মত-পথ
অনেক অনুসন্ধিৎসু হিন্দুর মনেই এই প্রশ্নটি জাগ্রত হয়
যে, ঈশ্বর যদি একই হবেন তবে এত মত-পথ কেন? মূলত এক ঈশ্বরই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে
বিভিন্ন রূপে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হন। পূর্বজন্মের কর্মফল অনুযায়ী মানুষের মধ্যে
নানাবিধ বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। সব মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান সমান নয়। তাই ঈশ্বর
সকলের নিকট সমানভাবে প্রকাশিত হন না। একই ঈশ্বর জ্ঞানীর নিকট নিরাকার ভাবে এবং
ভক্তের নিকট সাকার ভগবান রূপে ব্যক্ত হন। তাই যেহেতু সকল মানুষ ঈশ্বরকে সমানভাবে
উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় না সেহেতু একই সাধন-পদ্ধতি সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না।
যদি ঈশ্বরকে পাওয়ার একটিই পথ থাকত তবে সবার পক্ষে ঈশ্বর-সাধনা সম্ভব হত না। তাই
মানুষের বুদ্ধি-বিবেকের পার্থক্য হেতু সাধন-পদ্ধতির কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। যার
নিকট যে মত সহজসাধ্য হয়, তিনি সে মতই গ্রহণ করেন। মত বহু এর অর্থ এই নয় যে, ঈশ্বর
বহু। মূলত একই ঈশ্বরকে লাভ করার বিভিন্ন মত-পথ আছে। সব মতেই ঈশ্বর লাভ করা যায়।
তাই কোন মতই ছোট বা হেয় নয়। শ্রীকৃষ্ণও একথা বলেছেন।
যে যথা মাং
প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম
বর্তানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। (গীতা-৪/১১)
অর্থাৎ হে পার্থ, যে যেভাবে আমাকে উপাসনা করে, আমি তাকে
সে ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে। তাই সকলকেই
সদ্গুরুর শরণাগত হয়ে তার সাধ্য অনুযায়ী সাধন-পন্থা বেছে নেয়া আবশ্যক। সেই
প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি যে পাঁচটি মুখ্য মত প্রচলিত রয়েছে তা হল- সৌর, গাণপত্য,
শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব। নিচে সৌর ও গাণপত্য মতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল।
সৌর
সৌরগণ হলেন সূর্যের উপাসক। সৌরগণ কণ্ঠে স্ফটিকের মালা
ধারণ করেন এবং ললাটে এক প্রকার রক্ত চন্দন দ্বারা তিলক করে থাকেন। তাঁরা রবিবার
এবং সংক্রান্তির দিনে লবণ-বর্জিত অন্ন গ্রহণ করেন। কোনদিন সূর্য দর্শন না করে
জলগ্রহণ করেন না। সূর্য দেবতার প্রচলিত ধ্যান-মন্ত্র নিম্নরূপ-
ওঁ রক্তাম্বুজাসনমশেষগুণৈক সিন্ধুং
ভানুং সমস্তজগতামধিপং ভজামি
পদ্মাদ্বয়াভয়বরান্ দধতং করাজৈ
মাণিক্যমৌলিমরুণাঙ্গ রুচিং ত্রিনেত্রম্।
-যিনি রক্তকমলে সমাসীন, সকল গুণের আকর, বিশ্বজগতের
অধিপতি, করপদ্মে যার দুটি পদ্ম, বর ও অভয় মুদ্রা, যিনি রত্নশোভিত মুকুটধারী, অঙ্গকান্তি
যার লোহিত, সে ত্রিনেত্রবিশিষ্ট সূর্যকে অর্চনা করি। সূর্য প্রণাম-মন্ত্রটি নিম্নরূপ-
ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম ।
ধান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম।।
-জবা ফুলের মত রক্তবর্ণ, কশ্যপের পুত্র, মহাদ্যুতি
সম্পন্ন অন্ধকারের শত্রু, সকল পাপনাশক দিবাকরকে আমি প্রণাম করি। এখন গাণপত্য মত
সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
গাণপত্য
গণপতি বা গণেশের উপসনা যারা করেন, তাঁরা গাণপত্য নামে
খ্যাত। সর্বপূজার পূর্বেই গণেশের পূজা বিধেয়। তবে গাণপত্যরা গণেশকে পৃথক উপাস্য
দেবতা হিসবে পূজা করে থাকেন। ভারতের মহারাষ্ট্রে সর্বপ্রথম গণেশ-পূজার প্রধান্য
বিসত্মার করে। বর্তমানে দক্ষিণ-ভারতে এই মতের প্রচলন রয়েছে। গাণপত্যরা কপালে লাল
ফোঁটা এবং কাঁধে গণেশের মু- ও দ- অঙ্কন করেন। গণেশের ধ্যান মন্ত্রটি নিম্নরূপ।
ওঁ
খর্বং স্থুলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরম্।
প্রস্যন্দনমদগন্ধলব্ধ-মধুপ-ব্যালোল
গণ্ডস্থলম্।।
দন্তাঘাত বিদারিতারি রুধিরৈঃ সিন্দুরশোভাকরং।
বন্দে শৈলসূতা সূতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং
কামদম্।।
-যিনি খর্ব ও স্থুলকায়, গজেন্দ্রবদন, লম্বোদর, সুন্দর
বদন হতে ক্ষরিত মদের গন্ধে লুব্দ অলিকুল যার গণ্ডস্থলে ব্যাকুল করেছে। যিনি দন্তের
আঘাতে শত্রুদের বিদীর্ণ করে তার রক্তে সিদুরশোভা ধারণ করেছেন, সেই সর্বসিদ্ধিদাতা
এবং অভীষ্টপ্রদানকারী হিমালয়-কন্যা পার্বতীর পুত্র গণপতিকে প্রণাম করি। গণেশের
প্রণাম মন্ত্রটি নিমণ রূপ।
ওঁ একদন্তং
মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননম্।
বিঘ্ন বিনাশকং দেবং হেরম্বং প্রণমম্যহং।।
-একদন্ত, মহাকায়, লম্বা উদরবিশিষ্ট, বিঘ্ননাশকারী,
দীনপালক গজাননকে প্রণাম করি।
আপনার লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন