7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১

মহাপুরাণ

  মহাপুরাণ কি ও কত প্রকার

    পুরাণ শব্দের অর্থ প্রাচীন। যে প্রাচীন গ্রন্থাবলি গল্প-উপাখ্যানের মাধ্যমে সহজভাবে ধর্মকে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাই পুরাণ। আর মহা বা বৃহৎ অর্থাৎ প্রধান যে পুরাণ, তাই মহাপুরাণ। তবে পুরাণ শব্দটি সৃষ্টির এক ইতিহাস আছে। “ইতি হ আস পুরাণম্” (এই রকমই ছিল সেকালের ব্যাপার) এই বাক্যটি কালেকালে একটি পদে পরিণত হয়ে “ইতিহাসপুরাণম্” হল। পরবর্তীতে “ইতিহাসপুরাণম্” শব্দটি ভেঙ্গে ইতিহাস ও পুরাণম্ এই দুইটি শব্দে পরিণত হল এবং হিন্দুদের বিভিন্ন গ্রন্থ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। অতীতে ঘটেছে এমন কাহিনী নিয়ে রচিত হয় ইতিহাস। ইতিহাসের কাহিনী প্রধানত মানুষকে নিয়ে কিন্তু পুরাণের কাহিনী মূলত দেবতা ও অসুরদের নিয়ে। বেদ ও উপনিষদ এর ভাষা অতি কঠিন এবং এর দর্শনও অতি উচ্চ যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। পুরাণে ঈশ্বর, দেবতা, অসুর, মুনি-ঋষি, মনুষ্য প্রভৃতির কথা গল্প বা কাহিনী আকারে বর্ণিত হয়েছে। পুরাণের অনেক কাহিনী যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত মনে নাও হতে পারে কিন্তু এর পিছনে রয়েছে এক গভীর ও মহৎ দর্শন। পুরাণে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকে দেবতা-জ্ঞান করা হয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বায়ু ও আগুন জড় পদার্থ ছাড়া অন্য কিছু নয় কিন্তু পুরাণের দৃষ্টিতে বায়ু পবনদেব আর আগুন অগ্নিদেব। পুরাণকে যুক্তি দিয়ে বিচার না করে ভাব দিয়ে বিচার করতে হয়, তা না হলে ধর্মভাব জাগ্রত হয় না। যেমন- পুরাণে আছে, রাজা সগরের ছোট স্ত্রী বৈদর্ভীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্রের জন্ম হয়েছিল। কপিল মুনির অভিশাপে সগরের ষাট হাজার পুত্র ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের বংশধর ভগীরথ পিতৃবংশের ঐ ষাটহাজার পুরুষকে উদ্ধারের জন্য কঠোর তপস্যার দ্বারা গঙ্গা দেবীকে স্বর্গ থেকে মর্তে্য এনেছিলেন। এখানে প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে এক নারীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্র হতে পারে? আগেই বলা হয়েছে, পুরাণে যুক্তিবিচার মুখ্য না, বিভিন্ন উপাখ্যানের মাধ্যামে যে নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে সেটাই মুখ্য। ভগীরথ সমস্ত সুখ-ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়ে কঠোর তপস্যা করে গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্তে্য অবতরণ করিয়েছেন। এখানে তাঁর যে ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়, এটাই এই উপখ্যানের মূল শিক্ষা। তাই পুরাণে গল্পের পেছনের দর্শনটা বোঝা এবং গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা আবশ্যক, নচেৎ পুরাণ পাঠ বৃথা। পুরাণে লৌকিক রীতিনীতির থেকে অলৌকিকতা বেশি থাকার একটা কারণ আছে। আসলে আলৌকিকতা না থাকলে মানুষের ধর্মে বিশ্বাস সহজে আসে না। পুরাণে কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গ-নরক ভোগের উল্লেখ আছে। মানুষ নরকের শস্তির ভয়ে কুকর্ম করবে না আবার স্বর্গের সুখলাভের আশায় পূণ্যকর্ম করবে, এটাই পুরাণের শিক্ষা। কারণ পুরাণের মুল উদ্দেশ্য মানুষকে সহজভাবে বুঝিয়ে ধর্মপথে আনায়ন করা।

পুরাণ

পুরাণের কাহিনী    

    ভাগবত্ ছাড়াও অন্যান্য পুরাণে সমুদ্র-মন্থনের উপাখ্যান আছে। আসলে সমুদ্র কিভাবে মন্থন করা যায়? এটা বিচার না করে এর পিছনে লুকায়িত দর্শনকে উপলব্ধি করাই যথাযথ জ্ঞানীর কাজ। সমুদ্র মন্থনের কাহিনীটি এরকম পুরাকালে দুর্বাসা মুনির অভিশাপে স্বর্গ শ্রীহীন অর্থাৎ লক্ষ্মীশূন্য হয়েছিল। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে লক্ষ্মীদেবীকে স্বর্গে ফিরিয়ে আনায়ন করার জন্য দেবতারা ক্ষীর-সমুদ্র মন্থনের উদ্যোগ নেন এবং মন্থনের ফলে উঠে আসা অমৃতের ভাগ অসুরদেরকেও দেয়া হবে এই প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে দেবতারা অসুরদেরকেও সঙ্গে রাখেন। মন্দার-পর্বতকে মন্থন-দণ্ড করে এবং বাসুকী-নাগকে মন্থন-দণ্ড ঘুর্ণন করার দড়ি করে একদিক দেবতারা এবং অপরদিকে অসুরেরা ধরে মন্থন-দণ্ড ঘুর্ণন করতে লাগলেন। মন্থনের ফলে একে একে উঠে আসতে লাগল লক্ষ্মীদেবী, মণি-মাণিক্য, চন্দ্র, ঐরাবত আরও কত কী। সর্বশেষে ধন্বন্তরী উঠে এলেন অমৃত-ভাণ্ডার নিয়ে। কিন্তু হাজার বছর মন্থনের ফলে বাসুকী-নাগের বিষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। তখন বিশ্বের মঙ্গলের জন্য মহাদেব সে বিষ পান করেছিলেন আর রক্ষা পেয়েছিল প্রাণীকুল। তারপর বিষ্ণু মোহিনীমূর্তি ধারণ করে সে অমৃত দেবতাদের মাঝে পরিবেশন করেছিলেন কিন্তু অসুরেরা হয়েছিল বঞ্চিত।

    দুধ হতে মাখন তৈরীর জন্য দুধের মধ্যে একটি চরক আকৃতির মাথা বিশিষ্ট একটি দণ্ড ঘুড়ালে দুধের মধ্যের সূক্ষ্ম উপাদান উঠে আসে এবং তা একীভূত হয়ে মাখনে পরিনত হয় এবং এই প্রকৃয়াকে বলা হয় মন্থন। সমুদ্র-মন্থনের স্থুল কাহিনীর পেছনের দর্শন অতি সূক্ষ্ম ও মহৎ। অমৃত লাভ করতে হলে আমাদের হৃদয়-সমুদ্র মন্থন করতে হবে। এই হৃদয়ের মধ্যেই রয়েছে দেবতা ও অসুর। সুচিন্তা, বিবেক বা মনের শুভ শক্তিই হল দেবতা আর যে ষড়-রিপু আমাদের বিপথে নিয়ে যায়, সে ষড়-রিপুই অসুর। মানবের হৃদয় যেন এক সমুদ্র। অজস্র চিন্তারাশিই হৃদয়-সমুদ্রের তরঙ্গ স্বরূপ। সৎ-মানবের মনে দেবতাদের আধিপত্য থাকে এবং অসৎ মানবের মনে অসুরদের আধিপত্য থাকে। অসুরেরা স্বর্গরাজ্য অধিকার করেছে এর অর্থ মনে অশুভ-শক্তির নিকট শুভ-শক্তি পরাজিত হয়েছে। মনে যখন অশুভ-শক্তির উত্থান ঘটে তখন ঐশ্বর্যরূপা লক্ষ্মী মন-সমুদ্রের অতল গহ্বরে প্রবেশ করেন। শুভ-শক্তি দেবতাগণ এবং অশুভ-শক্তি অসুরদের মিলিত প্রচেষ্টায় হৃদয়-সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে ঐ হৃদয়-লক্ষ্মীকে জাগ্রত করাই সাধকের লক্ষ্য। বুদ্ধি হল মন্থন-দণ্ড মন্দার-পর্বত এবং কূর্ম হল আত্মা স্বরূপ। কূর্মের উপর মন্থন-দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে এর অর্থ আত্মা বুদ্ধির আশ্রয়দাতা। মনের ইচ্ছাশক্তিই হল বাসুকী-নাগ অর্থাৎ মন্থনে ব্যবহৃত রজ্জু। তাই হৃদয়ের অতলে লুকিয়া থাকা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ঐশ্বর্যকে জাগ্রত করতে হলে ইচ্ছারূপ রজ্জু দ্বারা বুদ্ধি রূপ মন্থন-দণ্ডকে ঘুর্ণিত করে হৃদয়-সমুদ্রকে মন্থন করতে হয়। এভাবে মন্থন করলে ঐশ্বর্যরূপা লক্ষ্মী, ধন-রত্ন এবং অমৃত উঠে আসবে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানই ঐ ধন-রত্ন। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে অমর হওয়া যায়, তাই ব্রহ্মজ্ঞানই হল হৃদয়-সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা অমৃত। সুতরাং দেহের ইন্দ্রিয়গুলো যখন বিপথে ধাবিত হয় তখন আত্মাকে আশ্রয় করে বুদ্ধির দ্বারা মনের অতল সমুদ্রে লুকিয়ে থাকা জ্ঞান, বিবেক ও ঐশ্বর্য্য জাগ্রত করতে পারলে ঐ অশুভ পথে ছুটা চলা ইন্দ্রিয়গুলোকে বশে আনা সম্ভব হবে। এই তত্ত্বটিই পুরাণে রূপকের ছলে সমুদ্র-মন্থনের উপাখ্যানের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।

    পুরাণে বর্ণিত রাজা পৃথুর উপাখ্যানটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। হরিবংশে আছে, পুরাকালে বেণ নামক একজন অত্যাচারী ও ধর্মবিদ্বেষী রাজা ছিল। বেণ হল অত্রি বংশজাত অঙ্গের পুত্র। ঋষিগণ ধর্ম-রক্ষার্থে বেণকে বধ করেন। তাঁরা বেণের বাম উরু মর্দন করার ফলে নিষীদ নামক এক কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ সৃষ্টি হল। এই নিষীদ থেকেই নিষাদ বংশের সূচনা হয়। অতঃপর ঋষিগণ বেণের দক্ষিণ বাহু মন্থন করার ফলে পৃথু নামক এক প্রদীপ্ত অগ্নির মত পুরুষ সৃষ্টি হল। পৃথু সৎপুত্র হওয়ায় তার জন্মের কারণে বেণ পুন্নাম নরক হতে পরিত্রাণ পেয়ে স্বর্গে গেলেন। ব্রহ্মাদি দেবতাগণ পৃথুকে পৃথিবীর রাজা করে প্রজা-রক্ষার ভার দিলেন। বেণের রাজত্বকালে পৃথিবী প্রজাদেরকে খাদ্যশস্য ও ধন-সম্পদ হতে বঞ্চিত করেছিলেন। ফলে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পৃথু পৃথিবীর উপর প্রতিশোধ নেয়ার তাঁকে আক্রমন করলেন। তখন পৃথিবী গো-রূপ ধারণ করে পলায়ন করতে থাকলেন। পৃথুও ধনুর্বাণ নিয়ে পৃথিবীর পিছনে পিছনে ধাবিত হলেন। পৃথিবী প্রাণ রক্ষা করতে অক্ষম হয়ে পৃথুর নিকট ধরা দিলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। পৃথু তখন পৃথিবীকে বলেন প্রজাদের জীবন রক্ষা করার জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করতে এবং তাঁর কন্যা হতে। গো-রূপা পৃথিবী সে কথায় সম্মত হলেন এবং তাঁকে দোহন করার অনুরোধ করলেন। পৃথু পৃথিবীর কথামত তাঁকে ধনুক দিয়ে উৎসারিত করলেন। ফলে পৃথিবী সমতল হল এবং পর্বতসমূহ সৃষ্টি হল। তারপর তিনি স্বায়ম্ভুব মনুকে গো-বৎস কল্পনা করে নিজ হাতে গো-রূপা পৃথিবীকে দোহন করলেন। এই দোহনের ফলে প্রজারা অন্ন ও ধন-সম্পদ লাভ করলেন। তখন থেকে রাজা পৃথুর নাম অনুসারে জগতের নাম পৃথিবী হয়েছে। পৃথিবী গো রূপ ধারণ করেছিলেন বলে হিন্দুরা গো-জাতিকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন। এই কাহিনীর একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। গাভী দুধ দেয় বটে কিন্তু সেজন্য তাকে দোহন করতে হয়। অর্থাৎ দোহন ছাড়া দুধ পাওয়া যায় না। তদ্রুপ পৃথিবীতে শস্য ফলে কিন্তু সেজন্য তাঁকে শ্রমের সাথে চাষ করতে হয়। যে যেমন পৃথিবীকে চাষ করবে সে তেমন শস্য ফলাতে পারবে। শ্রমবিনা কোন ধন লাভ হয় না।

   বেদ অপৌরুষেয় হলেও পুরাণ কিন্তু মনুষ্য রচিত। বলা হয়ে থাকে যে, পুরাণ-শাস্ত্র মহর্ষি ব্যাসদেব প্রণীত। কিন্তু পণ্ডিতগণ ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখছেন যে, সব পুরাণ একই সময়ে রচিত নয়। যেহেতু পুরাণসমূহ একই সময়ে রচিত নয়, সেহেতু সব পুরাণ ব্যাসদেব রচিত নয়। ভাষাশৈলী দেখে বোঝা যায় যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সবচেয়ে আধুনিক। বায়ু পুরাণে পুরাণের ৫টি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, যথা সর্গ, প্রতিসর্গ, বশং, মন্বন্তর এবং বংশানুচরিত। সর্গ বলতে বোঝায় জীব-জগত সৃষ্টিকে। প্রতিসর্গ বলতে বোঝায় প্রলয় বা ধ্বংসকে। বংশ অর্থ বিভিন্ন রাজা-মহারাজা, ঋষি, দেবতা, অসুর প্রভৃতির বংশ পরিচয়। মন্বন্তর অর্থ মনুর অন্তর অথার্ৎ এক মনুর কাল থেকে আরেক মনুর কাল। বংশানুচরিত বলতে রাজবংশীয় ব্যক্তিবর্গের চরিত্র বোঝায়। পুরাণ মূলত দুই প্রকার যথা মহাপুরাণ ও উপপুরাণ। মহর্ষি ব্যাসদেব প্রণীত ১৮ খানা মহাপুরাণ হল (১) ব্রহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৫) লিঙ্গ, (৬) গরুড়, (৭) নারদীয়, (৮) শ্রীমদ্ভাগবত্, (৯) অগ্নি, (১০) স্কন্দ, (১১) ভবিষ্য, (১২) ব্র‏‏হ্মবৈবর্ত, (১৩) মার্কণ্ডেয়, (১৪) বামন, (১৫) বরাহ, (১৬) মৎস্য, (১৭) কূর্ম এবং (১৮) ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম ও শৈব মত অনুযায়ী পুরাণ তিন প্রকার। বৈষ্ণব পুরাণগুলো হল বিষ্ণু, নারদীয়, ভগবত, গরুড়, পদ্ম ও বরাহ পুরাণ। ব্রাহ্ম পুরাণগুলো হল ব্র‏‏হ্মাণ্ড, ব্রহ্ম-বৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য, বামন ও ব্রহ্ম পুরাণ। শৈব পুরাণগুলো হল মৎস্য, কূর্ম, লিঙ্গ, শিব, স্কন্দ ও অগ্নি পুরাণ। নিচে আঠারটি মহাপুরাণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হল।

১) ব্রহ্ম মহাপুরাণ

    ব্র‏‏হ্ম পুরাণকে আদি পুরাণ বলা হয় কারণ ১৮টি পুরাণের মধ্যে সবার আগে এ পুরাণ রচিত হয়েছে। ব্র‏‏হ্ম পুরাণে দশ হাজার শ্লোক রয়েছে। এ পুরাণে দুইটি খণ্ডে রয়েছে। পূর্ব খণ্ডে রয়েছে, সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবাসুরের যুদ্ধ, সূর্য ও চন্দ্রবংশ প্রভৃতির বর্ণনা এবং উত্তর খণ্ডে রয়েছে স্বর্গ, নরক, পাতাল, বর্ষ, দ্বীপ প্রভৃতির বর্ণনা।

২) পদ্ম মহাপুরাণ

    পদ্ম পুরাণে পঞ্চান্ন হাজার শ্লোক রয়েছে। এ পুরাণ ৫টি খণ্ডে বিভক্ত, যথা সৃষ্টি খণ্ড, ভূমি খণ্ড, স্বর্গ খণ্ড, পাতাল খণ্ড ও উত্তর খণ্ড। এ পুরাণে পুলস্ত্য মুনির ধর্মকথা, বেদপাঠ বিধি, গো-মাহাত্ম্য, শ্রীধর, দীননাথ, পৃথু, দিলীপ ও যুধিষ্ঠিরের উপাখ্যান, কাশী, গয়া, প্রয়াগ, প্রভৃতি তীর্থের মাহাত্ম্য, জগন্নাথের বিবরণ, মৎসাদি দশ অবতারের বিবরণ, শিব-পার্বতীর কথোপকথন প্রভৃতি বর্ণিত আছে।

৩) বিষ্ণু মহাপুরাণ

    বিষ্ণু পুরাণে শ্লোক সংখ্যা তেইশ হাজার। এখানে রয়েছে সৃষ্টি বিবরণ, সমুদ্রমন্থন, ধ্রুবের উপাখ্যান, প্রহ্লাদ-চরিত, জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষের বর্ণনা, মন্বন্তর বিবরণ, ভাগীরথের গঙ্গা আনায়ন, শ্রীকৃষ্ণের জীবন-বৃত্তান্ত, কলির স্বরূপ, কলির ধর্ম নিরূপণ, বিষ্ণুনাম স্বরণ মাহাত্ম্য প্রভৃতি।

৪) শিব মহাপুরাণ

    শিবপুরাণের শ্লোক সংখ্যা চব্বিশ হাজার। শিব পুরাণ ছয় ভাগে বিভক্ত, যথা জ্ঞান, বিদ্যেশ্বর, কৈলাস, বায়বীয় পূর্ব ও উত্তর ভাগ এবং ধর্ম সংহিতা। এ পুরাণে আছে পার্বতীর তপস্যা ও বিয়ের উপাখ্যান, শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শনলাভ, গণেশের বিয়ে, নন্দী-ভৃঙ্গির ইতিহাস, নল-দময়ন্তীর জন্ম রহস্য, চিত্ররথ রাজার কাহিনী প্রভৃতি।

৫) লিঙ্গ মহাপুরাণ

    লিঙ্গ পুরাণে শ্লোক সংখ্যা এগার হাজার। এ পুরাণে রয়েছে, লিঙ্গের উৎপত্তি, লিঙ্গ পুজা, দধীচির উপাখ্যান, লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা, সদাচার, জলন্ধর বধ, শিবব্রত, শিবের সহস্র নাম, শিবের নৃত্য, উপমন্যু উপাখ্যান, সনৎকুমার-নন্দী সংবাদ, অম্বরীষ উপাখ্যান, শিব মাহাত্ম্য, শিব-পূজাবিধি, সূর্যপূজাবিধি, দান-প্রকরণ, শ্রাদ্ধ-প্রকরণ প্রভৃতি।

৬) গরুড় মহাপুরাণ

    গরুড় পুরাণে ঊনিশ হাজার শ্লোক রয়েছে। এ পুরাণে পূর্ব ও উত্তর এই দুইটি খণ্ড আছে। পূর্ব খণ্ডে আছে গরুড়ের উৎপত্তি, বিষ্ণুর সহস্র নাম, জ্যোতিষতত্ত্ব, পূজাবিধি, দীক্ষাবিধি ইত্যাদি আর উত্তর খণ্ডে আছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, যমপুরীর বিবরণ, শ্রাদ্ধবিধি, প্রেতত্বের কারণ ইত্যাদি।

৭) নারদীয় মহাপুরাণ

    এ পুরাণে বিষ্ণুস্তুতি, বৈষ্ণবদের কথা, হরিভক্তি, বৈষ্ণব ধর্ম ও বৈষ্ণব আচরণ, শুকোৎপত্তি, মন্ত্র-শোধন, দীক্ষা, পূজা, কবচ, একাদশী ব্রত, বশিষ্ট-মান্ধাতা সংবাদ, প্রয়াগাদি তীর্থ মাহাত্ম্য, মোহিনী-চরিত্র প্রভৃতির উল্লেখ আছে। নারদীয় পুরাণের শ্লোক সংখ্যা পঁচিশ হাজার।

৮) শ্রীমদ্ভাগবত্ মহাপুরাণ

    এ গ্রন্থের রচয়িতা ব্যাসদেব এবং এর বক্তা তাঁর পুত্র শুকদেব। মহারাজ পরীক্ষিৎ শৃঙ্গি মুনি কতৃর্ক শাপগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, সাত দিনের মধ্যেই তাঁর সর্পদংশনে মৃত্যু ঘটবে। তখন শুকদেব কতৃর্ক তিনি ধর্মকথা শ্রবণ করে ধন্য হলেন। ভাগবতেই আছে যে, পুরাণসমূহের মধ্যে ভাগবত শ্রেষ্ঠ। ভাগবতে দ্বাদশ স্বন্ধে ৩৩৫টি অধ্যায়ে মোট ১৮ হাজার শ্লোক রয়েছে। ভাগবতে ভক্তিবাদের প্রাবাল্য রয়েছে। ভাগবতে আছে মায়াবাদ, ব্রহ্মার জগৎ-সৃষ্টি, পৃথু ও ভারত উপাখ্যান, কপিল মুনির পরিচয়, ভক্ত অজামিলের উপাখ্যান, প্রহ্লাদচরিত, ধ্রুবচরিত, সমুদ্র-মন্থন, চন্দ্র ও সূর্য বংশের বিবরণ, শ্রীকৃষ্ণলীলা, ভবিষ্য রাজাদের বিবরণ প্রভৃতি।

৯) অগ্নি মহাপুরাণ

    অগ্নি পুরাণে অগ্নিদেব বশিষ্ঠ মুনিকে ঈশান কল্প-বৃত্তান্ত শোনান। এতে রয়েছে শিব মাহাত্ম্য, অবতারতত্ত্ব, বিষ্ণপূজাদির নিয়ম, শাল-গ্রাম লক্ষণ ও পূজা, তীর্থ মাহাত্ম্য, গায়ত্রীর অর্থ, ধনুর্বিদ্যা, আয়ুর্বেদ, পশুচিকিৎসা, শান্তিকর্ম, শ্রাদ্ধবিধি, নানাবিধ পূজাবিধি, শব্দানুশাসন, ছন্দশাস্ত্র, নরকের বণর্না প্রভৃতি। এ পুরাণে পনের হাজার চারশত শ্লোক রয়েছে।

১০) স্কন্দ মহাপুরাণ

    কার্তিকের আরেক নাম স্কন্দ। দেব-সেনাপতি কার্তিকের নাম অনুসারেই এ পুরাণের নাম স্কন্দ হয়েছে। স্কন্দ পুরাণ ৭টি খণ্ডে বিভক্ত, যথা মহেশ্বর খণ্ড, বৈষ্ণব খণ্ড, ব্রহ্ম খণ্ড, কাশী খণ্ড, অবন্তী খণ্ড, নাগর খণ্ড এবং প্রভাস খণ্ড। এই পুরাণে একাশি হাজার আটশত শ্লোক রয়েছে। স্কন্দ পুরাণের ৭টি খণ্ডে দক্ষযজ্ঞ, সমুদ্র-মন্থন, পার্বতীর বিবাহ, কার্তিকের জন্ম, তীর্থ-বিবরণ, রথযাত্রা, দোলযাত্রা, ব্রত-বিবরণ, জাতিভেদ, দান-মাহাত্ম্য, শালগ্রাম-লক্ষণ, শিব-মাহাত্ম্য, বিন্ধ্য-নারদ সংবাদ, গঙ্গা-মাহাত্ম্য, কাশী-মাহাত্ম্য, কলাবতীর উপাখ্যান, প্রায়শ্চিত্ত-বিধি, অন্ধক বধ, তারকা বধ, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, শাম্ব-আদিত্য সংবাদ প্রভৃতি বর্ণিত আছে।

১১) ভবিষ্য মহাপুরাণ

    ভবিষ্য পুরাণে শ্লোক সংখ্যা চৌদ্দ হাজার পাঁচশত। এ পুরাণে আছে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া, চতুর্বর্ণের বিবরণ, আশ্রম ধর্ম, আদিত্য-চরিত, তিথি নিরূপণ, তিথি বিশেষে বৈষ্ণব পর্ব, শৈব-সৌর প্রভৃতি উপাসকভেদ, ব্রত নিরূপণ, শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্বের উপাখ্যান, বশিষ্ট, নারদ ও বামদেবের কথোপকথন, সূর্য মাহাত্ম্য প্রভৃতি।

১২) ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ

    ব্র‏‏হ্মবৈবর্ত পুরাণ ব্র‏‏হ্ম, প্রকৃতি, গণেশ ও কৃষ্ণ এই চার খণ্ডে বিভক্ত। এ পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। সাবর্ণি নারদকে যা বলেছিলেন, তাই ব্র‏‏হ্মবৈবর্ত পুরাণ। এতে সাবিত্রী-সত্যবানের উপাখ্যান ছাড়াও সুরথ, কার্তবীর্য, পরশুরাম প্রভৃতির উপাখ্যান রয়েছে। এছাড়াও এই পুরাণে সুরভী, স্বহা, স্বধা প্রভৃতির কথা রয়েছে। এই পুরাণের শ্লোক সংখ্যা আঠার হাজার।

১৩) মার্কণ্ডেয় মহাপুরাণ

    ব্যাসদেবের শিষ্য জৈমিনী মার্কণ্ডেয়কে বাসুদেবের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মহর্ষি তাঁকে বিন্ধ্যপর্বতে শকুন পক্ষীর নিকট যেতে বলেন। জৈমিনী সেখানে গিয়ে শকুন পক্ষীর নিকট বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মার্কণ্ডেয় পুরাণের সূচনা। এই পুরাণে নয় হাজার শ্লোক রয়েছে। এতে আছে চণ্ডী ও দুর্গাদেবীর মাহাত্ম্য, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের কলহ, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, মদালসার উপাখ্যান, মার্কণ্ডের জন্মবৃত্তান্ত, কুশের বংশ নিরূপণ, ইক্ষাকু-চরিত প্রভৃতি। 

১৪) বামন মহাপুরাণ

    বামন পুরাণে দশ হাজার শ্লোক আছে। এ পুরাণে বর্ণিত আছে বিষ্ণুর বামন ও বলির অবতারের উপাখ্যান, দান-মাহাত্ম্য, দেব-দানব যুদ্ধ, দক্ষযজ্ঞ, মদন-দহন, দুর্গা-চরিত, তপতি উপাখ্যান, পার্বতির জন্ম, তপস্যা ও বিবাহ, জাবালি-চরিত, শিব ও উমার বিবাহ, তীর্থ মাহাত্ম্য, মাহেশ্বরী, ভগবতী, সৌরী এবং গণেশ্বরী সংহিতা প্রভৃতি।

১৫) বরাহ মহাপুরাণ

    এ পুরাণের শ্লোক সংখ্যা চব্বিশ হাজার। এতে দুইশত আঠরটি অধ্যায় রয়েছে। অসুর হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে সমুদ্রের নীচে নিয়ে যায়। তখন বিষ্ণু বরাহমূর্তি ধারণ করে হিরণ্যাক্ষকে বধ করে পৃথিবীকে রক্ষা করেন। এই বরাহ অবতারের কাহিনীই এই পুরাণে মুখ্য। এছাড়াও এতে রয়েছে দেবদেবীর উৎপত্তি ও মাহাত্ম্য, বিভিন্ন প্রকার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত, কর্ম বিপাক, বিষ্ণু-মাহাত্ম্য, শঙ্খ-মাহাত্ম্য, পুলস্ত্য-করুরাজ সংবাদ, বহুবিধ ধর্ম-লক্ষণ প্রভৃতি।

১৬) মৎস্য মহাপুরাণ

    মৎস্য পুরাণে চৌদ্দ হাজার শ্লোক রয়েছে। এই পুরাণে বিষ্ণুর মৎস্য অবতারের বর্ণনা আছে। এছাড়াও এতে আছে মনুর সঙ্গে মৎস্যরূপী বিষ্ণুর কথোপকথন, ব্রহ্মাণ্ডোৎপত্তি, শ্রাদ্ধকাল, চন্দ্রোৎপত্তি, চন্দ্রবংশ কীর্তন, বহুবিধ ব্রত, দানাদি পুণ্যকর্ম, সাবিত্রী উপাখ্যান, বামন মাহাত্ম্য, নর্মদা-মাহাত্ম্য, মহাদান, ধর্ম, নীতি, মন্দির ও প্রতিমা নির্মাণাদির কথা।

১৭) কূর্ম মহাপুরাণ

    কূর্ম পুরাণে শ্লোক সংখ্যা সতের হাজার। এ পুরাণে কূর্মরূপী বিষ্ণুর মাহাত্ম্য, ভৃগুবংশচরিত, কশ্যপ-বংশ বিবরণ, জগতের উৎপত্তি কাল পরিমান, ভগবতীর সহস্রর নাম, দেবাদির উদ্ভব, দক্ষযজ্ঞ, যুগধর্ম, যোগ, ব্যাস-গীতা, ঈশ্বর-গীতা, কাশী ও প্রয়াগ তীর্থ মাহাত্ম্য, বর্ণপ্রথা ও জাতিসংকরের আলোচনা প্রভৃতির বর্ণনা রয়েছে ।

১৮) ব্রহ্মাণ্ড মহাপুরাণ

    এই পুরাণে শ্লোক সংখ্যা বার হাজার। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের চারটি পাদ রয়েছে। সেগুলো হল প্রক্রিয়া পাদ, অনুষঙ্গ পাদ, উপাদ্ঘাত ও উপসংহার পাদ। এতে রয়েছে সৃষ্টি, কল্প, যুগভেদ, মন্বন্তর, রাজবংশ, বর্ষ, ভারতবর্ষ ও দ্বীপাদির বিবরণ, ঋষিবংশ নিরূপণ, বৈবস্বতী সৃষ্টি, যযাতি উপাখ্যান, পরশুরাম-চরিত, প্রলয়, জীবগণের গুণানুসারে গতি প্রভৃতি।

উপপুরাণ

    আঠারটি মহাপুরাণ ছাড়াও যেসব উপপুরাণ রয়েছে তার মধ্যে বায়ু, নরসিংহ, মানব, দুর্বাসা, কপিল, সনৎকুমার, ঔষনস, বরুণ, কালিকা শাম্ব, নন্দী, সৌর, পরাশর, আদিত্য, মহেশ্বর প্রভৃতি পুরাণ উল্লেখযোগ্য।

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” নামক গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য নিচের <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন