7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

৩১ জানুয়ারী, ২০২২

নিত্যকর্ম পদ্ধতি

নিত্যকর্ম

নিত্যকর্ম পদ্ধতি

নিত্যকর্ম কি?

নিত্যকর্ম কত প্রকার?

নিত্যকর্ম কখন কোথায় করতে হয়?

    প্রত্যহ যেসব কর্তব্য-কর্মের মাধ্যমে মনুষের পুণ্যলাভ হয় সেসব প্রাত্যহিক কর্মকে নিত্যকর্ম বলে। প্রাতঃকৃত্য, প্রাতঃস্নান, পিতৃতর্পণ, সন্ধ্যা প্রভৃতি নিয়েই নিত্যকর্ম পদ্ধতি। নিত্যকর্মকে ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্ণ-কৃত্য, মধ্যাহ্ন-কৃত্য, অপরাহ্ণ-কৃত্য, সায়াহ্ন-কৃত্য এবং রাত্রি-কৃত্য। নিচে প্রাতঃকৃত্যের বর্ণনা দেয়া হল।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি :

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : প্রাতঃকৃত্য

    প্রাতঃকৃত্য শুরু হয় সূর্যোদয়ের পূর্বে রাত্রির শেষ যামার্ধে। প্রাতঃকৃত্য বলতে নিদ্রা হতে জাগরণ, প্রাতঃস্মরণ, শৌচকর্ম, প্রাতঃস্নান প্রভৃতি কর্ম বোঝায়। শাস্ত্রে ব্রহ্মমুহূর্তে নিদ্রা হতে জাগ্রত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। রাত্রির শেষ যামার্ধ অর্থাৎ রাত্র ৪ টা ৩০ মিনিট হতে ভোর ৬টা পর্যন্ত সময়কে ব্রহ্মমুহূর্ত বলে। 

করতল দর্শন

    নিদ্রাভঙ্গের পর প্রথমে নিম্নোক্ত মন্ত্রে করতল দর্শন করতে হয়

করাগ্রে বসতে লক্ষ্মীঃ করমধ্যে সরস্বতীঃ।

করমূলে স্থিতো ব্রহ্মা প্রভাতে করদর্শনম্।।

অর্থাৎ প্রভাতে করদর্শনের মাধ্যমে করের অগ্রভাগে লক্ষ্মী, করের মধ্যভাগে সরস্বতী এবং করমূলে অধিষ্ঠানকারী ব্রহ্মার প্রতিচ্ছবি দর্শন করতে হয়। তারপর ইষ্টদেবতাকে করজোড়ে নমস্কার করে শয্যার উপর উত্তরমুখী হয়ে বসে প্রাতঃস্মরণীয় বিষয় চিন্তা ও পাঠ করতে হয়। 

নবগ্রহ স্মরণ

    প্রথমেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং নবগ্রহের স্মরণ ও তাঁদের নমস্কার করতে হয়। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব হলেন সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের দেবতা। তাই শুরুতেই তাঁদের স্মরণ করতে হয়। নবগ্রহ দ্বারা মানুষের কর্ম ও ভাগ্য প্রভাবিত হয়। নবগ্রহের কুপ্রভাবে মানুষের জীবনে নানা বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিঘ্ননাশের জন্য ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবের সাথে নবগ্রহের স্মরণ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন একান্ত কর্তব্য। নিম্নোক্ত মন্ত্রে ত্রিদেব ও নবগ্রহের স্মরণ করতে হয়।

ওঁ ব্রহ্মামুরারি স্ত্রিপুরান্তকারী, ভানুঃ শশী ভূমিসুতো বুধশ্চ।

গুরুশ্চ শুক্রঃ শনি রাহু কেতুঃ কুর্বন্তু সর্বে মম সুপ্রভাতম্ ।।

অর্থাৎ ব্রহ্মা, মুরারি (বিষ্ণু), ত্রিপুর বিনাশীকারী (শিব), ভানু (রবি), শশী (চন্দ্র), ভূমিসুত (মঙ্গল), বুধ, গুরু (বৃহস্পতি), শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু সকলে আমার সুপ্রভাত গ্রহণ করুন। তারপর দীক্ষিত ব্যক্তিদের গুরুকে স্মরণ ও নমস্কার করতে হয়।

আত্মচিন্তা 

   দীক্ষিত ও অদীক্ষিত সকলেরই নিম্নোক্ত মন্ত্রে আত্মচিন্তা করতে হয়

অহং দেবো ন চান্যেহস্মি, ব্রহ্মৈবাহংন শোকভাক্।

সচ্চিদানন্দ রূপোহহং, নিত্যমুক্তঃ স্বভাববান্ ।।

আমি দেব, অন্য কেউ নই, আমি ব্রহ্ম, আমি সৎ, চৈতন্যময় ও আনন্দময়। আমি শোকে অভিভূত হই না, আমি সর্বদা মুক্তস্বভাব। 

আত্মনিবেদন

আত্মচিন্তনের পর নিম্নোক্ত মন্ত্রে আত্মনিবেদন করতে হয়।

লোকেশ চৈতন্যময়াধিদেব, শ্রীকান্তবিষ্ণো ভবদাজ্ঞৈব।

প্রাতঃ সমুত্থায় তব প্রিয়ার্থং সংসারযাত্রা মনুবর্তয়িষ্যে ।।

জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তি জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।

ত্বয়া হৃষীকেশঃ হৃদিস্থিতেন, যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি ।।

হৃদয়ে যে পরম দেবতার বাস, তিনি যে কার্যে আমাকে প্রেরণ করেছেন, আমি তাই করছি, জগত্রয়ে আমার নিজের কোন কার্যই নাই। ধর্মজনক যা কিছু আছে, তা সকলই জানি কিন্তু তাতে আমার প্রবৃত্তি নাই। পাপজনক যা কিছু আছে তাও জানি, তাতেও আমার অপ্রবৃত্তি নাই। হে হৃদিস্থিত হৃষীকেশ, তবুও যা কিছু করছি, তা তোমার নিয়োগ অনুসারে মাত্র, আমার নিজের প্রবৃত্তি বশে নয়। হে লোকেশ, হে চৈতন্যময়াধি দেব, হে শ্রীকান্ত, হে বিষ্ণু, আমি তোমার প্রীতি সম্পাদনের জন্যই তোমার আজ্ঞা অনুসারে প্রাতেঃ জাগ্রত হয়ে সংসার-যাত্রা নির্বাহ করছি। 

দেবীপক্ষে বিশেষ মন্ত্র 

দেবীপক্ষে প্রাতেঃ এক বিশেষ মন্ত্র পাঠ করতে হয়, তা এরকম

প্রাতঃ প্রভৃতি সায়ান্তং সায়াদি প্রাতরন্ততঃ।

যৎ করোমি জগত্যর্থে তদস্তু তব পূজানম্ ।।

ত্রৈলোক্য রক্ষাধিময়ে সুরেশী, শ্রীপার্বতী ত্বচ্চরণাজ্ঞৈব।

প্রাতঃ সমুত্থায় তব প্রিয়ার্থং, সংসারযাত্রা মনুবর্তয়িষ্যে ।।    

হে ত্রিলোকের চৈতন্যময়ী, হে ঈশ্বরের ঈশ্বরী, হে সুরেশী, হে শ্রী পার্বতী, আমি প্রাতঃকাল হতে সায়হ্ন এবং সায়াহ্ন হতে প্রাতঃ পর্যন্ত জগতের নিমিত্ত যা কিছু করছি তা তোমারই পূজন আর তোমার প্রীতি সম্পাদনের জন্য, তোমারই শ্রীচরণের আজ্ঞা অনুসারে প্রত্যূষে জাগ্রত হয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহ করছি। 

কলিদোষ নাশনের জন্য মন্ত্র

    কলিদোষ নাশনের জন্য নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়।

কর্কোটকস্য নাগস্য দময়ন্ত্যা নলস্য চ।

ঋতুপর্ণস্য রাজর্ষেঃ কীর্তনং কলিনাশনম্ ।।

কলিদোষ নাশনের নিমিত্ত, কর্কোটক নাগ, নল ও দময়ন্তী এবং রাজর্ষি ঋতুপর্ণের নাম স্মরণ করবে। 

অর্থনাশ নিবারণ ও নষ্টদ্রব্য পুন-প্রাপ্তির  মন্ত্র

    অর্থনাশ নিবারণ ও নষ্টদ্রব্য পুন-প্রাপ্তির জন্য মৎস্য পুরাণের নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়।

কার্তবীর্যার্জুনো নাম রাজা বাহু সহস্রভৃৎ।

যোহস্য সংকীর্তয়েন্নাম কল্যমুত্থায় মানবঃ।

ন তস্য বিত্তনাশঃ স্যান্নষ্টঞ্চ লভতে পুনঃ ।।

যে মানব প্রাতঃকালে নিদ্রা হতে জাগরিত হয়ে সহস্রবাহুধারী কার্তবীর্যাজুর্ন নামক রাজার নাম-কীর্তন করে, তার বিত্তনাশ হয় না এবং হৃত বা নষ্টদ্রব্যের পুন-প্রাপ্তি হয়ে থাকে। 

পুণ্যশ্লোক স্মরণ

    নিম্নোক্ত মন্ত্রে পুণ্যশ্লোকগণের নাম স্মরণ করতে হয়।

পুণ্যশ্লোক নলো রাজা পুণ্যশ্লোকো যুধিষ্ঠিরঃ।

পুণ্যশ্লোকা চ বৈদেহী পুণ্যশ্লোকো জনার্ধনঃ ।।

রাজা নল, মহারাজা যুধিষ্ঠির, বৈদেহী (সীতা) ও জনার্ধন (বিষ্ণু) এই সকল পূন্যশ্লোকগণের নাম স্মরণ করবে।

পঞ্চকন্যা স্মরণ

    পুণ্যশ্লোকগণের নাম স্মরণ করে পঞ্চকন্যার নাম স্মরণ করতে হয়। এই পঞ্চকন্যার প্রত্যেকেই সতী ও প্রতিব্রতা ছিলেন। তাই তাঁদের স্মরণ করলেও মনে সৎ চিন্তা জাগ্রত হয় এবং পাপনাশ হয়।

অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।

পঞ্চকন্যা স্মরোন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম্ ।।

মহাপাপ নাশের নিমিত্ত অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী এই পঞ্চকন্যার নাম স্মরণ করবে। 

দশমহাবিদ্যা স্মরণ

    নিম্নোক্ত মন্ত্রে দশমহাবিদ্যার নাম স্মরণ করতে হয়।

ওঁ কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্য ধূমাবতী তথা ।।

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্তিতা ।।

কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশমহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা বলে খ্যাতা। এরপর নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়।

প্রভাতে যঃ স্মরেন্নিত্যং দুর্গা দুর্গাক্ষরদ্বয়ম্।

আপদস্তস্য নশ্যন্তি তমঃ সূযোর্দয়ে যথা ।।

প্রতিদিন প্রভাতে “দুর্গা দুর্গা” এই অক্ষরদ্বয় স্মরণ করলে সূর্যোদয়ে অন্ধকার বিনাশের মত তাঁর আপদসমূহ দূরীভূত হয়ে থাকে। 

ভূমি বা পৃথিবী প্রণাম

    “ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈঃ ভূবে নমঃ” মন্ত্রে পৃথিবীকে নমস্কার করে নিম্নোক্ত মন্ত্রে ভূমিতে পদ-স্পর্শ করতে হয়।

ওঁ সমুদ্রমেখলে দেবী পর্বতস্তন মণ্ডলে।

বিষ্ণুপত্নী নমস্তেহস্তু পাদস্পর্শং ক্ষমস্ব মে ।।

সমুদ্র যার মেখলা (কটিবন্ধনী) স্বরূপ, পর্বতসমূহ যার স্তনমণ্ডল স্বরূপ, সেই বিষ্ণুপত্নী ভূমিকে নমস্কার। আপনি আমার পাদস্পর্শ জনিত অপরাধ ক্ষমা করুন। এরপর শুভ বস্তু স্পর্শ করতে হয়, যেন শুভ বস্তুর স্পর্শে সম্পূর্ণ দিনটি শুভ হয়ে যায়। বিদ্বান ব্রাহ্মণ, সৌভাগ্যবতী ও সাধ্বী স্ত্রী, অগ্নি, গরু এবং সাগ্নিক ব্রাহ্মণের মুখ দর্শন করে গরু, ঘৃত, দধি, সর্ষপ (সরিষা), প্রিয়ঙ্গু প্রভৃতি শুভবস্তু স্পর্শ করলে সকল পাপ হতে মুক্তি লাভ করা যায়। এরপর শৌচকার্য বা মলত্যাগ বিধেয়।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : শৌচকর্ম ও দন্তধাবন

    মানুষের দেহে দ্বাদশ প্রকার মল আছে। এর মধ্যে বসা (চর্বি), শুক্র, অসৃক (রক্ত), মজ্জা, মুত্র ও বিষ্ঠা এই ছয় প্রকার মল মৃত্তিকা ও জলের দ্বারা শুদ্ধ করতে হয় এবং ঘ্রাণবিট্ (নাসিকা মল) কর্ণবিট (কর্ণ মল), শ্লেষ্মা, অশ্রু, ধূষিকা (চক্ষুর পেচঁড়া) ও স্বেদ (ঘর্ম) এই ছয় প্রকার মল শুধু জল দ্বারা শুদ্ধ করতে হয়। মলত্যাগের পর উই ও ইদুঁর কতৃর্ক উত্তোলিত মৃত্তিকা এবং জল দ্বারা শৌচকর্ম করতে হয়। জলে মলমূত্র ত্যাগ নিষিদ্ধ। দিনে উত্তরমুখ এবং রাত্রিতে দক্ষিণমুখ হয়ে মলমূত্র ত্যাগ, মৈথুন, প্রস্রাব, দন্তধাবন, স্নান করা উচিত এবং ভোজনকালে মৌনী থাকা অর্থাৎ কথা না বলা আবশ্যক। এখন দন্তধাবন প্রসঙ্গে আসা যাক। সূর্যোদয়ের পূর্বে চার দণ্ডের (৯৬ মিনিট) মধ্যে দন্তধাবন কর্তব্য। পূর্ব ও উত্তরমুখে বসে দন্তধাবন করা বিধেয়। দন্তধাবনে কখনো তর্জনী ব্যবহার করা উচিত নয়। খদির, নিম, আপাঙ্, কদম্ব, করঞ্জ, বট, তিন্তিড়ী (তেঁতুল), বাঁশ, আম, বিল্ব, অর্কবৃক্ষ (আঁকড় গাছ), যজ্ঞডুমুর এবং তিক্ত, কষায় ও কটুরসযুক্ত বৃক্ষ, কণ্টকযুক্ত, সুগন্ধি ও ক্ষীরযুক্ত বৃক্ষের দণ্ড দ্বারা দন্তধাবন বিধেয়। তবে শ্রাদ্ধদিনে, জন্মতিথিতে, বিবাহ দিনে, অজীর্ণ হলে, চান্দ্রায়ণের দিনে, উপবাসের দিনে এবং প্রতিপদ, পর্বদিন, ষষ্ঠী, চতুর্দশী, অষ্ঠমী, নবমী ও রবিবারে দন্তকাষ্ঠ বর্জন করতে হয়।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : স্নানবিধি

    শাস্ত্রে মান্ত্র, ভৌম, আগ্নেয়, বায়ব্য, দিব্য, বারুণ ও মানস এই সাত প্রকার স্নানের উল্লেখ আছে। ঋক্-মন্ত্রের মাধ্যমে যে দেহশুদ্ধি তাকে মন্ত্র-স্নান বলে। গঙ্গাদি মৃত্তিকা দ্বারা তিলক-ধারণের মাধ্যমে যে দেহশুদ্ধি তাকে ভৌম-স্নান বলে। সংস্কৃত (শুদ্ধ) ভস্মের দ্বারা শরীর লেপনকে আগ্নেয়-স্নান বলে। গরুর ক্ষুরের দ্বারা সৃষ্ট ধূলিস্পর্শে বায়ব্য-স্নান হয়। রৌদ্র-সমন্বিত বৃষ্টিজলে যে স্নান তা দিব্য-স্নান নামে পরিচিত। জলে অবগাহন করে অর্থাৎ নিমজ্জিত হয়ে যে স্নান তাকে বারুণ-স্নান বলে। বিষ্ণুস্মরণ অর্থাৎ বিষ্ণুর পাদপদ্ম নিঃসৃত গঙ্গাজলে স্নান করছি, মনে মনে এমন চিন্তা করাই মানস-স্নান। প্রথমে স্রোতের দিকে মুখ করে অথবা সূর্যদেবের দিকে মুখ করে জলে নিমগ্ন হয়ে নারায়ণ, গঙ্গা ও ইষ্টদেবের স্মরণ করতে হয়। তারপর মুক্ত কেশ হয়ে অবগাহন করে কৃতাঞ্জলি হয়ে (হাত-জোড় করে) সূর্যমণ্ডল হতে তীর্থ আবাহন করতে হয়। নিম্নোক্ত মন্ত্রে তীর্থ আকর্ষণ বা আবাহন করা হয় 

ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।

নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেস্মিন্ সন্নিধিং কুরু ।।

ব্রহ্মাণ্ডে দেবতীর্থানি করৈঃ স্পষ্টানি তে রবেঃ।

তেন সত্যেন মে দেব! তীর্থর্ং দেহি দিবাকর! ।।

প্রিয়ব্রতানি তীর্থানি সূর্যরশ্মিস্থিতানি চ।

আগত্যার্ঘ্যং গৃহীত্বা সর্বসিদ্ধিং প্রযচ্ছ মে।

চতুস্রঃ বিনির্মায় তত্র স্নানং দিশেৎ সুধীঃ ।।

-হে গঙ্গে, হে যমুনে, হে গোদাবরি, হে সরস্বতি, হে নর্মদে, হে সিন্ধু, হে কাবেরি, আপনারা এই জলে বাস করুন। হে সূর্যদেব, ব্রহ্মাণ্ডে যেসব দেবতীর্থে আপনার কর স্পর্শ পড়েছে আমাকে সেসব দেবতীর্থ প্রদান করুন। সূর্যরশ্মিস্থিত কল্যাণকারক যে সকল তীর্থ আছেন, তাঁরা আগমন পূর্বক অর্ঘ্য গ্রহণ করে আমাকে সর্বসিদ্ধি দান করুন। এই স্থান সুধী ব্যক্তি একটি চতুষ্কোণ-মণ্ডল নিমার্ণ করে তার মধ্যে স্নান করবে”। উক্ত মন্ত্রে তীর্থ আবাহন করে অঙ্কুশমুদ্রা সহযোগে “বং” এই বীজমন্ত্র দ্বারা ঐ তীর্থগণকে জলে সংযোগ করতে হয়। তারপর ঐ স্থানকে সোম (চন্দ্র), সূর্য ও অগ্নিমণ্ডল চিন্তা করে তার মধ্যে স্নান করা বিধেয়। শাস্ত্রোক্ত এই পদ্ধতিতে স্নান করলে নদী ও পুষ্করিণীর জলে স্নান করেও তীর্থস্নানের ফল হয়। তীর্থ আবাহনের অন্য একটি মন্ত্র আছে, যথা

ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।

নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেস্মিন্ সন্নিধিং কুরু ।।

ওঁ কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করানি চ।

পুণ্যান্যেতানি তীর্থানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ ।।

হে গঙ্গে, হে যমুনে, হে গোদাবরি, হে সরস্বতি, হে নর্মদে, হে সিন্ধু, হে কাবেরি, আপনারা এই জলে বাস করুন। কুরুক্ষেত্র, গয়া, গঙ্গা, প্রভাস ও পুষ্কর এই সকল পূণ্যতীর্থসমূহ স্নানের সময় অবস্থান করছেন। প্রাচীনকালে স্নানের সময় গাত্রমল দূরীভূত করার জন্য গাত্রে মৃত্তিকা লেপন করা হত। নিম্নোক্ত মন্ত্রে মৃত্তিকা লেপন করা হত।

ওঁ অশ্বক্রান্তে রথক্রান্তে বিষ্ণুক্রান্তে বসুন্ধরে!

মৃত্তিকে হর মে পাপং যন্ময়া দুষ্কৃতং কৃতম্।

ওঁ উদ্ধতাসি বরাহেণ কৃষ্ণেন শতবাহুনা।

নমস্তে সর্বদেবানাং প্রভবারুণী সুব্রতেঃ।

ওঁ আধারং সর্বরূপস্য বিষ্ণুরতুল তেজসঃ।

তদ্রূপাশ্চ ততো জাতা অগ্নে তাঃ প্রণমাম্যহম্।

ইত্যপদিশ্যাম্ভসি ত্রির্ণিমজ্জেৎ ততো বুধঃ ।।

হে অশ্বক্রান্ত, হে রথক্রান্ত, হে বিষ্ণুক্রান্ত, হে বসুন্ধরে, হে মৃত্তিকে, আমার দুষ্কার্যজনিত যে সকল পাপ তা বিনষ্ট করুন। বরাহ রূপে শ্রীকৃষ্ণ তোমাকে শতবাহুর দ্বারা উদ্ধার করেছিলেন, আমার গাত্রে আরোহণ করে আমার সকল পাপ বিমোচন করুন। হে মৃত্তিকে, ব্রহ্মাদত্তে, কাশ্যপ অভিমন্ত্রীতে, হে সর্বভূত প্রসবিনী, সুব্রতে, তোমাকে নমস্কার। সর্বরূপের আধার স্বরূপ বিষ্ণুর তুল্য তেজযুক্তা এবং তাঁর কতৃর্ক জন্মলাভ করেছ বলে তোমাকেই অগ্রে প্রণাম করি। এই মন্ত্র বলার পর চক্ষু, কর্ণ ও নাসিকা বন্ধ করে জলে তিন বার ডুব দিতে হয়।

    স্নান করার পূর্বে শরীরে তৈল-মর্দন করতে হয়। তবে রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতি বার তৈল-মর্দন নিষিদ্ধ। স্নানের শুরুতেই নাভিজলে দণ্ডায়মান হয়ে আচমন পূর্বক সঙ্কল্প করতে জয়। যথা বিষ্ণু ওঁ তৎসৎ অদ্য অমুক মাসি (মাসের নাম উল্লেখ করতে হয়), অমুক তিথৌ (তিথির নাম উল্লেখ করতে হয়), অমুক গোত্রঃ (গোত্রের নাম উল্লেখ করতে হয়), শ্রী অমুক দেবশর্মা (নিজের নাম), শ্রী নারায়ণ প্রীতয়ে অস্যাং নদ্যাং (নদীর নাম)  বা গঙ্গায়াং বা তড়াগে (নদী বা দীঘীর নাম) স্নানমহং করিষ্যে। স্নানকালে তর্পণ করা বিধেয়। দেবতা, ঋষি ও পিতৃপুরুষের তৃপ্তি-সাধনের জন্য যে কর্ম, তাই তপর্ণ। স্নানকালে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তিলজল তর্পণ করা সকল পুত্রের জন্যই আবশ্যক। সামবেদীয়গণের তর্পণ বাক্য এরকম “বিষ্ণুরোম অমুকাগোত্রঃ পিতা অমুক দেবশর্মা তৃপ্যতামেতৎ সতিলোদকং তস্মৈ স্বধা” অর্থাৎ বিষ্ণুকে স্মরণ করে অমুক গোত্রের অমুকের তৃপ্তির জন্য তিল ও জল অর্পণ করছি। পিতামহ, মাতামহ, প্রপিতামহ, প্রমাতামহ প্রভৃতি পিতৃপুরুষের উদ্ধেশ্যে তর্পণের ক্ষেত্রে পিতার গোত্র নামের স্থলে তাঁদের গোত্রের নাম উল্লেখ করতে হয়। প্রত্যেকের উদ্ধেশ্যে তিল সহ এক অঞ্জলি জল প্রদান করা হয়।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী

    প্রত্যেক হিন্দুধর্মাবলম্বীর তিন বেলা সন্ধ্যা কর্তব্য। ব্রহ্ম-গায়ত্রী প্রভৃতি মন্ত্র জপ করাই হল সন্ধ্যা। ভাগবতে আছে নক্ষত্র থাকতে থাকতে প্রাতঃসন্ধ্যা, সূর্য মাথার উপরে উঠলে মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যা এবং সূর্য অর্ধেক ডুবেছে এমন সময় সায়ং-সন্ধ্যায় বসবে। প্রকৃতপক্ষে প্রাতঃসন্ধ্যার সময় সূর্যোদয়ের ২৪ মিনিট পূর্ব হতে সূর্যোদয়ের পর ২৪ মিনিট পর্যন্ত। মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যার সময় ১১ টা ৪৮ মিনিট হতে ১ টা ১২ মিনিট পর্যন্ত। সূর্যাস্তের দুই ঘণ্টা পূর্ব হতেই সায়ং-সন্ধ্যা শুরু করতে হয়। প্রত্যেক সন্ধ্যার পূর্বেই স্নান করা আবশ্যক। তবে তিন বার স্নান করতে অসমর্থ হলে শুধু প্রাতঃসন্ধ্যার পূর্বে স্নান করতে হয়। কুশাসন, ঊর্ণাশন বা মৃগচর্মের উপর বসে সন্ধ্যা করা বিধেয়। প্রাতঃ ও মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যায় পূর্বমুখ হয়ে এবং সায়ং-সংন্ধ্যায় উত্তরমুখ হয়ে বসতে হয়। তারপর আচমন, বিষ্ণুস্মরণ, প্রাণায়াম ও ধ্যান সম্পন্ন করে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করা বিধেয়। গায়ত্রীমন্ত্র জপের পূর্বে গায়ত্রীর আবাহন এবং ধ্যান করতে হয়। প্রভাতে গায়ত্রী, মধ্যাহ্নে সাবিত্রী এবং সায়াহ্নে সরস্বতীর ধ্যান করতে হয়। গায়ত্রী জপকালে নিগুর্ণ-ব্রহ্মকে ত্রিগুণময়ী ও শিবশক্তি রূপে চিন্তা করতে হয়। প্রাতঃসন্ধ্যার সময় হৃদয়ের নিকট দক্ষিণ হস্ত চিৎ রেখে, মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যার সময় দক্ষিণ হস্ত বক্র রেখে এবং সায়ং-সন্ধ্যার সময় দক্ষিণ হস্ত অধোমুখ রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রপর্ব দ্বারা অনামিকার মূলপর্ব থেকে জপ শুরু করে কনিষ্ঠার মূল, মধ্য ও অগ্রপর্ব, অনামিকার অগ্রপর্ব, মধ্যমার অগ্র এবং তর্জনীর অগ্র, মধ্য ও মূলপর্বে পর্যন্ত জপ করলে ১০ বার জপ সম্পন্ন হয়।  সাধ্যানুসারে দশ, অষ্টোত্তর শত (১০৮) বা অষ্টোত্তর সহস্র (১০০০৮) গায়ত্রী জপ করতে হয়। “ওঁ ভূঃ ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভগোর্দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎঃ ওঁ” এই ব্রহ্ম-গায়ত্রী মন্ত্র জপ শেষে তাঁকে নিম্নোক্ত মন্ত্রে বিসর্জন দিতে হয়।

ওঁ মহেশ বদনোৎপন্না বিষ্ণোহৃর্দয় সম্ভবা।

ব্রহ্মণা সমনুজ্ঞাতা গচ্ছ দেব যথেচ্ছয়া ।।

মহেশ্বরের বদন ও বিষ্ণুর হৃদয় হতে উৎপন্না গায়ত্রী দেবী, ব্রহ্মার নির্দেশ মত যেখানে ইচ্ছা সেখানে গমন করুন। গায়ত্রী-মন্ত্র বিসর্জন শেষে আত্মরক্ষা ও রুদ্রোপস্থান মন্ত্র পাঠ করে সূর্যার্ঘ্য দান ও সূর্যপ্রণাম করতে হয়। সূর্যপ্রণাম শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে ত্রুটি মার্জনার জন্য গায়ত্রী দেবীকে এক অঞ্জলি জল প্রদান করতে হয়।

ওঁ যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ভবেৎ।

পূর্ণং ভবতু তৎসর্বং তৎপ্রসাদাৎ সুরেশ্বরি ।।

অর্থাৎ হে সুরেশ্বরি, আমার এই সকল মন্ত্র উচ্চারণে যদি কোন অক্ষর পরিভ্রষ্ট হয়ে থাকে এবং যদি কোন অক্ষর মাত্রাহীন হয়ে থাকে, তোমার কৃপায় তা সব কিছুই পূর্ণ (শুদ্ধ) হোক।  

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : ভোজন বিধি

    পঞ্চার্দ্র হয়ে অর্থাৎ দক্ষিণ হস্ত, বাম হস্ত, দক্ষিণ পদ, বামপদ এবং মুখ এই পঞ্চ অঙ্গ ধৌত করে পূর্বমুখ হয়ে বসে মৌনী হয়ে (কথা না বলে) আহার করতে হয়। ব্রাহ্মণগণকে চতুষ্কোণ মণ্ডল, ক্ষত্রিয়গণকে ত্রিকোণ মণ্ডল, বৈশ্যগণকে অর্ধচন্দ্রাকার এবং শূদ্রগণকে বতুর্লাকার মণ্ডল অঙ্কিত করে তার উপর ভোজন-পাত্র রেখে আহার গ্রহণ করতে হয়। ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসী এবং বিধবাদের কাংস্যপাত্রে ভোজন নিষিদ্ধ। অন্নগ্রহণের পূর্বে সুপ্রোক্ষিতম্অস্তু (উত্তমরূপে সিক্ত করলাম) বলে অন্ন-ব্যঞ্জনাদির উপর জলের ছিটা দিয়ে অবগুণ্ঠন ও ধেনু-মুদ্রা প্রদর্শন করে মৎস্য-মুদ্রা দ্বারা অন্ন আচ্ছাদিত করতে হয়। তারপর অন্ন-ব্যঞ্জনের উপর দশবার গায়ত্রী-মন্ত্র জপ করতে হয়। মানুষের দেহে দশটি বায়ু ভোজন ও পরিপাকে সাহায্য করে। তার মধ্যে নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয় এই পঞ্চবায়ুকে বাহ্য-পঞ্চবায়ু এবং প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান এই পঞ্চবায়ুকে অন্তর-পঞ্চবায়ু বলে। ভোজনের পূর্বে বাহ্য-পঞ্চবায়ুকে ভূতিবলি প্রদান করা হয়। এজন্য ভূমিতে অল্প পরিমান অন্ন পাঁচভাগে রেখে “ওঁ নাগায় নমঃ, ওঁ কূর্মায় নমঃ, ওঁ কৃকরায় নমঃ, ওঁ দেবদত্তায় নমঃ, ওঁ ধনঞ্জয়ায় নমঃ” বলে প্রত্যেক ভাগে একটু জল দিতে হয়। তারপর এক গণ্ডূষ (এক কোষ) জল নিয়ে অর্ধেক পান করতে হয় এবং অবশিষ্ট জল দ্বারা অন্নের উপর আস্তরণ দিতে হয়। এক আপোশান বলে। আপোশানকালে অমৃতঃ উপস্তরণমসি স্বাহা (অমৃতের আস্তরণ দিলাম) মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয় অর্থাৎ তখন ভোক্তাকে মনে মনে চিন্তা করত হয় যেন অন্নের উপর জল রূপ অমৃতের আস্তরণ বা আচ্ছাদন দেয়া হয়েছে। এরপর অন্তর-পঞ্চবায়ুকে অন্নে আহুতি দিতে হয়। উপনিষদে বলা হয়েছে অন্নই ব্রহ্ম। তাই অন্নে প্রাণবায়ু আহতি দিলে মূলত ব্রহ্মেই আহুতি দেয়া হয়। তর্জনী, মধ্যমা ও অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা “ওঁ প্রাণায় স্বাহা” মন্ত্রে প্রাণবায়ুকে; মধ্যমা, অঙ্গুষ্ঠ ও অনামিকা দ্বারা “ওঁ অপানায় স্বাহা” মন্ত্রে অপান বায়ুকে; কনিষ্ঠা, অঙ্গুষ্ঠ ও অনামিকা দ্বারা “ওঁ সমানায় স্বাহা” মন্ত্রে সমান বায়ুকে; কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা ও অঙ্গুষ্ঠ এই চতুরাঙ্গুলি দ্বারা “ওঁ উদানায় স্বাহা” মন্ত্রে উদান বায়ুকে এবং পঞ্চাঙ্গুলি দ্বারা “ওঁ ব্যানায় স্বাহা” মন্ত্রে ব্যান বায়ুকে আহুতি দেওয়া হয়। এভাবে নির্দিষ্ট মন্ত্রে নিদিষ্ট আঙ্গুলি সহযোগে অন্নে ঘৃতপ্রদানের মাধ্যমে ব্রহ্মে প্রাণবায়ুকে আহুতি দেয়া হয়। এর পর আহার শুরু করতে হয়। শাস্ত্রমতে প্রথমে মিষ্টি, তারপর লবণ, লবণের পর অম্ল, অস্লের পরে কটু এবং অবশেষে তিক্ত আহার গ্রহণ কর্তব্য। ব্রাহ্মণগণের সাথে ভোজন করতে বসলে এক ব্যক্তি পাত্র ত্যাগ করলে সকলকেই ত্যাগ করতে হয় অর্থাৎ শেষান্ন ভোজন করতে নেই। ভোজন শেষে অন্নযুক্ত হস্তে এক গণ্ডূষ জল নিয়ে ওঁ অমৃতঃ অপিধানমসি স্বাহা (অমৃত ধারণ করে শেষ করলাম) মন্ত্রে প্রত্যোপশান অর্থাৎ অর্ধেক জল পান করে অবশিষ্টাংশ মাটিতে ফেলতে হয়।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : শাস্ত্রপাঠবিধি

    মনুসংহিতায় বলা হয়েছে বর্ষাকালে এবং রাত্রিতে বেদপাঠ নিষিদ্ধ। ভূমিকম্প, ঝড় প্রভৃতি দুর্যোগকালেও বেদপাঠ নিষিদ্ধ। জলমধ্যে দাঁড়িয়ে, মধ্যরাত্রির চতুর্থ মুহুর্তে, মলমুত্র ত্যাগর সময়, উচ্ছিষ্ট অবস্থায় এবং শ্রাদ্ধীয় নিমন্ত্রন গ্রহণ করে মনে-মনেও বেদ চিন্তা করা উচিত নয়। চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সময়, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমী ও চতুর্দশী তিথিতে বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। কলহকালে, যুদ্ধকালে, সবেমাত্র ভোজন করে, অজীর্ণ হলে অর্থাৎ আগের দিনের অন্ন পরের দিন পরিপাক না হলে, বমি করার পর এবং ঢেকুর তুলতে তুলতে বেদ অধ্যয়ন করা উচিত নয়। কোন কারণে দেহে রক্তপাত হলেও বেদ অধ্যয়ন অকর্তব্য। অশ্ব, বৃক্ষ, হস্তী, গাধা, উট ও নৌকায় আরোহন করে বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। শ্মশানের নিকটে, গোচারণ স্থানে, মৈথুনকালীন বস্ত্র পরিধান করে এবং শ্রাদ্ধীয়-দ্রব্য গ্রহণ করে বেদ পাঠ অকর্তব্য। প্রাতঃ-সন্ধ্যা এবং সায়ং-সন্ধ্যাকালে বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। একমাত্র মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যাকালেই বেদ অধ্যয়ন কর্তব্য।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : পূর্বাহ্ণ-কৃত্য

    পূর্বাহ্ন-কৃত্য প্রথম যামার্ধ হতে তৃতীয় যামার্ধ অর্থাৎ ভোর ৬ টা হতে ৭ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে করণীয়। দেবগৃহ পরিষ্কার, গুরু ও মাঙ্গল্য দ্রব্য দর্শন, দর্পণে মুখ দর্শন, কেশ প্রসাধন এবং পুষ্প, তুলসী ও বিল্বপত্র চয়নাদি কর্ম প্রথম যামার্ধে অথার্ৎ ৬ টা হতে ৭ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে করতে হয়। এরপর বেদপাঠ দ্বিতীয় যামার্ধে অর্থাৎ ৭ টা ৩০ মিনিট হতে ৯ টার মধ্যে করতে হয়। তৃতীয় যামার্ধে অর্থাৎ ৯ টা হতে ১০ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মাতা, পিতা, গুরু, স্ত্রী এবং দরিদ্র আশ্রিত অতিথিদের ভরণ-পোষণের জন্য নিজ নিজ কর্ম দ্বারা অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত হওয়া কর্তব্য।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : মধ্যাহ্ন-কৃত্য

    পঞ্চম যামার্ধে অর্থাৎ ১২ টা হতে ১ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মধ্যাহ্নকৃত্য করণীয়। তখন নিত্য-হোম, নিত্য-শ্রাদ্ধ, অতিথি পূজা (সৎকার), গোখাদ্য দান, ভোজন প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন করতে হয়।

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : অপরাহ্ণ-কৃত্য

    অপরাহ্ণ-কৃত্য ষষ্ঠ ও সপ্তম যামার্ধে অর্থাৎ দুপুর ১ টা ৩০ মিনিট হতে ৪ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে করণীয়। এসময় পুরাণাদি শাস্ত্র পাঠ ও আলোচনা করা বিধেয়। অষ্টম যামার্ধে অর্থাৎ বিকাল ৪ টা ৩০ মিনিট হতে সূর্যাস্তের মধ্যে সায়াহ্ন-কৃত্য করণীয়। তখন পশ্চিমদিকে অথবা বায়ুকোণে মুখ করে সায়ন্তনী সন্ধ্যা ও গায়ত্রী জপ করতে হয়। 

নিত্যকর্ম পদ্ধতি : রাত্রি-কৃত্য

    রাত্রির প্রথম যামার্ধে অর্থাৎ ছয়টায় রাত্রি-কৃত্য শুরু হয়। তখন দিবাভাগের যে কর্মগুলো ভূলবশত করা হয়নি তা সম্পাদন করতে হয়। সূর্যাস্তের পর অতিথি বিমুখ হলে মহাপাপ হয় তাই এই সময় অতিথিকে যত্ন সহকারে ভোজন করাতে হয়। সাধারণত রাত্রি প্রথম প্রহর শেষে অর্থাৎ রাত নয়টার পর শয়ন করতে যাওয়া বিধেয়। শাস্ত্রে নির্দেশ আছে গোময় উপলিপ্ত, শুদ্ধ ও নির্জন স্থানে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে শির রেখে শয়ন করবে এবং শিরোদেশে মাঙ্গল্য ও জলপূর্ণ কুম্ভ (কলস) রাখবে। কখনও উত্তরশিরা হয়ে শয়ন করা উচিত নয়। শূন্যগৃহে, শ্মশানে, শিবমন্দিরে, বৃক্ষতলে, চতুষ্পথে, কাঁকর, লোষ্ট্র (মাটির ঢেলা) ও ধূলিযুক্ত স্থানে, গোশালায়, ধান্যক্ষেত্রে, বিপ্রভবনে এবং গুরুবর্গের সাথে এক শয্যায় শয়ন নিষিদ্ধ। এছাড়াও ভিজা-কাপড় পরে, নগ্ন হয়ে আবরণশূন্য স্থলে এবং ঊর্ধ আকাশ দৃশ্যমান হয় এমন স্থলে শয়ন করা উচিত নয়। শয়ন করার পর নিত্যকর্ম শেষ হয়।

    নিত্যকর্মের বিধি-বিধান ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তন ও শিথিলযোগ্য। যেমন প্রবাসে অনেক কর্ম করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন যথাসাধ্য কর্ম করলেই হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আদি বর্ণভেদেও নিত্যকর্মের ভিন্নতা থাকে। ব্রাহ্মণদের যতটা বিধিপূর্বক কর্ম করতে হয় ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের ততটা না করলেও চলে। দেশ-কাল-পাত্রভেদে কিছু কর্ম পরিবর্তিত হয়। যেমন পূর্বে শৌচকার্য ও স্নানে মৃত্তিকা ব্যবহারের রীতি থাকলেও বর্তমানকালে আবিষ্কৃত পরিষ্কারকদ্রব্য দ্বারা শৌচকার্য ও স্নান দোষণীয় নয়। এছাড়াও প্রাচীনকালে দন্তধাবনের জন্য ব্যবহৃত দন্তকাষ্ঠ বর্জন করে আধুনিক পদ্ধতিতে দন্তধাবন করাও ধর্ম-বিরুদ্ধ নয়। সময়ের সাথে সভ্যতা পরিবর্তিত হয় আর সেই সাথে পরিবর্তিত হয় কিছু বিধি-বিধানেরও। তবে যে পরিবর্তন ধর্ম-বিরুদ্ধ সে পরিবর্তন কখনোই কাম্য নয়। দিন যতই আধুনিক হোক না কেন সব সময় ঈশ্বর-দেবতায় ভক্তি স্থাপন করে কর্ম করা উচিত। কারণ জগৎ ও সময় পরিবর্তনশীল হলেও ঈশ্বর পরিবর্তনশীল নয়। 

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)

আরও পড়ুন



১৯ জানুয়ারী, ২০২২

ভক্তি যোগ এর তাৎপর্য

ভক্তি যোগ কি

ঈশ্বরের সাথে ভক্তির দ্বারা যুক্ত হওয়াকে ভক্তি যোগ বলে। ভাগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন নিজের স্বরূপের অনুসন্ধান করার নাম ভক্তি। আমি কে? কোথা থেকে আমার সৃষ্টি? কোথায় আমার লয়? এভাবে নিজের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে ঈশ্বরকে জানা যায় এবং শেষে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম জন্মে। সাথে

  মোক্ষকারণসামগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী

  স্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে।

  স্বত্মতত্ত্বানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যপরে জগুঃ।।

  বিবেকচূড়ামনি (৩১)

মোক্ষের সাধনসমূহের মধ্যে ভক্তিই শেষ্ঠ। নিজের স্বরূপের সন্ধানকেই ভক্তি বলে অভিহিত করা হয়। আবার অনেকে আত্মার ও পরমাত্মার তত্ত্ব-বিচারকেই ভক্তি বলে। শাণ্ডিল্য সূত্রে বলা হয়েছে “সা পরানুরক্তিরীশ্বরে” অর্থাৎ পরমেশ্বরে পরম অনুরাগকে ভক্তি বলে।

ভক্তিযোগ

ভক্তি কাকে বলে

নারদীয় ভক্তি সূত্রে বলা হয়েছে “সা ত্বস্মিন্ পরমপ্রেমরূপা” অর্থাৎ একমাত্র ঈশ্বরের প্রতি পরম প্রেমকে ভক্তি বলে। নারদীয় ভক্তি সূত্রের অন্যত্র বলা হয়েছে “নারদস্তু তদর্পিতাখিলাচারতা তদ্ বিস্মরণে” অর্থাৎ যখন সকল চিন্তা, সকল কথা ও সকল কর্ম ঈশ্বরে সমার্পণ করা হয়, যখন ক্ষণিকের জন্য ঈশ্বরকে ভুলে গেলে অবস্থা শোচনীয় হয়, তখন ভক্তির সঞ্চার হয়। পরাশরপুত্র ব্যাসদেব বলেছেন “পূজাদিষানুরাগ” অর্থাৎ পূজাদি কর্মে অনুরাগই ভক্তি।  গর্গ মুনি বলেছেন “কথাদিষু” অর্থাৎ শ্রবণ ও কীর্তনে অনুরাগই ভক্তি। শাণ্ডিল্য বলেছেন “আত্মরত্যবিরোধেন” অথাৎ চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী চিন্তা ত্যাগ এবং আত্মাতে প্রীতিলাভ করাই ভক্তি। নারদীয় ভক্তি সূত্রের এক স্থানে বলা হয়েছে “যৎ প্রাপ্য ন কিঞ্চিদ বাঞ্ছতি ন শোচতি ন দ্বেষ্টি ন রমতে নোৎসাহী ভবতি” অর্থাৎ ভক্তি এমন বস্তু যা পাবার পর মানুষ অন্য কিছু পাবার ইচ্ছা করে না, তিনি কখনও শোক করেন না, তিনি ঘৃণা ও হিংসা হতে মুক্ত হন, তিনি জীবনে অসার বস্তুতে আনন্দলাভ করেন না এবং তিনি কোন বস্তু পাবার জন্য আগ্রহ করেন না।

ভক্তি লাভের উপায়

নারদীয় ভক্তি সূত্রে ভক্তি লাভের উপায় সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ভক্তি লাভ করতে হলে প্রথমেই বিষয়-বাসনা ত্যাগ করতে হবে এবং বিষয়ের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। সহজ কথায় সাংসারিক সুখের আশা ত্যাগ করতে হবে। ভগবানের ভজনা করতে হবে, সংসারে সকল কাজে নিযুক্ত থেকেও ভগবানের নাম-গুণ শ্রবণ ও কীর্তন করতে হবে, মহাপুরুষের সান্নিধ্য লাভ ও সাধুসঙ্গ করতে হবে, দুঃসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ত্যাগ করতে হবে এবং মায়াকে অতিক্রম করতে হবে। নারদীয় ভক্তিসূত্রের আর একটি শ্লোক প্রণিধানযোগ্য, যথা “তস্মিংস্তজ্জনে ভেদাভাবাৎ” অথার্ৎ ভক্তি লাভ করতে হলে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ভেদ জ্ঞান দূর করতে হবে।

ভক্তির প্রকারভেদ

এখন ভক্তির প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ভক্তিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা গৌণী বা অপরা এবং মুখ্যা বা পরা। গৌণী ভক্তিকে সগুণা আবার পরা ভক্তিকে নিগুর্ণা ভক্তিও বলে। বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণ ত্যাগ না করে এবং কোন কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে যে ভক্তি তাকে গৌণী ভক্তি বলে। সকল বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে অর্থাৎ নিষ্কামভাবে শুধুমাত্র ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যে তীব্র ব্যাকুলতা, তাই পরাভক্তি। পরাভক্তি জন্মিলে সাধক সর্বভূতে তাঁর প্রেমাস্পদকে দেখতে পান। ভক্তি-মার্গের সর্বোচ্চ স্তরে পরাভক্তি লাভ হয়। মুক্তির জন্য পরাভক্তি একান্ত আবশ্যক।

নববিধ ভক্তি

ভাগবতে নববিধ ভক্তির উল্লেখ আছে, যথা ভগবানের মাহাত্ম্য শ্রবণ করা, তাঁর গুণ-কীর্তন করা, তাঁর লীলা স্মরণ করা, তাঁর পূজা করা, তাঁর চরণ-সেবা করা, মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর অচর্না করা, তাঁর বন্দনা করা, দাস হয়ে তাঁর সেবা করা হয়, বন্ধু বা সখার মত তাঁকে ভালবাসা এবং তাঁর চরণে সব কর্ম সমর্পণ করে আত্মনিবেদন করা। এছাড়াও ভাগবতে তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক এই তিন প্রকার ভক্তির উল্লেখ আছে। হিংসা ও দম্ভ সহকারে ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি তাকে তামসিক ভক্তি বলে। যশ-খ্যাতি ও ঐশ্বর্য লাভের জন্য ঈশ্বরের প্রতি যে ভক্তি জাগ্রত হয় তাকে রাজসিক ভক্তি বলে। ভক্ত সর্বকর্ম ভগবানে সমর্পণ করে মোক্ষলাভের জন্য যে ভক্তি প্রদর্শন করে তাকে সাত্ত্বিক ভক্তি বলে।

ভক্তির লক্ষণ

ভক্তিরসামৃতসিন্ধু নামক গ্রন্থ মতে উত্তম ভক্তির লক্ষণ দুইটি, যথা স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ। কৃষ্ণের অনুকুলে কর্ম করে যাওয়াকে ভক্তির স্বরূপ লক্ষণ এবং সকল কামনা-বাসনা ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাকে হল ভক্তির তটস্থ লক্ষণ বলে। উক্ত বৈষ্ণবগ্রন্থে অধম, মধ্যম ও উত্তম ভেদে ভক্তিকে সাধন-ভক্তি, ভাব-ভক্তি ও প্রেম-ভক্তি এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গণের প্রেরণা অর্থাৎ শ্রবণ, কীর্তন ও দর্শনাদির মাধ্যমে ভক্তের হৃদয়ে যে সামান্য ভক্তি জাগ্রত হয়, তাকে সাধন-ভক্তি বলে। সাধন-ভক্তি দুই প্রকার, যথা বৈধী ও রাগানুগা ভক্তি। অনুরাগ উৎপন্ন হয়নি, শুধু ভগবানের শাসন ভয়ে যে ভক্তি জন্মে, তাকে বৈধী ভক্তি বলে। ঈশ্বরের প্রতি কেবল স্বাভাবিক আকর্ষণবশত যে রাগ বা প্রীতি জন্মায়, তাকে রাগানুগা ভক্তি বলে। বৈধী ভক্তিতে শাস্ত্রের বিধি-নিষেধ থাকে কিন্তু রাগানুগা ভক্তিতে কোন শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ থাকে না। রাগানুগা ভক্তি দুই প্রকার। যথা সম্বদ্ধানুগা ও কামনানুগা। ঈশ্বরের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করে ঐ সম্বন্ধ অনুসারে তাঁর প্রতি যে প্রীতি জন্মে, তাকে সম্বদ্ধানুগা ভক্তি বলে। যেমন শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি ব্রজবাসীর সাথে কৃষ্ণের বন্ধুত্বের সম্বন্ধ ছিল। ঈশ্বরের প্রতি কামনা বা আকর্ষণবশত যে ভক্তি উৎপন্ন হয়, তাকে কামানুগা ভক্তি বলে। কামানুগা ভক্তি দুই প্রকার, যথা সম্ভোগেচ্ছাময়ী এবং তদ্ভাবেচ্ছাময়ী। সম্ভোগের ইচ্ছায় যে ভক্তি করা হয়, তাকে সম্ভোগেচ্ছাময়ী ভক্তি বলে। সম্পূর্ণ নিষ্কাম হয়ে শুধুমাত্র ঈশ্বরের ভাব বা ভালবাসা লাভের ইচ্ছার যে ভক্তি, তাকে তদ্ভাবেচ্ছাময়ী ভক্তি বলে।

পঞ্চপ্রেম বা পঞ্চভাব

এবার আসা যাক ভাব-ভক্তি প্রসঙ্গে। প্রেমের প্রাথমিক অবস্থকে ভাব বলে। ভাবই এক সময় গাঢ় হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। ভাব পাঁচ প্রকার, যথা শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর বা কান্তা। 

শান্ত ভাব

যাতে সুখ নেই, দুঃখ নেই, দ্বেষ নেই, যে প্রেম জন্মালে সর্বভূতে সমভাব বিরাজ করে এবং যে প্রেমের উন্মত্ততা বা গভীরতা নেই, তাকেই শান্ত ভাব বলে। সনকাদি ঋষিগণের মধ্যে শান্তভাব বিরাজ করত।

দাস্য ভাব

ভগবানকে প্রভূ এবং নিজেকে দাস মনে করে ভগবানের সেবাই হল দাস্য ভাব। হনুমান রামচন্দ্রকে দাস্য ভাবে সেবা করতেন।

বাৎসল্য ভাব

ভগবানকে পুত্র বা কন্যার ন্যায় ভালবাসাই হল বাৎসল্য ভাব। কৃষ্ণ ও যশোদার মধ্যে বাৎসল্য ভাব ছিল।

সখ্য ভাব

ভগবানকে বন্ধু বা সখার মত মনে করলে যে ভাবের উদয় হয় তাকেই সখ্য ভাব বলে। শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি গোপবালকগণের সাথে শ্রীকৃষ্ণের সখ্য ভাব ছিল। 

কান্তা বা মধুর ভাব

পতি-পত্নী বা প্রেমীক-প্রেমীকার মধ্যে যে ভালবাসা বা ভাব তাই কান্তা বা মধুর ভাব। ভগবানকে পতি ও নিজেকে পত্নী মনে করে ভজনা করলে কান্তা প্রেমের উদয় হয়। গোপীগণ, রুক্মিণী প্রভৃতি নায়িকার সাথে শ্রীকৃষ্ণের কান্তা ভাব বিরাজিত ছিল। কান্তা ভাব আবার দুই ধরনের। যথা স্বকীয়া-কান্তা আর পরকীয়া কান্তা। পতি ও পত্নীর মধ্যে যে ভালবাসা তাই স্বকীয়া-কান্তা। যেমন শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর মধ্যে স্বকীয়া-কান্তা ভাব ছিল। উপপতির সাথে কুলবধুর যে ভালবাসা তা পরকীয়া-কান্তা নামে খ্যাত। গোপিনীদের স্বামী-সন্তান থাকতেও তাঁরা কামনা-বাসনাশূণ্য হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ভালবেসে গেছেন। গোপীদের এই পরকীয়া-কান্তা প্রেমই শ্রেষ্ঠ। পত্নীরা পতিকে ভালবাসে আবার ভয়ও পায়। কিন্তু পরকীয়া প্রেমে প্রেমীকা সম্পূর্ণ লোকলজ্জার ভয় উপেক্ষা করে তাঁর প্রেমাষ্পদের নিকট ছুটে যায়। গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে ভয় করে না, কেবলই নিষ্কাম হয়ে ভালবাসে। শুধু একবার দর্শনের জন্য তাঁরা সংসারের সব কাজ ফেলে কৃষ্ণের নিকট ছুটে যান। যেহেতু পরকীয়া-কান্তায় বিষয়-বাসনা সম্পূর্ণই ত্যাগ করতে হয় তাই পরকীয়া কান্তাই-শ্রেষ্ঠ।

মাতৃভাব

শাক্তরা মাতৃভাবে দেবী দুগার্কে উপাসনা করে। শাক্তদের নিকট দেবী দুর্গাই জগজ্জননী। মা যেমন সন্তানকে লালন-পালন করে দেবী দুগার্ও তেমনি জগৎকে লালন-পালন করেন। সন্তান যেমন মা মা বলে তার মায়ের নিকট ছুটে যায় মায়ের আদর পাবার জন্য, শাক্ত ভক্তরাও তেমনি দেবীকে মা বলে ডাকে মাতৃস্নেহ পাওয়ার জন্য। মা যেদিন সন্তানকে কোলে তুলে নিবেন সেদিনই হবে তার মুক্তি। শৈবরা ভগবান শিবকে পিতৃভাবে উপাসনা করেন। পিতা শিবই শৈবদের মুক্তিদাতা। এভাবে ভক্তরা ভগবানের সাথে বিভিন্ন সম্বন্ধ পাতিয়ে তাঁকে প্রেমডোরে বাঁধে।

প্রেমভক্তি

এবার আসা যাক প্রেমভক্তি প্রসঙ্গে। ভাবের পরিণত অবস্থাই প্রেম। অন্যের প্রতি মমতা পরিত্যাগ করে ভগবানে যে মমতা তার নাম প্রেম। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে ভাব হতে চিত্ত সম্পূর্ণ নির্মল হয় এবং যে ভাব অতিশয় মমতাসম্পন্ন, সে ভাব গাঢ় হলে তাকে প্রেম বলে। সুতরাং ভাবই পরিপক্ক হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে, আত্মেন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য যে কার্য করা হয় তাকে কাম বলে আর ঈশ্বরেন্দ্রিয় প্রীতির জন্য যে কার্য করা হয় তাকে প্রেম বলে। উজ্জ্বল-নীলমণি নামক বৈষ্ণবগ্রন্থে আছে ধ্বংসের কারণ সত্ত্বেও যার ধ্বংস হয় না এমন যুবক-যুবতীদ্বয়ের পরস্পর ভাববন্ধনকে প্রেম বলে। ভক্তরা প্রেমের দ্বারাই ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে চান।

ভক্ত কে

এখন প্রশ্ন হল ভক্ত কে? নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে যিনি বিচলিত হন না, যিনি আপন ও পরে সমভাব দেখান, যিনি পরদ্রব্য হরণ করেন না, যিনি কোন জীবে হিংসা করেন না, যার অন্তর ক্রোধশূন্য ও অতি নির্মল তাকেই বিষ্ণুভক্ত বলে জানবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যিনি নির্জনে স্বর্ণ দেখেও তৃণ মনে করে উপেক্ষা করেন, যিনি অন্য চিন্তা পরিত্যাগ করে কেবল ভগবানের চিন্তা করেন, সেই পুরুষকে বিষ্ণুভক্ত বলে বিবেচনা করবে। গীতা অনুসারে তিনিই শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়ভক্ত, যিনি কাউকে হিংসা করেন না, সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও দয়াবান, যিনি সুখে-দুঃখে সমদর্শী ও অহংকারশূন্য, যিনি সদা সন্তুষ্ট, যোগী, সংযত স্বভাবযুক্ত, দৃঢ় বিশ্বাসী, যার মন-বুদ্ধি ঈশ্বরে অর্পিত, যিনি সব বিষয়ে অনাসক্ত, শৌচসম্পন্ন, কর্তব্য-কর্মে অনলস, পক্ষপাতশূন্য, যাকে কিছুতেই মন পীড়া দিতে পারে না, যিনি কর্মফল ত্যাগ করে সর্বকর্ম করেন, যিনি ইষ্টলাভে হৃষ্ট হন না, অপ্রাপ্য বস্তুলাভে আকাক্সক্ষা করেন না, যিনি কর্মের শুভাশুভ ফলাকাক্সক্ষা ত্যাগ করেছেন, যিনি শত্রু-মিত্রে, মান-অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখে-দুঃখে সমদর্শী হন, প্রশংসা ও নিন্দায় যিনি সমভাব প্রদর্শন করেন, যিনি বাকসংযমী, যিনি গৃহাদিতে মমত্ববুদ্ধি-বর্জিত এবং স্থির চিত্তের অধিকারী।

গীতায় উল্লেখিত চার প্রকার ভক্ত

গীতায় চার প্রকার ভক্তের কথা বলা হয়েছে, যথা আর্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী ও জ্ঞানী। যিনি রোগ বা বিপদ হতে মুক্তির আশায় ঈশ্বর ভজনা করেন তিনি আর্ত, যেমন দ্রৌপদী। যিনি আত্মজ্ঞান লাভের জন্য ঈশ্বরের ভজনা করেন তিনি জিজ্ঞাসু, যেমন মুকুন্দ, জনক প্রভৃতি। যিনি ইহলোক ও পরলোকে সুখভোগের জন্য ভজনা করেন তিনি অর্থার্থী, যেমন সুগ্রীব, বিভীষণ প্রভৃতি। যিনি তত্ত্বাদর্শী এবং কোন কিছু লাভের আশায় নয়, শুধু ভগবানকে জেনেছেন এজন্য তাঁকে ভজনা করেন তিনি জ্ঞানী ভক্ত, যেমন প্রহ্লাদ, শুকদেব, সনক প্রভৃতি। জ্ঞানী ভক্তের প্রেম নিষ্কাম অর্থাৎ তারা কোন ধনসম্পত্তি চান না এবং তারা শুধুই ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু-পুরাণে আছে

ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতা বা জগদীশ কাময়ে।

মম জন্মানি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ী।।

অর্থাৎ হে ঈশ্বর, স্বর্ণরত্নাদি ধন, ভৃত্যাদি জন, সুন্দরী স্ত্রী কিংবা পাণ্ডিত্য প্রভৃতি কিছুই চাই না। কিন্তু হে ঈশ্বর, জন্মে-জন্মে যেন তোমার প্রতি আমার কামনা-বাসনাশূন্য ভক্তির উদয় হয়। এরকম নিষ্কাম ভক্তিই ভক্তকে ভগবানের অতি নিকটে নিয়ে যায়।

ভক্তের নিকট ঈশ্বর কেমন

ভক্ত ঈশ্বরকে নিরাকার ভাবতে চান না। তাই ভক্তের নিকট ঈশ্বর সাকার। ভক্ত ঈশ্বরের নানা মূর্তির কল্পনা করে তাঁকে ভজনা করেন। ভক্ত মনে করেন তিনি মন্ত্র-তন্ত্র কছুই জানেন না, সাধনার পদ্ধতিও জানেন না, তিনি শুধু প্রেমের দ্বারা ভগবানকে কাছে পেতে চান। ভগবানও ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না এবং তাঁকে সাকার রূপেই দর্শন দেন।

কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়

অনেক ভক্তরা বলেন, জ্ঞানযোগ হল মিছরির মত অর্থাৎ মিষ্ট কিন্তু নিরস। আবার অনেক জ্ঞানীরা বলেন, ভক্তিযোগ হল দুধের মত, সরস ও সুপেয় বটে কিন্তু মিষ্টতা নেই। যদি দুধের সাথে মিছরি মিশানো হয় তবে তা একটি সরস মিষ্ট খাদ্যে পরিণত হয়। সুতরাং জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়ে সাধনা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ জ্ঞানবিহীন ভক্তি অমিষ্ট এবং ভক্তিবিহীন জ্ঞান নিরস। প্রকৃতপক্ষে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি পৃথকভবে থাকতে পারে না। যিনি পরাভক্তি অর্জন করেছেন তিনি কি জ্ঞানী নন? আবার জ্ঞানী ও ভক্তের কেউই কর্ম না করে থাকতে পারেন না, তাই তাঁরা কর্মীও বটে। এখন প্রশ্ন হল জ্ঞানী কি করে ভক্ত হন? আবার ভক্তই বা কি করে জ্ঞানী হন? জ্ঞানীর ঈশ্বর নিরাকার এবং তিনি যখন সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করেন, তখন হিংসা ভুলে যান, কারণ কাকে হিংসা করবেন? সব কিছুইতো ঈশ্বর। আবার ভক্তের ঈশ্বর সাকার হলেও তিনি যখন পরাভক্তি অর্জন করেন তখন তিনি ঈশ্বরকে বিশেষ কোন স্থানে না দেখে সর্বভূতেই তাঁর রূপ দর্শন করেন। তাই সাধনার চূড়ান্ত স্তরে জ্ঞান ও ভক্তির পার্থক্য কোথায়? জ্ঞানী যখন নিরাকার ঈশ্বরকে সর্বভূতে উপলব্ধি করেন তখন তিনি ভক্ত হন আবার ভক্ত যখন তাঁর সাকার ঈশ্বরকে সর্বভূতে দর্শন করে তখন তিনি জ্ঞানী হন। কর্ম করলে জ্ঞান হয় আর জ্ঞান হলে পরাভক্তি জন্মে। সুতরাং কর্মের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান যখন ভক্তির সাথে যুক্ত হবে তখন মুক্তি আসবে। সাধক তাঁর পছন্দমত এবং সাধ্যানুসারে কর্ম বা জ্ঞান বা ভক্তিযোগ অবলম্বন করে সাধন-জীবন শুরু করলেও সাধনার শেষ স্তরে এসে তিনি দেখেন কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি একাকার হয়ে গেছে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণও কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ যার মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তি উভয়ই আছে, তিনিই শ্রেষ্ঠ। 

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে সঙ্কলিত)


এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন