হিন্দুদের বর্ণ প্রথা বা চতুর্বর্ণ
হিন্দুদের বর্ণ প্রথা বা চতুর্বর্ণ বিশেষ অর্থ বহন করে। হিন্দু-সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার প্রকার বর্ণ প্রচলিত আছে। মূলত গুণ ও কর্ম অনুসারে চার প্রকার বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নং শ্লোকে আছে— “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ। তস্য কর্তরমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।” অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছি কিন্তু আমি এসবের সৃষ্টিকর্তা হলেও আমাকে অকর্তা ও বিকার-রহিত বলে জেনো। গীতার উক্ত শ্লোকে একটি কথা স্পষ্ট যে, জন্ম অনুসারে নয় শুধুমাত্র গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে চতুর্বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। তাই ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না, ব্রাহ্মণের গুণ অর্জন করার পর ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। শূদ্রকুলে জন্ম নিয়ে যদি কেউ ব্রাহ্মণের গুণ অর্জন করতে পারেন, তবে তিনি ব্রাহ্মণ বলেই খ্যাত হবেন। আবার ব্রাহ্মণের সন্তান হয়ে যদি কেউ শূদ্রের মত আচরণ করেন তবে, তিনি শূদ্র বলেই খ্যাত হবেন। মহাভারতের বন পর্বে সর্পরূপী নহুষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রাহ্মণ কে? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— সত্য, দান, ক্ষমা, সচ্চরিত্র, অহিংসা, তপস্যা ও দয়া যার আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। তারপর সর্প আবার বললেন— শূদ্রদের মধ্যেও তো ঐসব গুণ থাকতে পারে। তখন যুধিষ্ঠির বললেন— যে শূদ্রে ঐসব গুণ থাকে তিনি শূদ্র নন, ব্রাহ্মণ আবার যে ব্রাহ্মণে ঐসব গুণ থাকে না তিনি ব্রাহ্মণ নন, তাকে শূদ্র বলাই শ্রেয়।
মহাভারতে আছে, “চণ্ডলেহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণ। হরিভক্তিহীনশ্চদ্বিজ্যেহপি শ্বপচাধমঃ।।” অর্থাৎ নীচকুলে জন্মালেও যদি হরিভক্তিপরায়ণ হয় তবে চণ্ডালও ঈশ্বর-ধ্যানপরায়ণ মুনি-ঋষিদের থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। পরন্তু ব্রাহ্মণ হরিভক্তিশূন্য হলে চণ্ডালেরও অধম রূপে পরিগণিত হয়। নীচ-কুলে জন্মগ্রহণ করেও অনেক ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞানী হয়েছেন। ব্যাসদেব ছিলেন জারজ সন্তান। এক মৎস্যজীবীর গৃহে পালিতা মৎস্যগন্ধা নামক এক কুমারী পাটনীর গর্ভে ব্যাসদেবের জন্ম হয়েছিল। অথচ ব্যাসদেবের মত ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণ কজন আছে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করলেও পালিত হন নন্দগোপ নামক এক বৈশ্যের ঘরে। মহাভারতে বিদুর দাসীপুত্র হয়েও ব্রহ্মজ্ঞানী হয়েছিলেন। ঋক্-বেদের ১০ম মণ্ডলের ৩০ থেকে ৩৪ পর্যন্ত সূক্তের রচয়িতা কবশ ঋষি ছিলেন দাসীপুত্র। ঋক্-বেদের ঋষি কক্ষীবান্ও ছিলেন দাসীপুত্র। রামায়ণের অন্ধমুনি বৈশ্য কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তপস্যার দ্বারা ব্রাহ্মণ হয়েছেন। বিশ্বামিত্র ঋষি ক্ষত্রিয় হলেও তপস্যার দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন। তাই জন্ম নয় কর্মই নির্ধারণ করবে তিনি কোন বর্ণের অধিকারী।
বর্তমান হিন্দুসমাজে প্রচলিত জাতিভেদ বৈদিক যুগে ছিল না। ঋক্-বেদের ৯ম মণ্ডলের ১১২ নং সূক্তের ৩য় ঋকে আছে— “কারুরহং ততো ভিষস্তপলপ্রক্ষিণী নানা।” অর্থাৎ আমি স্তোত্রকার (ব্রাহ্মণ), পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব ভঞ্জন-কারিণী। শিশু ঋষি নিজে ব্রাহ্মণ, ছেলে চিকিৎসক ও মেয়ে যব ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত ছিল। অর্থাৎ একই পরিবারে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শুদ্র বাস করত। ব্রাহ্মণের পুত্র-কন্যা ব্রাহ্মণ হবে সে ধারণা বৈদিক যুগে ছিল না। কিন্তু বর্তমান যুগে আমরা দেখি যে, ব্রাহ্মণের ছেলে অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তিনি ব্রাহ্মণ বলেই গণ্য হন। অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রেও তা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এটা বেদ দ্বারা সমর্থিত নয়। প্রকৃতপক্ষে জাত সৃষ্টি হয় গুণ ও কর্ম অনুসারে, বংশ অনুসারে নয়। নিচে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল।
ব্রাহ্মণ
‘ব্রহ্মণ’ শব্দ থেকে ব্রাহ্মণ শব্দের উৎপত্তি। ‘ব্রহ্মণ’ শব্দের অর্থ মন্ত্র। সুতরাং যিনি মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক যজ্ঞ বা পূজা করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের অন্য অর্থও আছে— “ব্রহ্ম জানাতি যঃ স ব্রাহ্মণ” অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন তিনিই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণকে বিপ্র, ঋত্বিক, পুরোহিত, দ্বিজ প্রভৃতিও বলা হয়। ‘ঋত্বিক’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে হয় ঋতু-যজ + ক্বিপ। অর্থাৎ যিনি ঋতু অনুসারে যজ্ঞ করেন, তিনিই ঋত্বিক। “পুরোহিত” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে হয় পুরস + হিত। ‘পুরস’ অর্থ অগ্রে এবং ‘হিত’ অর্থ সম্মানিত বা প্রিয়। সুতরাং যিনি সবার আগে সম্মানিত হন বা যিনি সকলের প্রিয়, তিনিই পুরোহিত। প্রাচীনকালে পুরোহিতই ছিলেন যাগ-যজ্ঞের প্রধান এবং তিনিই সব থেকে বেশি সম্মানিত হতেন। ঋগ্বেদীয় পুরোহিতের নাম হোতা, সামবেদীয় পুরোহিতের নাম উদগাতা, যজুর্বেদীয় পুরোহিতের নাম অধ্বযুর্ এবং ত্রিবেদীয় পুরোহিতের নাম ব্রহ্মা। বলা হয়ে থাকে যে, ব্রাহ্মণের দুইবার জন্ম। একবার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এবং আরেকবার উপনয়ন সংস্কারের পর। দুবার জন্ম হয়েছে বলে ব্রাহ্মণদের দ্বিজ বলা হয়।
এখন ব্রাহ্মণদের গুণ-কর্ম সম্পর্কে আলোচনা
করা যাক। ব্রাহ্মণদের অবশ্যই সত্ত্বগুণ সম্পন্ন হতে হবে। গীতায় ব্রাহ্মণের নয়টি গুণের
কথা বলা হয়েছে।
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।
(১৮/৪২)
অর্থাৎ শম (মনোসংযম), দম (ইন্দ্রিয়-সংযম), তপস্যা, শৌচ (পবিত্রতা), সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান (আত্মতত্ত্ব অনুভব) ও আস্তিক্য (ঈশ্বরে বিশ্বাস) । ব্রহ্মণগণ এই নয়টি গুণের অধিকারী বলে উপনয়ন সংস্কারের পর নয়গুণ বিশিষ্ট যজ্ঞ-উপবীত বা পৈতা ধারণ করেন। মনুসংহিতা অনুসারে যজন (যজ্ঞ করা), যাজন (পুরোহিত হয়ে যজমানের যজ্ঞ করানো), অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, দান ও প্রতিপ্রহ (না চেয়ে দান গ্রহণ) এই কয়টি ব্রাহ্মণের কর্ম।
বাঙ্গালী ব্রাহ্মণগণ ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টপাধ্যায় প্রভৃতি উপাধী ব্যবহার করে থাকেন। এসব উপাধীসমূহ মধ্যযুগে প্রদান করা হয়েছিল। এসব উপাধীসমূহ বিশেষ অর্থ বহন করে। ভট্ট বা ভাট বলতে ন্যায়, মীমাংসা প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি বোঝায়। সুতরাং ভট্টাচার্য অর্থ ভট্ট যে আচার্য অর্থাৎ যে আচার্য বা অধ্যাপক পণ্ডিত (শাস্ত্রজ্ঞ), তিনিই ভট্টাচার্য। যিনি চক্রে (দেশসমূহে) বর্তেন (প্রভূ রূপে থাকেন) তিনিই চক্রবর্তী। অর্থাৎ বহুবিস্তৃত সম্রাজ্যের অধিপতি বা সম্রাটকেই চক্রবর্তী বলে। ভারত, অজুর্ন, মান্ধাতা, ভগীরথ, যুধিষ্ঠির, সগর ও নহুষ এই সাতজন চক্রবর্তী ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের উপাধী চক্রবর্তী কেন? কারণ ব্রাহ্মণকেও চক্রবর্তী বা সম্রাট হতে হবে, তবে কোন ভোগ-সম্রাজ্যের সম্রাট নয়, জ্ঞান-সম্রাজ্যের সম্রাট। যে উপাধ্যায় (অধ্যাপক) মুখ্য বা প্রধান, তিনিই মুখোপাধ্যায়। বন্দনীয় বা পূজনীয় অধ্যাপককে বন্দ্যোপাধ্যায় বলে। কিন্ত যে গুণ অর্জন করলে ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি উপাধী গ্রহণ করা যায়, সে গুণ অর্জন না করেই অনেকে ঐসব উপাধী গ্রহণ করে থাকে যা বাঞ্ছনীয় নয়।
ক্ষত্রিয়
যারা যুদ্ধ-বিগ্রহ করে ক্ষেত্র
বা রাজ্য রক্ষা করেন, তারাই ক্ষত্রিয়। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৪৩নং শ্লোকে বলা হয়েছে—
শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্।
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্।।
অর্থাৎ শৌর্য (পরাক্রম), তেজ, ধৈর্য, কর্মদক্ষতা, যুদ্ধে পলায়ণ না করা, মক্তহস্তে দান, শাসন ক্ষমতা, যুদ্ধে পলায়ণ না করা, মুক্তহস্তে দান, শাসন ক্ষমতা এগুলো ক্ষত্রিয়ের লক্ষণ। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে— প্রজারক্ষণ, দান, অধ্যয়ন, বিষয়ভোগে অনাসক্তি প্রভৃতি হল ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ক্ষত্রিয়রা রজঃগুণ সম্পন্ন হয়ে থাকেন।
বৈশ্য
যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজের
সাথে যুক্ত তারাই বৈশ্য। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৪৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে—
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্।
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।।
অর্থাৎ কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যদের এবং সেবাত্মাক কর্ম শূদ্রদের স্বভাবজাত। বৈশ্যরা রাজঃ ও তমঃ গুণ সম্পন্ন।
শূদ্র
বদরায়ণের বেদান্তসূত্রে আছে, শূদ্র = শূক (শোক) + দ্রু (ধাবন করা) । তাই শোক যার দিকে ধেয়ে আসে, তিনিই শূদ্র। চারবর্ণের মধ্যে শূদ্রকে নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন জাতির সেবাই শূদ্রের কাজ। শূদ্রেরা তমোগুণের অধিকারী।
বর্ণভেদ কেন?
এই বর্ণভেদ কি মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে? প্রকৃতপক্ষে বর্ণভেদ কারো সৃষ্টি নয়। এই বর্ণভেদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বর্ণভেদ ছাড়া সমাজে জীবন ধারণ অসম্ভব। সবাই যদি শুধু যজ্ঞ-পূজা প্রভৃতি কর্ম করে তবে আহার-সন্ধান কি করে হবে? তাই জীবিকা নিবার্হ করার জন্য চারটি বর্ণই প্রয়োজন। ব্রাহ্মণদের উৎকৃষ্ট এবং শূদ্রদের নিকৃষ্ট বলা হয়ে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কেউই ছোট নয়। চার বর্ণের প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপর নির্ভরশীল। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের যজ্ঞ বা পূজা করিয়ে প্রাপ্ত দক্ষিণা দ্বারা ব্রাহ্মণের জীবিকা নির্বাহ হয়। ক্ষত্রিয়ের যজ্ঞ করার জন্য ব্রাহ্মণ প্রয়োজন, শস্য উৎপাদনের জন্য বৈশ্য প্রয়োজন এবং ক্ষৌর-কর্মাদি নানা সেবামূলক কর্মের জন্য শূদ্রের প্রয়োজন। তদ্রূপ বৈশ্য ও শূদ্র জাতিও অপর তিন জাতির প্রতি নির্ভরশীল। অতএব, এই চার জাতিরই প্রয়োজন আছে।
একজন মানুষের মধ্যেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের গুণ থাকতে পারে। ধরা যাক কোন এক বেদজ্ঞ ব্যক্তি কোন এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন এবং যজ্ঞ উপলক্ষে তাঁর উৎপাদিত শস্য হতে আহার প্রস্তুত করে অতিথি ভোজন করাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এক ব্রাহ্মণ তার বাড়িতে অতিথি হয়ে আসার সময় একদল কুকুর তাকে আক্রমণ করল। তখন তিনি কুকুরদের তাড়িয়ে ব্রাহ্মণকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে ভোজন করালেন। তার এসব কর্মের মধ্যে চারটি গুণই প্রকাশ পেল। তিনি যখন শস্য উৎপাদন করে আহার প্রস্তুত করলেন তখন তিনি বৈশ্য, যখন কুকুর থেকে ব্রাহ্মণকে রক্ষা করলেন তখন তিনি ক্ষত্রিয়, যখন যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন তখন তিনি ব্রাহ্মণ এবং যখন অতিথিসেবা করলেন তখন তিনি শূদ্র। সুতরাং ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র কোন পৃথক জাতি নয়।
চতুর্বর্ণ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য নয়। যদি চতুর্বর্ণের
কারণে জাতিতে-জাতিতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সে জন্য হিন্দুধর্ম
দায়ী নয়। কিছু হীনবুদ্ধি সম্পন্ন, ইর্ষাপরায়ণ ও স্বার্থন্বেষী মানুষদের জন্যই জাতিতে-জাতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়। এবং
এসব মানুষ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করলেও এরা পশুতুল্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ^পাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।। (গীতা
৫/১৮)
অর্থাৎ আত্মজ্ঞান সম্পন্ন পণ্ডিতগণ বিদ্যা-বিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে, চণ্ডালে, গো, হস্তী ও কুকুরে সমদর্শী হন। প্রকৃতপক্ষে সকলে প্রতি সমান ভাব প্রদর্শনই একজন আদর্শ মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বর্ণ-সংকর
এবার আসা যাক বর্ণ-সংকর প্রসঙ্গে। একই বর্ণে বিবাহ অথার্ৎ ব্রাহ্মণের সাথে ব্রাহ্মণের, ক্ষত্রিয়ের সাথে ক্ষত্রিয়ের, বৈশ্যের সাথে বৈশ্যের এবং শূদ্রের সাথে শূদ্রের বিবাহ না হলে বর্ণ-সংকর সৃষ্টি হয়। যদি মাতার বর্ণ পিতার বর্ণ থেকে উচ্চতর হয় তবে তাদের সন্তান হবে পতিলোম এবং মাতার বর্ণ যদি পিতার বর্ণ থেকে নিচুতর হয় তবে তাদের সন্তান হবে অনুলোম। মনুসংহিতায় আছে, ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্যা মাতা থেকে অম্বষ্ঠ, ব্রাহ্মণ পিতা ও শূদ্রা মাতা থেকে নিষাদ বা পারশব, ক্ষত্রিয় পিতা ও শূদ্রা মাতা থেকে উগ্ন, ক্ষত্রিয় পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতা থেকে সূত, বৈশ্য পিতা ও ক্ষত্রিয়া মাতা থেকে মাগধ, বৈশ্য পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতা থেকে বৈদেহ, শূদ্র পিতা ও বৈশ্যা মাতা থেকে আয়োগ, শূদ্র পিতা ও ক্ষত্রিয়া মাতা থেকে ক্ষত্ত, শূদ্র পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতা থেকে চণ্ডাল নামক বর্ণসংকরের সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের উপনয়নের অধিকার রয়েছে। যদি কারো উপনয়ন সংস্কার না হয় তখন তাকে ব্রাত্য বলা হয়। ব্রাত্য-ব্রাহ্মণ পিতা-মাতার সন্তানরা ভূর্জকণ্টক নামে পরিচিত হয়। ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় পিতা-মাতা হতে ঝল, মল, নিচ্ছিব, নট, করণ, খস, দ্রাবিড় প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি। ব্রাত্য-বৈশ্য পিতা-মাতা হতে সুধম্বা, আচার্য, কারূষ, বিজন্মা, মৈত্র, সাত্বত প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি। ধর্মপুরাণে ৪১টি সংকর জাতির উল্লেখ আছে যা উত্তম, মধ্যম ও অধম এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
উত্তম সংকর
করণ (কায়স্থ), অম্বষ্ঠ, উগ্র-ক্ষত্রিয়, মাগধ, তন্তুবায় (তাঁতী) গন্ধবণিক, নাপিত, গোপ (ঘোষ), কর্মকার, তৌলিক (সুপারী ব্যবসায়ী) কুম্ভকার (কুমার) কাংসকার, শঙ্খিক (শাঁখারু), দাস (কৃষিজীবী) বারুজীবী (বারুই), মোদক (ময়রা), মালাকার (মালী), সূত, রাজপুত্র ও তাম্বলী।
মধ্যম সংকর
তক্ষক (সূত্রধর বা মিস্ত্রী), রজক (ধোপা), স্বর্ণকার, সুবর্ণ-বণিক, আভীর, তৈলকার, ধীবর (মৎস্যজীবী), শৌণ্ডিক (শুঁড়ি), নট, শাবাক, শেখর ও জালিক (জেলে)।
অধম সংকর
মাল-গ্রাহী, কুড়ব, চণ্ডাল,
বরুড়, তক্ষ, চর্মকার (মুচী), কট্টজীবী, দোলা-বাহী ও মল।
(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” পুস্তক থেকে
সঙ্কলিত)
আরও পড়ুন
দারুন ভাল
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন