজন করার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করান। এরকম পরাজিত পক্ষকে মৃগচর্ম পরিধান করে বার বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করতে হবে এই ছিল এবারের দ্যূতক্রীড়ার পণ। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর নিষেধ অমান্য করে পাণ্ডবদের দ্যূতক্রিড়ায় আমন্ত্রন জানানোর জন্য দূত পাঠান। এবারও যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলেন না এবং ঐ শর্ত মেনে দ্যূতক্রিড়া শুরু করেন। কিন্তু কুচক্রী শকুনির নিকট তিনি আবার পরাজিত হলেন এবং শর্তানুযায়ী তাঁর চার ভ্রাতা ও দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে বার বৎসর বনবাসের উদ্দেশ্যে উত্তরমুখে যাত্রা করলেন। 

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৩

পাণ্ডবগণ অরণ্যে মৃগচর্ম পরিধান করে ফলমূল আহার করে বাস করতে লাগলেন। কিছুদিন পরে যুধিষ্ঠিরের পরামর্শে অজুর্ন দিব্যাস্ত্র লাভের জন্য হিমালয় ও গন্ধমাদন পার হয়ে ইন্দ্রকীল পর্বতে গেলেন। সেখানে ইন্দ্রের সাথে দেখা হয়ে গেল। অজুর্ন ইন্দ্রের কাছে দিব্যাস্ত্র চাইলে ইন্দ্র বললেন, “মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে পারলে দিব্যাস্ত্র দেব”। তারপর অজুর্ন মহাদেবের কঠোর তপস্যায় রত হলে মহাদেব কিরাত বেশে অজুের্নর নিকট আসলেন এবং বৃষধ্বজ ও ব্রহ্মশির নামের পাশুপত অস্ত প্রদান করে চলে গেলেন। তখন বরুণ, কুবের, যম ও ইন্দ্র আসলেন। যম দণ্ড, বরুণ পাশ এবং কুবের অন্তর্ধান নামক অস্ত্র অজুর্নকে দিলেন। পরে ইন্দ্র অজুর্নকে দিব্যাস্ত্র দেওয়ার জন্য স্বর্গে নিয়ে গেলেন। অজুর্ন স্বর্গে পাঁচ বৎসর ধরে ইন্দ্রের নিকট বিভিন্ন অস্ত্রলাভ করলেন। স্বর্গের উর্বশী অজুর্নের সাথে মিলিত হতে চাইলে অজুর্ন তাঁকে ফিরিয়ে দেন, তাই উর্বশী অজুর্নকে শাপ দিলেন যে, তাঁকে নপুংসক নর্তক হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করতে হবে। পরে অজুর্ন চিত্রসেন নামক গন্ধর্বের সাথে স্বর্গবাস করতে লাগলেন।

    অজুর্নের বিরহে পাণ্ডবগণ কাম্যক বন ছেড়ে তীর্থযাত্রা করলেন। তাঁরা নৈমিষারণ্য, প্রয়াগ, অগস্ত্যের আশ্রম, মণিমতী পুরী প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করতে লাগলেন। জটাসুর নামক এক রাক্ষস ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাণ্ডবদের সাথে থাকতেন। একদিন সে সুযোগ বুঝে তাঁদের সব অস্ত্র হরণ করে নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে ভীম একাই বাহুযুদ্ধে জাটাসুরকে বধ করে সব অস্ত্র উদ্ধার করলেন। বনবাসের পাঁচ বৎসর পূর্ণ হলে অজুর্ন স্বর্গ থেকে ফিরে এসে সবার সাথে মিলিত হলেন। তাঁরপর গন্ধমাদন পর্বতে কুবেরের উদ্যানে পাণ্ডবগণ চার বৎসর বাস করার পর বৃষপর্বা ও বদরিকা আশ্রম হয়ে কিরাতরাজ সুবাহুর দেশে গেলেন। সেখান থেকে তাঁরা যমুনার উৎপত্তি-স্থলের নিকট বিশাখযূপ বনে এসে এক বৎসরকাল মৃগয়া করে কাটাতে লাগলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৪

    একদিন ভীমসেন বিশাখযূপ বনে মৃগয়ায় গেলে এক অজগর তাঁকে বেষ্টন করে ধরল। ভীম শত চেষ্টায়ও অজগরের বন্ধন খুলতে না পেরে দুর্বল হয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে খুজতে এসে দেখেন এক অজগর ভীমকে বেষ্টন করে আছে। যুধিষ্ঠিরকে দেখে অজগর প্রশ্ন করলেন, ব্রাহ্মণ কে? এবং জ্ঞাতব্য কি? তখন যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন সত্য, দান, ক্ষমা, সুচরিত্র, অহিংসা, তপস্যা ও দয়া যাঁর আছে, তিনিই ব্রাহ্মণ এবং সুখ-দুঃখহীন পরব্রহ্মই জ্ঞাতব্য। অজগর যুধিষ্ঠিরের উত্তরে সন্তুষ্ট হন এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করে ভীমকে ছেড়ে দিন। এই অজগর হলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ নহুষ, যিনি অগস্ত্যের শাপে অজগর হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের স্পর্শে অজগররূপী নহুষ শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। বিশাখযূপ বনে এক বৎসর কাটানোর পর পাণ্ডবরা আবার কাম্যক বনে ফিরে আসলেন। কিছুদিন পর সেখানে তাঁদের দেখতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পত্নী সত্যভামা সহ উপস্থিত হয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় মুনি এসেও তাঁদের নানা ধর্মীয় উপাখ্যান শুনিয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় চলে গেলে পাণ্ডবরা দ্বৈতবনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। পাণ্ডবরা দ্বৈতবনে আছে জেনে দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি প্রভৃতি কৌরবরা দ্বৈতবনে আসলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাণ্ডবদের দুরবস্থা দেখে উপহাস করা কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হল না। সেখানে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন কৌরবদের আক্রমন করলেন এবং তাঁদের পরাজিত করলেন। তখন কৌরব সৈন্যরা পান্ডবদের শরণাগত হলে পাণ্ডবরা চিত্রসেনকে পরাজিত করে দুর্যোধনদের মুক্ত করলেন, ফলে তাঁরা লজ্জিত হয়ে হস্তিনাপুর ফিরে গেলেন।

    দ্রৌপদী একটি সূর্যদত্ত থালা পেয়েছিলেন। তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত না খেতেন ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ থালার অন্ন ফুরাত না। কাম্যক বনে থাকাকালে একদিন দুর্বাসা মুনি তাঁর দশ হাজার শিষ্য নিয়ে পাণ্ডবদের অতিথি হয়েছিলেন কিন্তু তখন পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর ভোজন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুর্বসারা স্নান করতে যাওয়ার পর দ্রৌপদী কৃষ্ণকে স্তব করলে কৃষ্ণ উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণের কৃপায় দুর্বসাদের মনে হল যেন তাঁরা আকণ্ঠ ভোজন করেছেন। তখন তাঁরা ভোজন করতে না এসে প্রস্থান করলেন এবং কৃষ্ণও পাণ্ডবদের থেকে বিদায় নিলেন। একদিন দুঃশলার পতি সৌবীররাজ জয়দ্রথ কাম্যক বনে এসে দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে একা পেয়ে হরণ করেন। পাণ্ডবগণ মৃগয়া থেকে ফিরে দ্রৌপদীর ধাত্রীকন্যার মুখে শোনেন যে, দ্রৌপদীকে জয়দ্রথ হরণ করেছেন। তখন পাণ্ডবগণ জয়দ্রথকে খুজে বের করে পরাজিত করেন এবং দ্রৌপদীকে মুক্ত করেন। যুধিষ্ঠিরের দয়ায় জয়দ্রথ প্রাণ নিয়ে ফিরে গেল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৫

    পাণ্ডবদের বনবাসের দ্বাদশ বর্ষের সময় এক ব্রাহ্মণের অরণি উদ্ধার করতে পাণ্ডবরা একটি হরিণের পিছনে ছুটলেন কিন্তু হরিণকে ধরতে পারলেন না। পাণ্ডবগণ ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে সরবরের নিকট গেলেন জলপানের উদ্দেশ্যে। তখন আকাশবাণী হল “বৎস, এই জলে আমার অধিকার আছে, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তারপর পান কর”। যুধিষ্ঠির ব্যতীত সবাই সে আকাশবাণী উপেক্ষা করে জল পান করে মারা গেলেন। যুধিষ্ঠির এসে দেখেন সরবরের তীরে চার ভাইয়ের মৃত দেহ পড়ে আছে। তখন এক বকরূপী যক্ষ এসে বললেন, “আমিই তোমাদের ভ্রাতাগণকে মেরেছি। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে তোমারও মৃত্যু হবে”। যুধিষ্ঠির সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্মত হলেন। যক্ষের প্রথম প্রশ্ন ছিল, “কে সূর্যকে ঊর্ধে রেখেছে? কে সূর্যের চতুর্দিকে ভ্রমণ করে? কে তাঁকে অস্তে পাঠায়? কোথায় তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন?” তখন যুধিষ্ঠির উত্তর করলেন, “ব্রহ্ম সূর্যকে ঊর্ধে রেখেছেন, দেবগণ তাঁর চতুর্দিকে বিচরণ করেন, ধর্ম তাঁকে অস্তে পাঠান, সত্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন”। তারপর যক্ষ প্রশ্ন করলেন, “ব্রাহ্মণের দেবত্ব কি কারণে হয়? কোন ধর্মের জন্য তাঁরা সাধু? তাঁদের মনুষ্যভাব কেন হয়? অসাধুভাব কেন হয়?” যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, “বেদাধ্যয়নের ফলে দেবত্ব, তপস্যার ফলে সাধুতা, তাঁরা মরেন এজন্য তাঁরা মানুষ এবং পরনিন্দার ফলে তাঁরা অসাধু হন”। তারপর যক্ষ বললেন, “ক্ষত্রিয়দের দেবত্ব কি? সাধুধর্ম কি? মনুষ্যভাব কি? অসাধুভাব কি?” যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, অস্ত্রনিপুণতাই ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব, যজ্ঞই সাধুধর্ম, ভয়ই মনুষ্যভাব, শরণাগতকে পরিত্যাগই অসাধুভাব”। যক্ষ বললেন, “পৃথিবী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে? আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর কে? বায়ু অপেক্ষা গতিশীল কে? তৃণ অপেক্ষা বহুতর কে?” যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, “মাতা পৃথিবী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর, মন বায়ু অপেক্ষা গতিশীল, চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বহুতর”। তারপর যক্ষ প্রশ্ন করলেন, “সুপ্ত হয়েও কে চক্ষু মুদ্রিত করে না? জন্মগ্রহণ করেও কে স্পন্দিত হয় না? কার হৃদয় নেই? বেগ দ্বারা কে বৃদ্ধি পায়?” যুধিষ্ঠির বললেন, “মৎস্য নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না, ডিম প্রসূত হয়েও স্পন্দিত হয় না, পাষাণের হৃদয় নেই, নদী বেগ দ্বারা বৃদ্ধি পায়”। তখন যক্ষ প্রশ্ন করলেন, “প্রবাসী, গৃহবাসী, আতুর ও মুমূর্ষুর মিত্র কারা?” যুধিষ্ঠিরের উত্তর দিলেন, “প্রবাসীর মিত্র সঙ্গী, গৃহবাসীর মিত্র ভার্যা, আতুরের মিত্র চিকিৎসক, মুমূষুর্র মিত্র দান”। তারপর যক্ষ প্রশ্ন করলেন, “কি ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়? কি ত্যাগ করলে শোক হয় না? কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনী হয়? কি ত্যাগ করলে সুখী হয়?” তখন যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, “অভিমান ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয় না, কামনা ত্যাগ করলে ধনী হওয়া যায় এবং লোভ ত্যাগ করলে মানুষ সুখী হয়”। সর্বশেষে যক্ষ বললেন, “বার্তা কি? আশ্চর্য কি? পন্থা কি? সুখী কে?” যুধিষ্টির উত্তর দিলেন, “এই মহামোহ রূপ পাত্রে কাল (সময়) প্রাণিসমূহকে পাক করছে, সূর্য তার অগ্নি, রাত্রিদিন তার ইন্ধন (জ্বালানি) মাস-ঋতু তার দর্বী (হাতা) এটাই বার্তা। প্রাণিগণ প্রত্যহ মারা গিয়ে যমালয়ে যাচ্ছে, তা জেনেও সকলে চিরজীবী হতে চায় এর চেয়ে আশ্চর্য কি আছে? সাধুজন যে দিকে গেছেন তাই পন্থা। যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে (অর্থাৎ সন্ধ্যার সময়) শাক রন্ধন করেন, সেই সুখী”। তারপর যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে বললেন যে, তিনি চার ভ্রাতার মধ্যে যে কোন একজনকে বাঁচাতে চান। যুধিষ্ঠির তখন নকুলকে বাঁচাতে বললেন। একথা শুনে যক্ষ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন যে, যুধিষ্ঠির সহোদর ভ্রাতাদের রেখে কেন বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নকুলকে বাঁচাতে চান। তখন যুধিষ্ঠির বললেন, “কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার পিতার পত্নী। তাঁদের দুজনরেই পুত্র থাকুক এই আমার ইচ্ছা”। তখন যক্ষ তাঁর উত্তর শুনে ধন্য হলেন এবং সব ভ্রাতাকেই প্রাণদান করলেন। এই যক্ষই হলেন যুধিষ্ঠিরের পিতা ধর্ম। যুধিষ্ঠির পিতার পরিচয় পেয়ে তাঁর নিকট এই বর চাইলেন যেন তাঁরা অজ্ঞাতবাসে থাকাকালে তাঁদের কেউ চিনতে না পারে। ধর্ম সে বর দিয়ে চলে গেলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৬

    দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হলে পাণ্ডবগণ অজ্ঞাতবাসের জন্য ধাম্যকে সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে মৎস্যদেশের বিরাট রাজার আশ্রয়ে আসলেন। সেখানে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণ সেজে অক্ষক্রিড়া করে রাজার মনোরঞ্জনের দায়িত্ব নিলেন। ভীম রন্ধনশালার পাচক হলেন। অর্জুন বৃহন্নলা নাম ধরে নপুংসক সেজে রাজকন্যাকে নৃত্য শেখানোর দায়িত্ব নিলেন। নকুল হলেন অশ্বরক্ষক আর সহদেব হলেন গোরক্ষক। দ্রৌপদী রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচারিকা হলেন। পঞ্চভ্রাতার ছদ্মনাম ছিল যথাক্রমে জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন ও জয়দ্বল এবং দ্রৌপদী সেখানে পরিচয় দিলেন সৌরন্ধ্রী নামে। কিছু দিন যেতে না যেতে বিরাট রাজার মন্ত্রী কীচকের কুদৃষ্টি পরে সৌরন্ধ্রী নামধারী দ্রে্রৗপদীর উপর। কীচক দ্রৌপদীকে লাঞ্ছিত করলে ভীম গোপনে কীচককে বধ করলেন আর রাজসভায় রটে গেল যে, সৌরন্ধ্রীর গন্ধর্বপতিরা কীচককে বধ করেছেন। এভাবে পাণ্ডবরা বিরাটরাজার প্রাসাদে গোপরেন ও ছদ্মবেশে বাস করতে লাগলেন।

    কিছুদিন পর দুর্যোধন ও কর্ণের মন্ত্রণায় ত্রিগর্তদেশের অধিপতি সুশর্মা বিরাট রাজার বহু গরুবাছুর হরণ করলেন। কৌরবরাও তার সাথে ছিলেন। যুধিষ্ঠর, ভীম, নকুল ও সহদেবের বিক্রমে সুশর্মা পরাজিত হল এবং গরুবাছুর ফিরিয়ে দিয়ে প্রাণভিক্ষা পেল। যুদ্ধ চলাকালে কৌরবরা বিরাট রাজার উত্তর দিকের গোশালা হতে ষাট হাজার গরু হরণ করল। দ্রৌপদীর পরামর্শে বিরাটপুত্র উত্তর বৃহন্নলা অজুর্নকে রথের সারথি করে সসন্যে গরু উদ্ধার করতে গেলেন। কিন্তু কৌরবদের পক্ষের মহাবীরদের দেখে উত্তর পলায়ন করতে চাইলে অজুর্ন তাঁর গতিরোধ করলেন এবং শমী বৃক্ষের উপরে রাখা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র উত্তরের সহায়তায় নামিয়ে আনলেন। অস্ত্রশস্ত্র দেখে উত্তর বৃহন্নলার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তখন অজুর্ন তাঁর আসল পরিচয় দান করেন এবং অজুর্ন রূপে দর্শন দেন। তারপর উত্তরকে সারথি করে অজুর্ন কৌরবদের সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। তিনি ভীষ্ম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, দুর্যোধন, অশ্বথামা সহ অন্যান্য মহবীরদের পরাজিত করে গরু উদ্ধার করে বিরাট রাজার সভায় ফিরে আসেন। কৌরবরা অজুর্নকে চিনে ফেললেও সমস্যা হয়নি কারণ তখন বার বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাঁরপর পাণ্ডবরা বিরাট রাজার নিকট একে একে পরিচয় দান করতে লাগলেন। পরিচয় পেয়ে বিরাট তাঁর কন্যা উত্তরাকে অজুর্নের সাথে বিবাহ দিতে চাইলেন কিন্তু শিষ্যা কন্যা তুল্য বলে অজুর্ন উত্তরাকে বিবাহ করতে রাজি হননি। তিনি তাঁর পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দেয়ার মত প্রকাশ করলেন। বিরাট রাজাও তাতে সম্মতি হলেন এবং উত্তরকে ও অভিমন্যুর সাথে বিবাহ দিলেন। বিবাহে কৃষ্ণ ও বলরামও উপস্থিত ছিলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৭

    অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহের পর বিরাট রাজা সভায় কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্বতবংশীয় সাত্যকি, কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন, শাল্ব, দ্রুপদ প্রমুখ মিলিত হলেন এবং পাণ্ডবদের রাজ্যলাভ কিভাবে হবে এই নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম চাইলেন কৌরবদের নিকট দূত পাঠাতে। তাঁরা ভাবলেন, দুর্যোধন যদি রাজ্য দিতে সম্মত হলে কৌরব ও পাণ্ডবদের ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হবে না কিন্তু রাজ্য দিতে সম্মত না হলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে। তবে সাত্যকি ও দ্রুপদ চাইলেন কৌরবদের কাছে মাথা নত না করে যুদ্ধ করেই রাজ্য অধিকার করতে। কৃষ্ণ ও বলরাম তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করে চলে গেলেন। তবে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে দুর্যোধনের নিকট দূত পাঠানো হল। কিন্তু দুর্যোধন বিনা যুদ্ধে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে অসম্মত হওয়ায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল। ফলে যুদ্ধের সংবাদ পৌঁছে দিতে পাণ্ডব ও কৌরব উভয় পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজ্যের রাজা-মহারাজাগণের নিকট দূত পাঠানো হল। তারপর বিভিন্ন রাজা-মহারাজাগণ তাঁদের মিত্রের পক্ষে যোগ দিতে লাগলেন। কৃষ্ণকে দলে নিতে দুযোর্ধন ও অজুর্ন উভয়ই একই দিনে তাঁর নিকট গেলেন। কৃষ্ণের শয়নকক্ষে অজুর্ন বসলেন তাঁর পায়ের কাছে আর দুর্যোধন বসলেন সিংহাসনে। কৃষ্ণ ঘুম থেকে জেগে প্রথমে অজুর্নকে দেখায় তিনি অজুর্নের পক্ষ নিলেন। দুযোর্ধনের সাথেও কৃষ্ণের আত্মীয়তা আছে অর্থাৎ কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা। এজন্য তিনি দুর্যোধনকেও নিরাশ করলেন না এবং তাঁর দশ কোটি নারায়ণী সেনা তাকে দিলেন। অজুর্ন ও দুর্যোধন উভয়ই খুশি মনে ফিরে এলেন।

    পাণ্ডবদের মাতুল মদ্ররাজ শৈল্য পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের জন্য আসলেন কিন্তু দুর্যোধন তাঁকে ছল করে দলে নিয়ে নিলেন। মৎস্যরাজ বিরাট, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, সাত্বত বংশীয় সাত্যকি ছাড়াও পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দিলেন চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, জরাসন্ধপুত্র মগধরাজ জয়ৎসেন, কেকয়রাজ বংশীয় পঞ্চ-সহোদর, পাণ্ড্যরাজ সহ অনেক রাজা ও তাঁদের সৈন্য-সামন্ত। কৌরবদের পক্ষে যোগ দিলেন ভগদত্ত, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা, হৃদিকপুত্র কৃতবর্মা, সিন্ধুসৌবীরবাসী জয়দ্রথ সহ বিভিন্ন রাজাগণ। পাণ্ডবদের পক্ষে সাত অক্ষৌহিনী আর কৌরবদের পক্ষে এগার অক্ষৌহিনী সেনা সংগৃহীত হল। কৌরব সেনারা হস্তিনাপুর ছাড়াও পঞ্চনদ, কুরুজাঙ্গল, রোহিতকারণ্য, মরুপ্রদেশ, অহিচ্ছত্র, কালকূট, গঙ্গাতীর, বারণ, বাটধান, পার্বতদেশ প্রভৃতি স্থানে অবস্থান করলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৮

    সেনা সংগ্রহের পরও যুদ্ধ থামানোর জন্য দ্রুপদের পুরোহিতকে পাণ্ডবদের দূত করে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনাপুর পাঠানো হল। কর্ণ, দুর্যোধনাদি কৌরব বিরোধিতা করলেও ভীষ্মের পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী সঞ্জয়কে দূত করে পাণ্ডবদের নিকট পাঠালেন তাঁদের মতামত জানানোর জন্য। সঞ্জয় পাণ্ডবদের নিকট এলে পাণ্ডবরা গোটা রাজ্যের পরিবর্তে শুধুমাত্র পাঁচটি প্রদেশ বা পাঁচটি গ্রাম চাইলেন। পাণ্ডবদের এই উদারতা সত্যি প্রশংসনীয়। সঞ্জয় হস্তিনাপুরে এসে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট পাণ্ডবদের মতামত জানালেন। কিন্তু কর্ণ, দুর্যোধনাদি কৌরবরা যুদ্ধ ছাড়া সূচাগ্র মাটি দিতেও অসম্মত হলেন। তখন ভীষ্ম ও বিদুরের নিষেধ সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র কর্ণ ও দুযোর্ধনের অহংকার আর ঔদ্ধত্যের নিকট নতি স্বীকার করে যুদ্ধে মত দিলেন। যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের বিপক্ষে অর্থাৎ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিলেন। তাই যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই হস্তিনাপুর গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর সহ অনেকই যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীও জানতেন যে, তাঁর পুত্রগণ লোভী ও ইর্ষাপরায়ণ এবং যুদ্ধে তাঁদের পরাজয় নিশ্চিত। কিন্তু পুত্রগণ তাঁদের বশে না থাকায় তাঁরা পুত্রদের কুকার্যে বাধা দিতে পারলেন না। যা হোক, দুর্যোধন কারও কথায় কর্ণপাত না করে কৃষ্ণের সন্ধির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল এবং কৃষ্ণকে বন্দি করতে চাইল। কৃষ্ণ তখন সভাস্থ সকলকে তাঁর ঐশীমূর্তি দেখালে দর্যোধন নিরস্ত হল। যাওয়ার আগে কৃষ্ণ কর্ণকে পাণ্ডবদের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও কর্ণ কৃতজ্ঞতাবশত দুর্যোধনের বিরুদ্ধে যেতে চাইলেন না। পরিশেষে কৃষ্ণকে যুদ্ধের বার্তা নিয়েই পাণ্ডবদের নিকট ফিরে আসতে হল।

   কুন্তী কর্ণের নিকট গিয়ে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত বললেন এবং জানালেন যে, কর্ণ তাঁরই পুত্র। পরে কুন্তী কর্ণকে পাণ্ডবদের পক্ষ নিতে বললেন, কিন্তু কর্ণ তাঁর মাতার আজ্ঞা পালন করতে অসম্মত হলেন। তবে কথা দিলেন অজুর্ন ভিন্ন অন্য চার ভ্রাতাকে তিনি আঘাত করবেন না। অবশেষে কুন্তী কর্ণকে আশীর্বাদ করে ফিরে এলেন। যুদ্ধ অনিবার্য হওয়ায় পাণ্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল এবং কুরুক্ষেত্রে হিরন্বতী নদীর নিকটে সন্নিবেশিত হল। শুরু হয়ে গেল পাণ্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধ। যুধিষ্ঠির যুদ্ধের আগে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও শল্যের নিকট গেলেন এবং তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে আসলেন। গবল্গণপুত্র সঞ্জয় ব্যাস কতৃর্ক দিব্যচক্ষু লাভ করলেন এবং যুদ্ধের খবরাখবর ধৃতরাষ্ট্রকে জানানোর দায়িত্ব নিলেন। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের সারথী ছিলেন পরে তিনি মন্ত্রী পদ লাভ করেন। অজুর্ন আত্মীয়বধে রাজি হলেন না কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করালেন। কৃষ্ণ অস্ত্র না ধরে অজুর্নের রথের সারথি হলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-১৯

    শুরু হয়ে গেল কুরু-পাণ্ডবের মহারণ। প্রথম দিনের যুদ্ধে বিরাট পুত্র উত্তর এবং নরশাদূর্ল শ্বেতের মৃত্যু হল। দ্বিতীয় দিনে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে ধৃষ্টদ্যুম্ন কতৃর্ক ক্রৌঞ্চারুণ নামক ব্যূহ রচনা করা হল এবং পাণ্ডব ও ভীস্মের পরাক্রমে দুপক্ষের অসংখ্য সৈন্য নিহত হল। তৃতীয় দিনে ভীষ্ম ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলেন। তাঁর পরাক্রমে অসংখ্য পাণ্ডব-সৈন্য নিহত হলেন। কিছু সৈন্য পলায়ন করতে উদ্যত হলেন। ভীষ্মকে এরকম পাণ্ডব-সৈন্য বধ করতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ ক্রোধান্বিত হয়ে সুদর্শন চক্র নিয়ে ভীষ্মের দিক ধাবিত হলেন। কিন্তু অজুর্ন তাঁকে গতিরোধ করে শান্ত করেন। পরে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে রথে উঠে তাঁর পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজাতে শুরু করেন। এরপর অজুর্নের মাহেন্দ্র অস্ত্রে বহু কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং সূর্যাস্তের পর তৃতীয় দিনের যুদ্ধ মেষ হয়। চতুর্থ দিনে ভীমসেন সেনাপতি, জলসন্ধ, সুষেণ, ভীমরথ, সুলোচন প্রভৃতি দুর্যোধনের ভ্রাতাগণকে বধ করলেন।

    পঞ্চম দিনে পাণ্ডবগণ শ্যেন ব্যূহ এবং কৌরবগণ মকর ব্যূহ রচনা করেন। সাত্যকির দশপুত্র ভূরিশ্রবা কতৃর্ক নিহন হলেন এবং অজুর্ন শরাঘাতে পঁচিশ হাজার কৌরব সৈন্য বধ করলেন। ষষ্ঠ দিনে পাণ্ডব সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন মকর ব্যূহ এবং কৌরব সেনাপতি ভীষ্ম ক্রৌঞ্চ ব্যূহ রচনা করলেন। ভীমের সঙ্গে ভীষ্ম-দ্রোণের যুদ্ধে দুপক্ষের বহু সৈন্য নিহত হয়। সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীপুত্র শ্রুতকর্ম, সতসোম, শ্রুতসেন ও শতানীকের শরাঘাতে দুর্যোধনের চার ভ্রাতা বিকর্ণ, দুমুর্খ, জয়ৎসেন ও দুস্কর্ণ নিহত হয়। সপ্তম দিনে দ্রোণের বাণে বিরাটপুত্র শঙ্খ নিহত হন এবং অজুর্নপুত্র ইরাবান ও নকুল সহদেবের পরাক্রমে বহু কৌরব সৈন্য নিহত হয়। অষ্টম দিনের যুদ্ধে অজুর্নপুত্র ইরাবান কতৃর্ক শকুনির ছয় ভ্রাতা নিহত হয়। পরে কৌরব পক্ষের অলম্বুষ রাক্ষস ইরাবানকে বধ করে। তারপর ভীমপুত্র ঘটোৎকচ কতৃর্ক বহু সৈন্য নিহত হয় এবং বহু সৈন্য পলায়ন করে।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২০   

    যুদ্ধের নবম দিনে ভীষ্ম ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেন এবং তাঁর পরাক্রমে পাণ্ডবরা ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়েন। তখন যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবরা শ্রীকৃষ্ণকে সাথে করে পিতামহ ভীষ্মের কাছে যান এবং প্রণাম করে তাঁর বধের উপায় জানতে চান। তখন ভীষ্ম বলেন যে, শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে অর্জুন যেন তাঁর প্রতি শর নিক্ষেপ করেন। ভীষ্ম শিখণ্ডীর বিরূদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। সে সুযোগে অজুর্ন তাঁকে শরবিদ্ধ করবেন। পরে তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করবেন। ভীষ্ম কতৃর্ক তাঁর মৃত্যুর উপায় জেনে পাণ্ডবরা ফিরে আসলেন। এই শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে ভীষ্মের অস্ত্র না ধরার একটা ইতিহাস আছে। এই শিখণ্ডী পূর্বজন্মে কাশীরাজের কন্যা অম্বা ছিলেন। অম্বা শাল্বরাজের বাগদত্তা জেনে ভীষ্ম অম্বাকে ছেড়ে দেন এবং তাঁর অপর দুই ভগিনীকে ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের সাথে বিবাহ দেন। কিন্তু অম্বা ভীষ্ম কতৃর্ক অপহৃত হওয়ায় শাল্বরাজ তাঁকে পরিত্যাগ করেন। পরে অম্বা ভীষ্ম বধের জন্য তপস্যা করতে থাকেন। মহাদেবের বরে অম্বা দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডী হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও পরে পুরুষ হয়ে যান।

    ভীষ্ম শিখণ্ডীর পূর্বজন্মের ইতিহাস জানতেন এবং শিখণ্ডী পূর্বজন্মে নারী ছিলেন বলে তিনি স্থির করলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। দশম দিনে ভীষ্মের পরামর্শ মতে শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে অজুর্ন ভীষ্মের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। শিখণ্ডী ভীষ্মকে শর নিক্ষেপ করলেও ভীষ্ম শিখণ্ডীর বিরূদ্ধে অস্ত্র উঠালেন না। অবশেষে অজুর্ন বহু শরে ভীষ্মের দেহ বিদ্ধ করে ভূপাতিত করলেন। এভাবে ভীষ্মের শরশয্যা রচিত হল। ভীষ্মদেব পিতা কতৃর্ক ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। উত্তরায়ণের সময় মৃত্যুবরণ করলে সদ্গতি লাভ করা যায়। যুদ্ধের সময় দক্ষিণায়ণ চলছিল। তাই ভীষ্ম উত্তরায়ণের সময় মৃত্যুর ইচ্ছা করলেন। ভীষ্মের শরশয্যা গ্রহণের পর দ্রোণাচার্যকে সেনাপতি করা হল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২১

    একাদশ দিন দ্রোণের হাতে পঞ্চালবীর ব্যাঘ্রদত্ত ও সিংহসেন সহ অনেক সৈন্য নিহত হল। দ্বাদশ দিনে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা, সত্যরথ, সত্যবর্মা প্রভৃতি সংশপ্তকগণ অর্জুনকে আক্রমন করে। অর্জুনের দেবদত্ত নামক শঙ্খের মহারবে সংশপ্তকবাহিনী ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়ল তাঁর শরবর্ষণে অনেক সংশপ্তকগণ প্রাণ হারাল। পরে অজুর্ন ভগদত্তকে আক্রমন করলেন। ভগদত্ত বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলে কৃষ্ণ তা বুকে গ্রহণ করলেন এবং ঐ অস্ত্র মাল্যে পরিবর্তিত হল। তারপর অজুর্ন ভগদত্তকে বধ করেন।

    ত্রয়োদশ দিনে সেনাপতি দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করলেন। এই চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল কেবলমাত্র অজুর্ন, কৃষ্ণ, কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন আর অভিমন্যুই জানতেন। অজুর্ন সংশপ্তকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত এবং প্রদ্যুম্ন অন্যত্র যুদ্ধে রত তাই কেবল অভিমন্যুই রইলেন চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য। অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল জানলেও বিপদকালে ব্যূহ থেকে বের হয়ে আসার কৌশল জানতেন না। যুধিষ্ঠির ও ভীম অভিমন্যুকে বের করে আনবেন এমন প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে তাঁকে চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য পাঠালেন। অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করে দুঃশাসন, শল্য প্রভৃতি মহারথীকে পরাজিত করলেন এবং কর্ণকেও পীড়িত করলেন। অভিমন্যুর পরাক্রমে কৌরবদের অসংখ্য সৈন্য নিহত হল। তখন দুর্যোধনের নির্দেশে দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বথামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এই ছয় জন এক সাথে বালক অভিমন্যুকে আক্রমন করলেন। যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে কাপুরুষের মত নিষ্ঠুরভাবে তাঁরা অভিমন্যুকে হত্যা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রুপদ, শিখণ্ডী, যুধিষ্ঠির, ভীম প্রভৃতি পাণ্ডবগণ অভিমন্যুকে রক্ষা করতে এলে চক্রব্যূহের দ্বাররক্ষক জয়দ্রথ তাঁদের বাধা দেয়। ফলে অভিমন্যুকে একাই যুদ্ধ করে বীরের মত মৃত্যুবরণ করতে হল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২২

    অজুর্ন সংশপ্তকগণকে বধ করে ফিরে এসে অভিমন্যুর মৃত্যুর বর্ণনা শুনলেন। সব শুনে অজুর্ন ক্রোধের সাথে উচ্চস্বরে প্রতীজ্ঞা করেন যে, তিনি পরের দিন সূর্যাস্তের পূর্বেই জয়দ্রথকে বধ করবেন এবং বধ করতে না পারলে অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। অজুর্নের প্রতিজ্ঞার কথা শুনে জয়দ্রথ ভয় পেয়ে গেলেন। পরের দিন জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য দ্রোণের পশ্চাতে ছয় ক্রোশ দূরে সৈন্যবেষ্টিত করে রাখা হল। অজুর্ন সামনের সব সৈন্যকে পরাস্ত করে জয়দ্রথের নিকট যেতে উদ্যত হলেন। কিন্তু তখন সূর্য প্রায় অস্তাচলে যাওয়ার উপক্রম হল। দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপ, প্রভৃতি মহারথীদের অতিক্রম করে জয়দ্রথকে বধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লে কৃষ্ণ যোগবলে সূর্যকে আবৃত করেন ফলে সূর্যাস্ত না হলেও সকলে মনে করল সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। সৈন্যরা যখন ধুলি ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল, সে সুযোগে কৃষ্ণের পরামর্শ অনুযায়ী অজুর্ন কৃপ, কর্ণ, শল্য প্রভৃতিকে শরাঘাতে বিতাড়িত করে জয়দ্রথের প্রতি শরনিক্ষেপ করলেন। ঐ শরে জয়দ্রথের মস্তক ছেদ হয়ে তার পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে পড়ল। তখন সকলে দেখল যে সূর্যাস্ত তখনও হয়নি। ঐ দিন ভীম দুর্যোধনের একত্রিশ ভ্রাতাকে বধ করলেন এবং সাত্যকি ভূরিশ্রবার মস্তক ছেদ করলেন। ভীমপুত্র ঘটোৎকচের মায়াযুদ্ধে কৌরবদের ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেল। অগত্যা কর্ণ অর্জুনকে বধ করার জন্য তুলে রাখা ইন্দ্রপ্রদত্ত বৈজয়ন্তী শক্তি নিক্ষেপ করলেন। শক্তির আঘাতে ঘটোৎকচ মৃত্যুবরণ করল কিন্তু মরার আগে সে বিশাল আকৃতির দেহ নির্মাণ করেছিল এবং ঐ বিশাল আকৃতির দেহ ভূপাতিত হওয়ার ফলে কৌরবদের একাংশ পিষ্ট হয়ে মারা গেল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২৩

    পঞ্চদশ দিনে দ্রোণের পরাক্রমে অগনিত পাণ্ডব সৈন্য নিহত হতে লাগল। তখন কৃষ্ণ অজুর্নকে বললেন যে, দ্রোণ অবধ্য, তিনি যদি অস্ত্র ত্যাগ না করেন তবে কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না। তাই পাণ্ডবগণ কৃষ্ণের পরামর্শে কৌশলের আশ্রয় নিল। ভীম মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামের এক হস্তী বধ করে দ্রোণকে গিয়ে বললেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন। দ্রোণ বিশ্বাস করলেন না, কারণ তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা অজেয় এবং অমর। তখন উপায় না দেখে কৃষ্ণের পরামর্শে যুধিষ্ঠির দ্রোণের নিকট গিয়ে বললেন, “অশ্বত্থামা হতঃ” অর্থাৎ অশ্বত্থামা হত হয়েছেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন “ইতি কুঞ্জরঃ” অর্থাৎ এই নামের হস্তী। যে যুধিষ্ঠিরের রথ সব সময় ভূমি থেকে চার আঙুল উপরে থাকত, মিথ্যা বলায় তাঁর রথ তখন ভূমি স্পর্শ করল। দ্রোণ জানতেন যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যা বলেন না, তাই তিনি তাঁর কথা বিশ্বাস করে পুত্রশোকে মুহ্যমান হলেন এবং অস্ত্রত্যাগ করলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর মুণ্ড ছেদন করলে তাঁর মৃতদেহ হতে দিব্যজ্যোতি নির্গত হয়ে ব্রহ্মলোক পথে চলে গেল। দ্রোণ অকারণে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে অসংখ্য পাণ্ডবসৈন্য নিহত করেছিলেন, যার ফল স্বরূপ তাঁকে এভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হল।

    দ্রোণ নিহত হওয়ার পর অশ্বত্থামা ক্রোধান্বিত হয়ে পাণ্ডবগণের দিকে নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করে কিন্তু কৃষ্ণের শেখানো কৌশল অবলম্বন করে পাণ্ডবরা নারায়ণাস্ত্র নিবৃত্ত করেন। ষোড়শদিনে কৌরবরা কর্ণকে সেনাপতি করে যুদ্ধ শুরু করলেন। ঐ দিন পাণ্ডবরা অশ্বত্থামা ও দুঃশাস সহ বহু কৌরব সৈন্য বধ করলেন। সপ্তদশ দিনে ভীম দুর্যোধনের এগার ভ্রাতাকে হত্যা করলেন। ঐ দিন অজুর্ন ও কর্ণের মধ্যেও তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কর্ণের রথের চাঁকা ভূমিতে বসে যায়, তারপরও কর্ণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। কর্ণ এক ভয়ঙ্কর বাণে অজুর্নের বাহু বিদ্ধ করায় অজুর্ন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এই সুযোগে কর্ণ রথের চাকা দুই হাত দিয়ে তুলবার চেষ্টা করতে করেন। তখন অজুর্ন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে কর্ণের উদ্দেশ্যে অঞ্জলিক বাণ নিক্ষেপ করলে কর্ণের মস্তক ছেদিত হয়। তখন কর্ণের দেহ থেকে একটি তেজঃ আকাশে উঠে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করে। অষ্টাদশ দিনে শল্যকে সেনাপতি করে কৌরবরা যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। যুধিষ্ঠিরের নিক্ষেপ করা শক্তিঅস্ত্রে শল্য নিহত হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন কতৃর্ক ভল্লের আঘাতে শাল্ব নিহত হলেন। সহদেব শকুনি ও তাঁর পুত্র উলূককে হত্যা করলেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২৪

    অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধে কৌরবপক্ষের এগার অক্ষৌহিণী সেনার সব বিনাশ হল। পাণ্ডবদের পক্ষে দুহাজার রথ, সাতশ হস্তী, পাঁচ হাজার অশ্ব ও দশ হাজার পদাতি অবশিষ্ট ছিল। কৌরবদের পক্ষে কেবল কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা ও দুর্যোধন জীবিত ছিলেন। দুর্যোধন প্রাণ বাঁচানোর জন্য দ্বৈপায়ন হৃদে লুকালেন। পাণ্ডবগণ কতিপয় ব্যাধের নিকট দুর্যোধনের সংবাদ পেয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদে গেলেন এবং যুধিষ্ঠির তাকে যুদ্ধে আহবান জানালেন। দুর্যোধনকে অসহায় ও নিরস্ত্র অবস্থায় দেখে যুধিষ্ঠির দয়া-পরবশ হয়ে তাকে একটা সুযোগ দিলেন যে, তিনি যদি পাণ্ডবদের যে কোন একজনকে পরাজিত করতে পারে, তবে রাজ্য তারই হবে। দুর্যোধন তখন ভীমকে যুদ্ধে আহ্বান জানল। তারপর শুরু হল ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। দুযোর্ধনকে ন্যায়সঙ্গতভাবে গদাযুদ্ধে পরাজিত করা দুঃসাধ্য ছিল। অবশেষে শ্রীকৃষ্ণ ও অজুর্নের ইশারায় ভীম দুর্যোধনকে উরুতে আঘাত করে ভূপাতিত করেন। অশ্বত্থামা দুর্যধনকে দেখতে এসে তাঁর সামনে শপথ করলেন যে, তিনি পাণ্ডবদের বিনাশ করবেন। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট ও গান্ধারীকে নানা উপদেশ দিয়ে তাঁদের পুত্রশোক লাঘব করলেন।

    পাণ্ডবশিবিরে যখন সমস্ত সৈন্য রথী-মহারথীরা ঘুমাচ্ছিলেন তখন অশ্বত্থামা প্রথমে ঘুমন্ত ধৃষ্টদ্যুম্নকে পদদলিত করে হত্যা করেন। পরে মহাদেব প্রদত্ত খড়গ দিয়ে উত্তমৌজা, যুধামন্যু, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পুত্রগণ সহ পাণ্ডবশিবিরের সকল সৈন্য, হস্তী ও অশ্ব বধ করলেন অথচ সবাই দেখেলেন যে, কালরাত্রিরূপা কালী সকলকে বধ করছেন। পাণ্ডবপক্ষের শুধু পঞ্চপাণ্ডব, কৃষ্ণ ও সাত্যকি বেঁচে রইলেন। এই হত্যাকাণ্ডের খবর অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে দিলে আহত দুর্যোধন সুখী মনে মৃত্যুবরণ করেন। অশ্বত্থামাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভীম অজুর্ন, শ্রীকৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির তাঁর নিকট এলে সে দ্রোণপ্রদত্ত ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। অজুর্নও আত্মরক্ষার্থে ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। এই অস্ত্র বড় ভয়ানক যা পৃথিবীকে দগ্ধ করে ফেলতে পারে। তখন ব্যাসের নির্দেশে অজুর্ন ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রত্যাহার করলেও অশ্বত্থামা তা প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হল। তারপর অশ্বত্থামা ব্যাসের নির্দেশে তার মস্তকের মহামূল্যবান মণি পাণ্ডবদের দিয়ে প্রাণ রক্ষা করল এবং ব্রহ্মশির অস্ত্র পাণ্ডবনারীদের গর্ভে নিক্ষেপ করল। ঐ অস্ত্রে অজুর্নের পুত্রবধু উত্তরার গর্ভের সন্তান বিনষ্ট হবে কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার প্রতিশ্রম্নতি দেন। কৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে সহস্রর বৎসর জনহীন দেশে অসহায় ব্যাধিগ্রস্ত ও পূয-শোণিতগন্ধী হয়ে বিচরণ করার অভিশাপ দেন।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২৫

    ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুর ত্যাগ করার পূর্বে যুধিষ্টিরকে আলিঙ্গন করলেন এবং ভীমকে খুজলেন। কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে লৌহ-নির্মিত ভীমকে পাঠালেন। অযুত হস্তীর মত শক্তিশালী ধৃতরাষ্ট্র সেই লৌহমূর্তিকে অলিঙ্গন করে চূর্ণ করে ফেললেন এবং ভাবলেন ভীম বধিত হয়েছে। তখন কৃষ্ণ তাঁকে জানালেন ওটা আসল ভীম নয়, লোহার ভীম। গান্ধারী যুধিষ্ঠিরকে অভিশাপ দিতে চাইলে ব্যাস তাঁকে বললেন, “অষ্টাদশ দিন যুদ্ধে প্রতিদিনই দুর্যোধন তোমাকে বলত মাতা, আমি শত্রুদেরর সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি, আমাকে আশীর্বাদ করুন। তুমি প্রতিদিনই পুত্রকে বলতে যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেরই জয় হোক। কল্যাণী তুমি চিরদিন সত্য কথাই বলেছ”। ব্যাসের উপদেশে গান্ধারীর ক্রোধ দূর হল। কিন্তু তারপরও তিনি চক্ষুর আবরণবস্ত্রের অন্তরাল দিয়ে যুধিষ্ঠিরের নখের দিকে দৃষ্টিপাত করায় যুধিষ্ঠিরের নখ কুৎসিত হয়ে যায়। তারপর গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিলেন যে, তাঁর যদুবংশ ধ্বংস হবে। শ্রীকৃষ্ণ সহাস্যে সে অভিশাপ মাথা পেতে নিলেন।

    যুধিষ্ঠির অভিষিক্ত হওয়ার পর পিতামহ ভীষ্মের নিকট যান এব নানা ধর্মোপদেশ লাভ করেন। আটান্ন দিন শরশয্যায় কাটানোর পর ভীষ্ম কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে স্বর্গারোহন করেন। কৃষ্ণ ও সুভদ্রা দ্বারকায় ফিরে গিয়ে বসুদেবকে যুদ্ধের সব কাহিনী খুলে বললেন। তারপর যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেদ যজ্ঞের সময় শ্রীকৃষ্ণ, সুভদ্রা, সাত্যকি, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, বলরাম প্রমুখ হস্তিনাপুর আসেন। ব্রহ্মশির অস্ত্রের তেজে উত্তরার গর্ভে এক মৃতপুত্রের জন্ম হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন। ভরতবংশ পরিক্ষীণ হলে অভিমন্যুর এই পুত্র জন্মেছে বলে পুত্রের নাম পরিক্ষিৎ রাখা হয়েছিল।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২৬

    যুধিষ্ঠির অভিষিক্ত হওয়ার পর পনের বৎসর পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি ও পরামর্শ নিয়ে রাজ্য শাসন করতেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্র তপস্যার জন্য বনে চলে যান। গান্ধারী ও কুন্তিও তাঁর সাথে বনে যান। দুই বছর পর ধৃতরাষ্ট্র দাবানলের অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেন। তারপর গান্ধারী ও কুন্তিও প্রাণ ত্যাগ করেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের ছত্রিশ বছর কেটে যাওয়ার পর যদুবংশ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। সাত্যকি মদ্যপ অবস্থায় কৃতবর্মার শিরচ্ছেদ করেন এবং অন্যান্য লোকদেরও বধ করতে থাকেন। তখন ভোজ ও অন্ধকগণ সাত্যকিকে উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্র দিয়ে মারতে উদ্যত হন। প্রদ্যুম্ন সাত্যকিকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন। এভাবে যদুবংশে নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা পরস্পরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। মহাকাল আসন্ন জেনে কৃষ্ণ ও বলরাম নির্বিকার থাকেন। বলরামের দেহত্যাগের পর কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন তাঁরও দেহত্যাগের সময় এসেছে। তিনি বনমধ্যে যোগ অবলম্বন করে শয়ান হলেন তখন জরা নামের এক ব্যাধ মৃগ মনে করে কৃষ্ণের পদতল শরবিদ্ধ করে। শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণে দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব প্রভৃতি সকলে স্তুতি করতে থাকেন এবং ইন্দ্র অভিনন্দন তাঁকে জানান।

মহাভারতের কাহিনী : অংশ-২৭

    দারুকের মুখে যদুবংশ ধ্বংসের বর্ণনা শুনে অজুর্ন দ্বারকায় যাত্রা করলেন। শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর অজুর্ন তাঁর স্ত্রীগণ ও অন্যান্য পতিপুত্রহীনা নারীদের রক্ষা করার জন্য তাঁদের নিয়ে দ্বারকা থেকে কুরুক্ষেত্রের দিকে রওনা হন। অজুর্ন যাদবনারীদের দ্বারকা থেকে নিয়ে আসার পর সে স্থান সমুদ্রে প্লাবিত হয়। আসার পথে পঞ্চনদ নামক স্থানে আভীর দস্যুগণ যাদবনারীদের হরণ করতে আসে। অজুর্ন অনেক চেষ্টা করেও সব যাদবনারীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং যাদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন তাঁদেরকে এনে মার্তিকাবত নগর ও ইন্দ্রপ্রস্থে রাখেন। অজুর্ন কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্য দান করেন। তারপর কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও জাবতী অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। সত্যভামা এবং অন্যান্য স্ত্রীগণ হিমালয়ের পরে কলাপ গ্রামে গিয়ে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন।

    শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দেহত্যাগের পর যুধিষ্ঠির তাঁদের শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁদেরও দেহত্যাগের সময় এসে গেছে। তাঁরপর পরীক্ষৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে এবং যুযুৎসুর উপর রাজ্যপালনের ভার দিয়ে পঞ্চ-পাণ্ডব ও দ্রৌপদী হস্তিনাপুর ত্যাগ করলেন। পঞ্চ-পান্ডব ও দ্রৌপদী উপবাস করে পূর্ব দিকে রওনা হলেন। একটা কুকুরও তাঁদের সাথে ছিল। পান্ডবগণ হিমালয় পার হয়ে মেরু পর্বত দর্শন করে চলতে লাগলেন এমন সময় দ্রৌপদী ভূপাতিত হলেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, অজুর্নের প্রতি দ্রৌপদীর বিশেষ পক্ষপাত থাকায় তিনি ভূপতিত হলেন। সহদেব পড়ে গেলে যুধিষ্ঠির ভীমকে বোঝালেন যে, সহদেব নিজেকে পন্ডিত মনে করে গর্ব করত বলে তাঁরও পতন হল। তারপর নকুল পড়ে গেলে যুধিষ্ঠির ভীমকে বোঝালেন যে, নকুলের রূপের অহংকারই তাঁর পতনের কারণ। কিছুক্ষণ পর অজুর্ন পড়ে গেলে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন যে, অজুর্ন নিজেকে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বীর মনে করতেন বলে তাঁর পতন হয়েছে। তারপর ভীম পড়ে গেলে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, অতি ভেজন আর শক্তির গর্বের জন্য তোমার পতন হয়েছে। তখন ইন্দ্র রথে করে তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলেন। ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে রথে উঠতে বললে যুধিষ্ঠির কুকুরটিকে ফেলে রেখে একা স্বর্গে যেতে চাইলেন না। তখন কুকুররূপী ধর্ম নিজের রূপে দেখা দিলেন। সামান্য এক কুকুরের জন্য যিনি স্বর্গত্যাগ করতে পারেন তাঁর মত ধার্মিক আর কে থাকতে পারে? ধর্ম যুধিষ্ঠিরের মহত্বে তুষ্ট হলেন এবং সশরীরে স্বর্গে গমনের নির্দেশ দিলেন। স্বর্গে গিয়ে তিনি ভ্রাতাগণকে না দেখতে পাওয়ায় তাঁদের দেখার ইচ্ছা করেন। তাঁরপর দেবদূতগণ যুধিষ্ঠিরকে নরকে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি ভ্রাতাগণের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করেন। তাঁরপর যুধিষ্ঠির আকাশগঙ্গায় স্নান করে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে দিব্যদেহ ধারণ করে স্বর্গে যান এবং সেখানে গিয়ে তাঁর ভ্রাতাগণ ও দ্রৌপদী সহ অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এভাবে মহাভারতের কাহিনী সমাপ্ত হয়।

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

ঈশ্বরতত্ত্ব










 হিন্দু দেবতা




 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন