7/Slider/slider-tag <center><div id='bp_recent'></div><div class='bp_footer'><small><a id='bp_recent_link' target='_blank' href='http://www.bloggerplugins.org/2011/09/recent-posts-thumbnails-blogger-widget.html?utm_src=bp_recent' style='padding: 1px 0px 0px 19px;text-decoration:none;'><a href='http://www.bloggerplugins.org/?utm_src=bp_recent' target='_blank' title='blogger widgets'></a></a></small></div> <script style='text/javascript' src='http://bloggergadgets.googlecode.com/files/recentposts_orig.js'></script> <script style='text/javascript'> var numberOfPosts = 5; var showPostDate = false; var showSummary = false; var titleLength = 0; var showCommentCount = false; var showThumbs = true; var showNoImage = true; var imgDim = 125; var imgFloat = 'left'; var myMargin = 5; var mediaThumbsOnly = true; var showReadMore = false; </script> <script src='https://hindudarshon.blogspot.com/feeds/posts/default?max-results=5&orderby=published&alt=json-in-script&callback=bprecentpostswiththumbnails'> </script></center>

পৃষ্ঠাসমূহ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১

উপনিষদ বা বেদান্ত

উপনিষদ বা বেদান্ত ‍কি

    বেদের জ্ঞানকাণ্ডকেই উপনিষদ বা বেদান্ত বলে। বেদের অন্তে রচিত বলে উপনিষদের আর এক নাম বেদান্ত। মুনি-ঋষিরগণ বেদের আধ্যাত্ম জ্ঞান বিতরণ করেছেন তাঁদের শিষ্যদের কাছে। আচার্যগণ যে জ্ঞান দান করতেন শ্রতিধর শিষ্যরা তা মুখস্থ করে রাখতেন এবং পরে তাঁরাও আচার্য্য হয়ে তাঁদের শিষ্যদের মাঝে সে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন। এভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় সে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং এক সময় তা লিপিবদ্ধ হয়ে উপনিষদ নামক পুস্তকে পরিণত হয়। মোট কথা উপনিষদ হল বেদের শিরোভাগ যাতে মুনি-ঋষিরা সহজ ও সুন্দর ভাষায় বেদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। “উপনিষদ” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় উপ + নি + সদ + ক্বিপ যার অর্থ- যা সংসার-বন্ধন শিথিল করে ব্রহ্মপ্রাপ্তি ঘটায় তাই উপনিষদ। আবার উপনিষদের অন্য অর্থ হচ্ছে গুরুর নিকট উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা। প্রতিটি বেদের আলাদা আলাদা উপনিষদ রয়েছে। যেমন ঋগ্বেদের ঐতরেয়, কৌষীতকি ও সাংখ্যায়ণ; সামবেদের ছান্দোগ্য ও কেন; কৃষ্ণ-যজুর্বেদের কঠ, শ্বেতাশ্বতর, মহানারায়ণ, মৈত্রায়ন ও তৈত্তিরীয়; শুক্লযজুর্বেদের বৃহদারণ্যক ও ঈশোপনিষদ এবং অথর্ববেদের প্রশ্ন, মুণ্ডক ও মাণ্ডূক্য উপনিষদ রয়েছে। 

উপনিষদ কত প্রকার

মুক্তিকোপনিষদে ১০৮খানি উপনিষদের নাম পাওয়া যায়। তবে ভগবান শঙ্করাচায্যর্ যে ১১খানা উপনিষদের ভাষ্য রচনা করে গেছেন সেগুলোই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, প্রাচীন এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। সে ১১খানা উপনিষদ ব্রহ্মোপনিষদ নামে পরিচিত। ঐ ১১খানা উপনিষদ হল ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য। নিম্নে ১১খানা ব্রহ্ম-উপনিষদের সক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হল।

উপনিষদ

ঈশ উপনিষদ

    ঈশ উপনিষদ মূলত শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী সংহিতার শেষ অধ্যায়, তাই একে বাজসনেয়ী সংহিতা উপনিষদও বলে। এই উপনিষদে মোট ১৮টি মন্ত্র রয়েছে। ঈশ উপনিষদের মূল বিষয়বস্তু হল সর্বভূতে ইশ্বর দর্শন। ব্রহ্ম সবত্রই বিদ্যমান এবং সবকিছুই ব্রহ্ম হতে সৃষ্ট। ঈশ উপনিষদ অদ্বৈতবাদকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভেদ জ্ঞানই এই উপনিষদেও মুখ্য বিষয়। ঈশ উপনিষদের ১৬নং মন্ত্রে বলা হয়েছে সঃ অহম অস্মি অর্থাৎ আমিই সেই পরম ব্রহ্ম। জীবই ব্রহ্ম কিন্তু মায়াবদ্ধ বলে জীব সেটা বুঝতে পারে না। এছাড়াও এখানে আছে পরলোকের কথা, মৃত্যুর সময় আত্মচিন্তা, সৎগতি প্রার্থনা প্রভৃতি।

কেন উপনিষদ

    কেন উপনিষদের প্রথম শব্দ “কেন”। সাম-বেদের তলবকার ব্রাহ্মণের নবম অধ্যায় বলে এই উপনিষদকে তলবকার উপনিষদও বলে। কেন উপনিষদ ৪টি খণ্ডে বিভক্ত। এই উপনিষদের উদ্দেশ্য অমৃতত্ব লাভ এবং ব্রহ্মের সঙ্গে জগৎ ও জীবনের সম্বন্ধ স্থাপন। কেন উপনিষদে ব্রহ্মের সরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ব্রহ্মকে চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না, কর্ণ দ্বারা শোনা যায় না, নাক দ্বারা ঘ্রাণ নেয়া যায় না, মন দ্বারা মনন করা যায় না অর্থাৎ ব্রহ্মকে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। যে বলে সে ব্রহ্মকে জেনেছে, সে আসলে কিছুই জানেনি। কারণ ব্রহ্মকে জানা যায় না, তিনি অজ্ঞেয়। কেন উপনিষদে ব্রহ্ম কতৃর্ক দেবতাদের দপচূর্ণের উপাখ্যান আছে। একদিন দেবতারা অসুদের পরাজিত করে খুব গর্ব অনুভব করতে লাগলেন। ব্রহ্ম তাদের দর্পচূর্ণ করার জন্য দক্ষ সেজে ইন্দ্রাদি দেবতাদের কাছে এলেন। দেবতারা তাঁকে চিনতে না পেরে তাচ্ছিল্য করতে লাগলেন। তখন দক্ষ একটি তৃণখণ্ড দেবতাদের সামনে রেখে এর উপর তাদের শক্তি প্রয়োগ করতে বললেন। অগ্নি সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে তৃণখণ্ড দগ্ধ করতে পারেননি, বায়ু তার সর্বস্ব প্রয়োগ করেও ঐ তৃণখণ্ড উড়াতে পারেনি। ইন্দ্র শক্তি প্রয়োগ করতে এলে দক্ষ অদৃশ্য হন। পরে হৈমবতী উমা আকাশে দৃশ্যমান হয়ে বললেন এনিই দক্ষরূপী ব্রহ্ম। তখন দেবতারা বুঝতে পারলেন আসলে ব্রহ্মের শক্তিতই তাঁরা বলীয়ান, তাদের নিজস্ব কোন শক্তি নেই।

কঠ উপনিষদ

    কঠ উপনিষদ কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় শাখার কঠ বা কাঠক ব্রাহ্মণের অংশ। এতে দুটি অধ্যায় এবং প্রতি অধ্যায়ে ৩টি বল্লী রয়েছে। কঠ উপনিষদে যম ও নচিকেতার উপাখ্যানটিই বেশি প্রাধান্য লাভ করেছে। নচিকেতা হলেন বাজশ্রবস নামক এক মুনির পুত্র। বাজশ্রবস মুনি একদিন বিশ্বজিৎ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞে দক্ষিণার প্রদানের জন্য যে গাভীগুলো আনা হয়েছিল সে গুলো অতি রুগ্ন ছিল। নচিকেতা বুঝতে পারলেন যে, এমন গোদানের ফল ভাল হতে পারে না। তিনি পিতাকে বলে বসলেন- “আপনি আমাকে কোন ঋত্বিকের উদ্দেশ্য দান করবেন?” তখন পিতা রাগের মাথায় বলে বসলেন- তোমাকে যমের উদ্দেশ্যে দান করলাম। নচিকেতা তখন পিতৃবাক্য রক্ষার্থে যমের গৃহে গেলেন। যমরাজ নচিকেতাকে দেখে খুশি হয়ে ধন-সম্পদ, হাতি-ঘোড়া, স্বর্ণ-রত্ন, অপ্সরা প্রভৃতি দিতে চাইলেন। কিন্তু জ্ঞানী নচিকেতা এসব কিছুই চাইলেন না। এসবের পরিবর্তে তিনি তিনটি বর চাইলেন। প্রথম বরে তিনি পিতার কাছে ফিরে যেতে চাইলেন, দ্বিতীয় বরে তিনি অগ্নি-বিদ্যা শিখতে চাইলেন এবং তৃতীয় বরে তিনি আত্মা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। যম নচিকেতার ঐ তিনটি বর দান করলেন এবং নচিকেতা পিতার নিকট ফিরে এলেন। ধন্য নচিকেতা, যার কাছে ধন-ঐশ্বর্য্য মুখ্য নয়, কেবল আত্মজ্ঞান লাভই মুখ্য।

প্রশ্ন উপনিষদ

    প্রশ্ন উপনিষদ অথর্ব বেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তর্গত এবং আচার্য পিপ্পলাদ এর প্রবক্তা। প্রশ্ন উপনিষদে ছয়টি প্রশ্ন ও তার উত্তর রয়েছে। সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়নী, কৌসল্য, ভার্গব, কবন্ধ প্রমূখ ব্রহ্মপরায়ণ ব্যক্তি আচার্য পিপ্পলাদের নিকট ছয়টি প্রশ্ন করেছিলেন এবং পিপ্পলাদ তার উত্তরদান করেছিলেন। ১ম প্রশ্ন কোথা হতে এই প্রাণীসকল জন্মলাভ করে? উত্তর প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করার জন্য তপস্যা করে রয়ি (জড় পদার্থ), প্রাণ ও মিথুন উৎপাদন করেন, ইহাই জাগৎ সৃষ্টির কারণ। ২য় প্রশ্ন কতজন দেবতা (ইন্দ্রিয়গণ) প্রাণী-শরীরকে বিশেষভাবে ধারণ করেন? উত্তর মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, বাক, মন, চক্ষু ও কর্ণ এগুলোই শরীরকে বিশেষভাবে ধারণ করে। ৩য় প্রশ্ন কোথা হতে প্রাণ জন্মলাভ করে? উত্তর আত্মা হতে প্রাণ জন্মলাভ করে এবং সঙ্কল্প দ্বারা ইহা শরীরে আগমন করে। ৪র্থ প্রশ্ন এই পুরুষ-দেহে কোন কোন ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায়? উত্তর নিদ্রার সময় পঞ্চ-ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায় অথার্ৎ মনের সাথে একীভূত হয় এবং একমাত্র প্রাণই তখন জেগে থাকে। ৫ম প্রশ্ন মানুষ আমৃত্যু ওঙ্কারের ধ্যান করলে কোন কোন লোক জয় করেন? উত্তর ওঙ্কার বিশ্লেষণ করলে হয়- ওঁ = অ + উ + ম। অকার স্থুল জগতে অবস্থিত ব্রহ্মের প্রতীক, যার ধ্যান করলে মনুষ্য জন্ম লাভ হয়। উ-কার সূক্ষ্ম জগতে অবস্থিত ব্রহ্মের প্রতীক, যার ধ্যান করলে চন্দ্র-লোকে যাওয়া যায়। ম-কার স্থুল ও সূক্ষ্ম জগতের অতীত আনন্দময় ব্রহ্মের প্রতীক, যার ধ্যান করলে সূর্য-লোকে যাওয়া যায়। ৬ষ্ঠ প্রশ্ন ষোড়শ-কলাবিশিষ্ট পুরুষ কোথায় থাকে? উত্তর সে পুরুষ হৃদয়াকাশে থাকে। ব্রহ্ম প্রথমে প্রাণ সৃষ্টি করলেন। প্রাণ হতে শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হতে আকাশ, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল, জল হতে পৃথিবী, পৃথিবী হতে ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয় হতে মন, মন হতে অন্ন, অন্ন হত বীর্য, বীর্য হতে বেদ, বেদ হতে কর্ম, কর্ম হতে লোকসমূহ এবং লোকসমূহের বিভিন্ন নাম সৃষ্টি করলেন।

মুণ্ডক উপনিষদ

    মুণ্ডক উপনিষদ অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই উপনিষদ অবিদ্যা মুণ্ডক বা মুক্ত করে বলে এর নাম মুণ্ডক হয়েছে। এর প্রবক্তা অঙ্গিরা এবং শ্রোতা শৌনক। এ উপনিষদে চমৎকার উপমা ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্রহ্মের সরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। শৌনক অঙ্গিরা ঋষির নিকট বললেন ভগবান, কোন বস্তুটি জানলে এই সমস্ত জগত সম্পর্কে জানা যায়? অঙ্গিরা শৌনককে পরা ও অপরা এই দুইটি বিদ্যার কথা বললেন। অপরা-বিদ্যা হল জাগতিক জ্ঞান আর পরা-বিদ্যা হল ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান। অপরা বিদ্যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় আর ব্রহ্মকে জানলে জগতের সমস্ত কিছু জানা হয়ে যায়। মুণ্ডক উপনিষদে ‘মাকড়সার’ উপমা দিয়ে ব্রহ্মকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মাকড়সা যেমন নিজের দেহ হতে সূতা উৎপাদন করে পুনরায় নিজের দেহেই তা গ্রহণ করে, তেমনি অক্ষর ব্রহ্ম হতে এই বিশ্বের উৎপত্তি। মাকড়সা যদি ব্রহ্ম হয় তবে তার দেহ হতে সৃষ্ট সুতার জাল হবে জগৎ। সুতার জাল যেমন মাকড়সার দেহ হতে অবিচ্ছিন্ন, তেমনি জগৎও ব্রহ্ম হতে অবিছিন্ন অর্থাৎ জগৎ ব্রহ্মেরই অঙ্গ। এই উপনিষদেরই অন্য জায়গায় বলা হয়েছে ব্রহ্ম রূপ লক্ষ্যবস্তুকে তীর দ্বারা বিদ্ধ করতে হবে। ওঙ্কার হচ্ছে ধনু আর মন হচ্ছে শর বা তীর। ওঙ্কার রূপ ধনুতে মন রূপ শর যোজনা করে ব্রহ্ম রূপ লক্ষ্যকে বিদ্ধ করাই সাধনার মূল উদ্দেশ্য। অথার্ৎ মুণ্ডক উপনিষদে প্রণব (ওঁ) মন্ত্র জপ করে মনকে ব্রহ্মের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

মাণ্ডূক্য উপনিষদ

    অথর্ব বেদের অন্তর্গত ১২টি মন্ত্র নিয়ে মাণ্ডূক্য উপনিষদ গঠিত। এই উপনিষদের দ্রষ্টা হলেন মাণ্ডূক্য ঋষি। এ উপনিষদে আত্মার চারটি পদ বা অবস্থার কথা বলা হয়েছে।  এ চারটি অবস্থা হল বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ ও তুরীয়। জাগ্রত অবস্থায় আত্মা যে রকম থাকে, তাকে বলে বৈশ্বানর। স্বপ্নাবস্থায় আত্মা যে রকম থাকে, তাকে তৈজস বলে। যখন কেউ নিদ্রিত হয় অথচ স্বপ্ন দেখে না, সে অবস্থাকে বলে সুষুপ্তি। সুষপ্তি অবস্থায় আত্মার আত্মার যে স্বরূপ, তাকে বলে প্রাজ্ঞ। যখন ইন্দ্রিয়সকল মনে এবং মন আত্মায় লীন হয় তখন কোন বাহ্য জ্ঞান থাকে না, এ অবস্থাকে সমাধি বলে। সমাধি অবস্থায় আত্মার যে সরূপ, তাকে তুরীয় বলে।

তৈত্তিরীয় উপনিষদ

    তৈত্তিরীয় উপনিষদ কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয় শাখার অন্তগর্ত। এটি তিন ভাগে বিভক্ত, যথা শিক্ষাবল্লী, ব্রহ্মানন্দবল্লী ও ভৃগুবল্লী। প্রতি বল্লী কতগুলো অনুবাকে বিভক্ত। শিক্ষাবল্লীতে শব্দোচ্চারণের নিয়ম, উপাসনা পদ্ধতি, আচরণীয় বিধি প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে। ব্রহ্মানন্দ বল্লীতে পঞ্চকোশ (অন্ন, প্রাণ, মন, বিজ্ঞান ও আনন্দ রূপ কোশ) ও ব্রহ্মানন্দ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ভৃগুবল্লীতে ব্রহ্মের স্বরূপ ও ব্রহ্ম-প্রাপ্তির উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে “ওমিতি ব্রহ্ম” অর্থাৎ ওঁ ব্রহ্ম স্বরূপ। এ উপনিষদে বেদাধ্যায়ীর যে কর্তব্য-কর্মের কথা বলা হয়েছে, তা অতি উদার। এ উপনিষদে বেদ অধ্যয়ন করা, সত্য কথা বলা, ইন্দ্রিয়-সংযম করা, চিত্ত-সংযম করা অর্থাৎ মনকে বশে আনা, যজ্ঞ করা, অতিথি সেবা করা, লৌকিক আচার ও সামাজিক ক্রিয়া-কর্ম করা, ঋতুকালে ভার্যাগমন ও সন্তান উৎপাদন করা, পুত্রকে লালিত-পালিত করে বিবাহ দিয়ে সন্তান উৎপাদন করা অর্থাৎ বংশরক্ষা করা প্রভৃতি কর্তব্য-কর্মের বর্ণনা করা হয়েছে। শিষ্যের প্রতি গুরুর যে উপদেশ বর্ণিত আছে, তা অতি মহৎ এবং এর মধ্যে ধর্মের সমগ্র রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। গুরু শিষ্যকে যে উপদেশ দিয়েছেন তা এরকম

 সদা সত্য কথা বলবে, ধর্ম থেকে বিচ্যুত হবে না।

 আত্মরক্ষা বিষয়ে যত্নবান হবে, উন্নতি লাভের জন্য মঙ্গলজনক কার্য করবে।

 অধ্যয়নে অমনোযোগী হবে না, গুরুকে দক্ষিণা দেবে।

 মাতা, পিতা, অতিথি এবং আচার্য যেন তোমার দেবতা হন অর্থাৎ তাঁদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করবে। 

 লোক সমাজে যে সকল কার্য অশোভনীয় তা করবে না।

 আচার্যগণের আদর্শ গ্রহণ করবে।

 নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ও শ্রদ্ধা সহকারে দান করবে।

 নম্রতা, সম্ভ্রম ও বদ্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের সাথে দান কারবে।

 শ্রৌত ও স্মার্ত কর্মে বা আচারে কোন সংশয় থাকলে নিকটবর্তী ব্রাহ্মণগণের স্মরণাপন্ন হবে এবং তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে।

ঐতরেয় উপনিষদ

    ঋক্-বেদের ঐতরেয় শাখার দ্বিতীয় আরণ্যকের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ই ঐতরেয় উপনিষদ। এতে ৩টি অধ্যায় আছে যার প্রথম অধ্যায়ে তিনটি খণ্ড, বাকী দুই অধ্যায়ে একটি করে খণ্ড রয়েছে। এই উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে সৃষ্টি-রহস্য, দ্বিতীয় অধ্যায়ে জন্মবৃত্তান্ত এবং তৃতীয় অধ্যায়ে আত্মার স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। ঐতরেয় মহিদাস্য হলেন ঐতরেয় উপনিষদের দ্রষ্টা। এ উপনিষদে জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে পূর্বে এই দৃশ্যমান জগৎ ছিল না, একমাত্র আত্মাই ছিল। সেই আত্মা বহু হবার বাসনা নিয়ে প্রথমে বিভিন্ন লোকসমূহ সৃষ্টি করলেন। তিনি একে একে সৃষ্টি করলেন অম্ভলোক (যা জলকে ধারণ করে), মরীচি লোক (আকাশ), মরলোক (পৃথিবী) ও অপলোক (সমুদ্র)। তিনি জল থেকে পুরুষাকার পিণ্ড গ্রহণ করলেন এবং সেই পিণ্ড থেকেই ইন্দ্রিয়সকল, পঞ্চভূত, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অন্ন প্রভৃতি সৃষ্টি করলেন। এ উপনিষদে সংসারী পুরুষদের তিনটি জন্মের কথা বলা হয়েছে। পিতৃবীজ  যখন মাতৃগর্ভে সিঞ্চিত হয়, তখন হয় তার প্রথম জন্ম। সে শুক্রানু ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে দেহ গঠন করে যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন হয় তার দ্বিতীয় জন্ম। সে পুরুষ মৃত্যুবরণ করে যখন পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন, তখন হয় তার তৃতীয় জন্ম।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ

    শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শাখার অন্তর্গত। এই উপনিষের প্রবক্তা হলেন ঋষি শ্বেতাশ্বতর। এতে মোট ৬টি অধ্যায় রয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে প্রণব বা ওঁ মন্ত্র জপ এবং ধ্যানের কথা উল্লেখ আছে। কাঠের মধ্যে আগুন প্রছন্ন অবস্থায় থাকে বলে তাকে দেখা যায় না কিন্তু দুটি কাঠের ঘর্ষণের ফলে আগুন জ্বলে অর্থৎ কাঠের মধ্যের আগুন বাইরে প্রকাশিত হয়। ব্রহ্মও তদ্রুপ জীবের হৃদয়ে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থকে। একমাত্র ওঙ্কার জপ ও ধ্যানের মাধ্যমে ব্রহ্ম প্রকাশিত হন। সাধকের নিজের দেহ একটি কাঠ এবং প্রণব (ওঙ্কার) আরেকটি কাঠ, এই দুই কাঠকে ধ্যান রূপ ঘষর্ণ দ্বারা আগুন রূপ ব্রহ্মের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়াও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে সূর্যস্তব রয়েছে এবং বলা হয়েছে যোগের পূর্বে সূর্যদেবের ধ্যান করা একান্ত আবশ্যক নইলে ধ্যানের কোন মূল্য থাকে না।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ

    বৃহদারণ্যক উপনিষদ শুক্লযজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ। এই উপনিষদে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর উপাখ্যান আছে। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করার সময় দুই স্ত্রী মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নীকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি সমান দুভাগে ভাগ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু ধর্মশীলা মৈত্রেয়ীর কাছে এই বিষয়-সম্পত্তি তুচ্ছ। তাই তিনি বললেন “যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং যদেব ভগবন্ বেদ তদেব মে ব্রহীতি” অর্থাৎ যার দ্বারা আমি অমৃত লাভ করতে পারব না, তা দ্বারা আমি কি করব? হে ভগবান্, আমাকে অমৃতের সন্ধান দিন। যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীর কথায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে অমৃত লাভের উপায় বললেন। প্রকৃতপক্ষে এই ধন সম্পদ বিষয়-বাসনা নশ্বর, একমাত্র আত্মাই অমর। তাই আত্মাকে জানলেই অমৃত লাভ করা যায় অর্থাৎ অমর হওয়া যায়।

ছান্দোগ্য উপনিষদ

    ছান্দোগ্য উপনিষদ সামবেদের তাণ্ড্য শাখা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তাণ্ড্য ঋষি এই উপনিষদের প্রবক্তা। যারা ছন্দ অর্থাৎ বেদগান করেন তাঁদের নাম ছান্দোগ্য। ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের ১০টি অধ্যয়ের শেষ আটটি অধ্যায়কেই ছান্দোগ্য উপনিষদ বলা হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে “তত্ত্বমসি” (তুমিই সেই) শব্দটি রয়েছে। এই এক শব্দের মধ্যে রয়েছে সমগ্র অৗদ্বতবাদ দর্শনের বীজ। গার্হপত্য অগ্নি উপকোসল কামলায়ণকে বললেন পৃথিকী, অগ্নি, অন্ন ও আদিত্য (সূর্য) ইহারা আমার তনু। আদিত্যমণ্ডলে ঐ যে পুরষকে দেখা যায় “সঃ অহম” অর্থাৎ তিনিই আমি। দক্ষিণাগ্নি তাঁকে বললেন জল, দিকসমূহ, নক্ষত্রসমূহ ও চন্দ্র আমার তনু। চন্দ্রের সে পুরুষই আমি। শেষে আবহানীয় অগ্নি তাঁকে বললেন প্রান, আকাশ, দ্যুলোক (স্বর্গলোক) ও বিদুৎ আমার তনু। ঐ বিদ্যুতে যে পুরুষ দেখা যায় তিনিই আমি। তবে ‘আমিই সেই ব্রহ্ম’ এই জ্ঞান মানুষের সব সময় আসে না। এই জ্ঞান যখন আসে তখন তাঁর মুক্তিলাভের সময় এসে যায়।

(আমা কর্তৃক লিখিত “হিন্দুধর্মের সারকথা” নামক গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)

এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট  পড়ার জন্য নিচের <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন