হিন্দুধর্মের সারকথা বই
আনন্দের সংবাদ এই যে, আমা কর্তৃক লিখিত "হিন্দুধর্মের সারকথা" নামক গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি ১৬টি অধ্যায় এবং ৫৪৪ পৃষ্ঠা সংবলিত। আশা করছি বইটি পাঠ করে পাঠক হিন্দুধর্মের মৌলিক বিষয় ছাড়াও অনেক গভীর দর্শন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারবেন। ধর্ম কি?, ধর্মের উৎপত্তি কোথায়?, ঈশ্বর কে?, দেবদেবীগণ কে? এবং দেবদেবীগণের পরিচয় কি?, অবতার কি?, আত্মা-পরমাত্মা ও ব্রহ্ম কি? ধর্মশাস্ত্র কি ও কত প্রকার?, মন্ত্র কি? শ্লোক কি? তন্ত্র কি? একজন হিন্দুর প্রতিদিন কি করা উচিত?, একজন হিন্দুর কার সাথে কেমন ব্যবহার বা আচরণ করা উচিত?, যজ্ঞ ও পূজা কি ও কত প্রকার?, উপাসনা কি ও কত প্রকার?, কিভাবে উপাসনা করতে হয়?, কর্ম-ভক্তি-জ্ঞান ও অষ্টাঙ্গ যোগ কি?, মূর্তি-পূজা কি এবং এর তাপর্য কি? কিভাবে নিজের পূজা নিজেকেই করতে হয়? বারো মাসে তের পার্বন কি? তন্ত্র-সাধনার রহস্য কি?, ষট-চক্র কি?, কিভাবে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করতে হয়?, কিভাবে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হলো এবং কখন ধ্বংস হবে?, পরলোক কি?, পুনর্জন্ম কি?, কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?, কিসে পাপ কিসে পুণ্য এবং কোন পাপে কোন শাস্তি?, দশটি সংস্কার কি? চতুর্বর্ণ এবং চতুরাশ্রম বা আশ্রম-ধর্ম কি?, সাংখ্য প্রভৃতি ছয়টি দর্শন কি এবং তাপর্য কি? হিন্দুধর্মে কতটি মত-পথ রয়েছে? এবং কোন মতে কিভাবে সাধনা করতে হয়? জ্যোতিষ বিদ্যা কি? এবং কোন তিথিতে কি করণীয়? এসব মৌলিক বিষয়সমূহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহকারে পাওয়া যাবে বইটিতে।
বইটি সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত হয়েছে। হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত গ্রন্থ অসংখ্য কিন্তু আজকাল এত গ্রন্থ পাঠ করার সময় ও সাধ্য অনেকেরই নেই। এই বইটি বেদ, উপনিষদ, গীতা, পুরাণ, মনুসংহিতা আদি স্মৃতি-শাস্ত্র সহ হিন্দুধর্মের সকল মৌলিক শাস্ত্রের উপাদান নিয়ে রচিত ফলে এক বই পড়েই অসংখ্য ধর্মশাস্ত্র পাঠের স্বাদ পাবেন বলে আশা রাখি। এছাড়াও পুরাণের বিভিন্ন রূপক গল্প-উপাখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দর্শনকে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুধর্মের প্রায় সবদিকই সংক্ষেপে, ক্ষেত্র বিশেষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মচর্চা করতে গিয়ে অথবা দৈনন্দিন জীবনে যাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদানে বইটি সক্ষম হবে বলে মনে করি।
এ পুস্তকে বেদ-উপনিষদ, পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রের
বিভিন্ন মন্ত্রের বাংলা অনুবাদ সহ চয়ন করা হয়েছে। নিত্যকর্ম ও পূজা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন
মন্ত্রেরও অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যাতে নারী-পুরুষ, যুব-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই
সহজে এবং ভালভাবে বুঝে পূজা ও নিত্যকর্ম সম্পাদন করতে পারে। হিন্দুধর্মে বহু মত-পথ
রয়েছে কিন্তু বইটিতে কোন বিশেষ মতকে প্রাধান্য দেয়া বা কোন মতকে ছোট করা হয়নি। সর্ব
ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে নিরপেক্ষ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বইটি রচনা করা
হয়েছে, ফলে বইটি যে কোন সম্প্রদায় তথা যে কোন ধর্মের পাঠক পাঠ করতে পারবেন। দিন দিন
মানুষ শাস্ত্রবিমুখ তথা জ্ঞানবিমুখ হয়ে পড়ছে। এই জ্ঞানবিমুখ জাতিকে সহজ সরল পন্থায়
জ্ঞানের সন্ধান এই বইটি দেবে বলে আশা রাখি। "হিন্দুধর্মের সারকথা" গ্রন্থটি
নিম্নোক্ত ষোড়শ অধ্যায়ে লিখিত:-
১) হিন্দুধর্ম,
সৃষ্টিতত্ত্ব ও ঈশ্বরতত্ত্ব।
২) ধর্মশাস্ত্র।
৩) দেবদেবী।
৪) হিন্দুধর্মের
বিভিন্ন মত ও পথ।
৫) যজ্ঞ
ও পূজা।
৬) নিত্যকর্ম।
৭) দশবিধ
সংস্কার ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া।
৮) কর্ম,
জ্ঞান, ভক্তি ও অষ্টাঙ্গ যোগ।
৯) দৈত,
দৈতাদৈত ও অদৈতবাদ।
১০)
চতুরাশ্রম ও চতুর্বর্ণ।
১১)
ষড় দর্শন।
১২)
কিছু হিন্দুধর্মীয় আচার ও ক্রিয়া কর্মের তাৎপর্য।
১৩)
ধর্ম সংশ্লিষ্ট কতিপয় জ্ঞাতব্য।
১৪)
অবতার তত্ত্ব।
১৫)
জ্যোতিষবিদ্যা।
১৬) মৃত্যু, পুনর্জন্ম, পরলোক ও মুক্তি।
সংগ্রহের মাধ্যম
“হিন্দুধর্মের
সারকথা” বইটি সরাসরি ক্রয় করতে বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পেতে নিম্নোক্ত ঠিকানায়
যোগাযোগ করুন
আনন্দ
পাবলিসার্স
৩৮/৪
বাংলাবাজার, ঢাকা
ফোন-
01712-777304 অথবা 01680-919111
লেখক পরিচিতি
"হিন্দুধর্মের সারকথা" বইয়ের সূচিপত্র
"হিন্দুধর্মের সারকথা" বইয়ের মুখবন্ধ
ক্ষুদ্র
পক্ষবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চটকপক্ষীর যেমন গগনবিহারী হওয়ার সাদ জাগে, বিকৃত পদযুক্ত
খঞ্জের যেমন গিরিলঙ্ঘনের সাদ জাগে, ক্ষুদ্র তরণী আর ছিন্ন পাল নিয়ে কোন উদাসী নাবিকের
যেমন সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সাদ জাগে, তেমনি স্বল্পজ্ঞানী ও সম্বলহীন হয়েও আমার সাদ
জেগেছিল একটি গ্রন্থ রচনা করার। অক্ষমতা ও বাধা-বিঘ্ন থাকা সত্ত্বেও
সাহস করে রচনাকার্য শুরু করেছিলাম ঐ ঈশ্বরেরই ভরসায়। ঈশ্বর বিমুখ হননি বলেই গ্রন্থখানি
প্রকাশ করতে পেরেছি। আমি রচনা করেছি এমন কথা বলার স্পর্ধা আমি করি না। কারণ ঈশ্বরইতো
জ্ঞান দিয়েছেন, ভাষা দিয়েছেন, সেই সাথে আশাও দিয়েছেন, আমিতো উপলক্ষ মাত্র। প্রত্যেক
সৃষ্টিকর্মের পশ্চাতে থাকে কিছু কথা, থাকে কিছু কাহিনী। কিন্তু কজনই বা ঐ ইতিহাস জানতে
চায়? সবাই মৌচাকের সঞ্চিত মধু পান করেই তৃপ্ত হয় কিন্তু মৌমাছীর মধুসঞ্চয়ের ইতিহাস
ও শ্রমের কথা অন্তরালেই থেকে যায়। এই পুস্তকটি রচনার পিছনেও একটা ইতিহাস আছে। এ বিষয়ে
কিছু কথা না বলে পারছি না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সনাতন সংঘ নামক এক হিন্দু
ছাত্র-সংগঠনের সাথে যুক্ত
হয়েছিলাম। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পার্শ্বে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির মন্দির ছিল। আমি প্রত্যহ
সন্ধ্যাকালে ঐ মন্দিরে যেতাম। মন্দিরে গিয়ে যে খুব ধর্মকর্ম করতাম, তা নয়। সেখানে
মূলত গান-বাদ্য ও গ্রন্থপাঠ করেই
সময়টা কেটে যেত। মন্দির ও সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে আমার সাথে অনেক হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীর পরিচয় ঘটেছিল।
হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীগণের মধ্যে আমি যথেষ্ট জ্ঞান-ভক্তির অভাব লক্ষ করতাম।
তাদের অনেকেই সনাতন ধর্মের মূল দর্শন থেকে বিচ্যুত ছিল। শাস্ত্রপাঠ ও প্রার্থনা-উপাসনার প্রতি অধিকাংশেরই
অনাগ্রহ ছিল। তাছাড়া ধর্মগ্রন্থের দুবোর্ধ্যতা ও দুষ্প্রাপ্যতা যেমন ছিল, তেমনি পাঠের
সুযোগও ছিল কম। আমি তখন মনে মনে ভাবতাম, সমগ্র হিন্দুধর্মের মূলনীতি বর্ণিত আছে, এমন
একটি পুস্তক যদি থাকত, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীগণ সহজেই ধর্ম
সম্পর্কে জানতে পারত। তবে আমি নিজে কিছু গ্রন্থ পড়তে থাকলাম। কিছুকাল পর যখন গ্রন্থের
প্রতি গভীর প্রেম জন্মাতে শুরু করে তখন আমি বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কতিপয়
ভ্রাতার সহযোগিতায় হিন্দুধর্মের বেশ কিছু প্রামাণিক শাস্ত্র ক্রয় করি এবং মন্দিরে
একটি পাঠাগার স্থাপন করি। ঐ পাঠাগার স্থাপনের পর আমার শাস্ত্র অধ্যয়নে মনোযোগ ও গতি
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন কিছু ছাত্র-ছাত্রী মন্দিরে বসে
এবং কিছু ছাত্র=ছাত্রী পাঠাগার থেকে গ্রন্থ নিয়ে পাঠ করত।
হিন্দুধর্ম
সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করতে থাকায় আমার জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে
থাকে। মাঝে মাঝে একটা ধর্ম বিষয়ক পুস্তক লিখার ইচ্ছা জাগত। কিন্তু নিজের অক্ষমতার
কথা ভেবে ইচ্ছাকে অবদমিত করে রাখতাম। অবশ্য পাঁচটি ধর্মীয় নাটক রচনা করেছিলাম যার
মধ্যে চারটি নাটক বিশ্ববিদ্যালয় মন্দিরের অনুষ্ঠানে মঞ্চায়িত হয়েছিল। উচ্চচিন্তার
জগতে পদচারণ করতে করতে একদিন আমার জীবনে ঘটে যায় এক মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক ঘটনা।
স্নাতক শেষ বর্ষে অধ্যয়নকালে আমার পিতা পরলোক গমন করেন। পিতার মৃত্যুতে আমি শোকাবিভূত
ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। পিতার অবর্তমানেও যে পুত্রকে জীবন-ধারণ করতে হয়, পূর্বে
সেকথা ভাবিনি বলে তাঁর মৃত্যকে আমি সহজে মেনে নিতে পারিনি। পিতার মৃত্যুর পর বৈদিক
রীতিনীতি অনুসরণ করে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করি এবং এগার দিন যাবৎ ব্রহ্মচারীর বেশে
কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করার পর তাঁর শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করি। ঐ এগার দিনের ব্রহ্মচর্য
ব্রত আমাকে বিশেষভাবে ভাবাতে শুরু করে। সেই সাথে আমার মনে আধ্যাত্মিকতা ও হিন্দুধর্মের
প্রতি শ্রদ্ধাবোধও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত আমি ঐ সময়েই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুজে পেয়েছিলাম।
আর এটাও উপলদ্ধি করেছিলাম যে, মানুষের জীবনে ব্রহ্মচর্যের কেন প্রয়োজন।
পিতার
মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ধর্ম সম্পর্কে একটি ক্ষুদ্র আকৃতির পুস্তক লেখার ইচ্ছা জাগে আমার।
সেজন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্দিরে বসে একটি খাতায় বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা ও গীতার
বিভিন্ন মন্ত্র চয়ন করতে থাকি। সেই সাথে চণ্ডী ও পুরাণের বিভিন্ন অংশ এবং কিছু ধর্ম
বিষয়ক বাংলা গ্রন্থ থেকেও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। স্নাতক শেষে আমার উপর সনাতন
সংঘের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার অর্পিত হয়। সেই সাথে প্রকৃতিও আমার সম্মুখে জীবনের
এক চরম সত্য উন্মোচন করে। প্রকৃতি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় পিতার অবর্তমানে আমাকেই
সংসারের হাল ধরতে হবে এবং জীবিকা-নির্বাহের জন্য কর্মের অনুসন্ধান করতে হবে। তাছাড়া
পিতার মৃত্যুর পর আমার কুমারী ভগিনীদ্বয়কে পাত্রস্থ করাও আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। একদিকে
সনাতন সংঘের গুরুভার অন্যদিকে অর্থকষ্ট ও কর্ম-অন্বেষণ এই দুইয়ের
মধ্যে পড়ে দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাৎ করতে থাকি। সব কিছু জীবনটাকে বিভীষিকাময় করে তোলে।
নিষ্ঠুর প্রকৃতি আমাকে জাতাকলে পিষ্ট করে যে অট্টহাস্য করত তা আজও আমার কানে বাজে।
দুঃখ
আমাকে কাঁদিয়েছে বটে কিন্তু তারপরও দুঃখকে আমি কখনও পর ভাবিনি কারণ দুঃখই আমাকে জীবনের
অর্থ খুজতে সাহায্য করেছিল। দুঃখই আমার মনের সুষুপ্ত-রাগিনীকে জাগিয়েছিল।
সে আমার অতি-ইচ্ছাকে দমন করে নিজের অক্ষমতাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।
সে ভোগ-বিলাসকে ভয় দেখিয়ে
দূরে সরিয়ে দিয়ে অতৃপ্ত আত্মাকে গরল পান করিয়ে শীতল রেখেছিল। সে মদন-বান পর্যন্ত ফিরিয়ে
দিয়ে কামনা-বৃত্তিকে নিষ্প্রাণ ভূধরের মত নিশ্চল করে রেখেছিল। একমাত্র
দুঃখই সেদিন আমার হৃদয়-সাগরে ডুব দিয়ে ঘুমন্তপ্রায় ভাষাকে জাগিয়েছিল।
যা হোক, ঐ যাতনাময় দিনগুলোতে মন্দিরে গিয়েই একটু শান্তির পরশ পেতাম। সংঘ পরিচালনার
সাথে সাথে আমার কর্ম অন্বেষণও চলতে থাকে। কিন্তু বিধিবাম, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের
প্রাথমিক পরীক্ষার প্রাক্কালে আমি শিরঃপীড়া ও চক্ষু সমস্যায় আক্রান্ত হই। সেই সাথে
কটি দেশেও পীড়া অনুভব করি। হয়তো মন্দিরের শক্ত মেঝেতে বসে অনেকক্ষণ ধরে পাঠ করার
ফলেই ঐসব রোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অসুস্থতা নিয়েই কর্ম অনুসন্ধান করতে করতে দয়াময়ী মায়ের
কৃপায় আর স্বর্গত পিতৃদেবের বরে একটি সরকারী কর্মের সুযোগ আসে। আমি যশোরে তুলা উন্নয়ন
কর্মকর্তা পদে যোগদান করি। তখন মনে হয়েছিল যেন শূন্যে উড্ডীয়মান আশ্রয়হীন এক কপোত
আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছে।
যশোরে
কর্মরত থাকাকালে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে ধর্ম-সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তক
ক্রয় করি এবং বিশদাকারে একটি ধর্মীয় পুস্তক রচনার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু তখন দেখলাম
যে, পূর্বের সে বেশ কিছু কাগজপত্র ও আমার রচিত সে পাঁচটি নাটকের পাণ্ডুলিপি অলৌকিক
উপায়ে হারিয়ে গেছে। অগত্যা নতুন করে আবার শুরু করি। কিন্তু লেখা শুরু করার পর আবার
পূর্বের কটিপীড়া, শিরঃপীড়া ও চক্ষু-সমস্যা বৃদ্ধি পেতে
থাকে। এছাড়াও আরও কিছু নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে কখনও কখনও শয্যাগতও হতে হয়েছিল। মায়ের
কৃপায় পাণ্ডুলিপি লেখা যখন শেষের দিকে তখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে কৃষি সম্প্রসারণ
কর্মকর্তা পদে ভোলায় যোগদান করি। নতুন কর্মে যোগদানের জন্য বেশ কিছুদিন পুস্তক রচনাকার্য
ব্যহত হয়। তারপর একদিন সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপির কার্য সমাপ্ত করে যশোরের সৌরভ নামক এক
যুবকের নিকট টাইপ করতে দেই। ঐ যুবক বেশ যত্ন করেই টাইপ করেছিল। তাই তার কাছে আমি বিশেষ
কৃতজ্ঞ। টাইপের কাজ শেষ হতে না হতেই আমি ছয় মাসব্যাপী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ
করার জন্য বগুড়া যাই। সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পর টাইপের কাজ সমাপ্ত হয় এবং আমি ব্যস্ততার
ফাকে ফাকে একটু একটু করে সম্পাদনা করতে থাকি। কিন্তু বিঘ্ন যেন চিরকাল আমাকেই বন্ধু
রূপে পেতে চায়। প্রশিক্ষণের শেষপর্যায়ে এক মারাত্মক সড়ক-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে
আমাকে প্রায় দুই মাস শয্যাগত থাকতে হয়। ঐ দুর্ঘটনায় আমি মৃত্যুবরণও করতে পারতাম।
জগজ্জননী হয়তো পুস্তকটি রচনা করার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে সুস্থ হওয়ার
পর প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করি এবং মায়ের কৃপায় পুস্তকটি প্রকাশ করতে সক্ষম হই।
কালের
বিবর্তনে কর্মক্ষেত্রে এসেছে নানা বৈচিত্র্য। সময়ের সাথে সাথে মানুষের কর্মব্যস্ততাও
বেড়েছে। তাছাড়া ইদানিং মানব-জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করতে
হয় লৌকিক শিক্ষা অর্জন করতে। ফলে দিনদিন আধ্যাত্মিক পুস্তক পড়ার সময় কমে আসছে। হিন্দুধর্মের
রয়েছে কাব্যিক, মহাকাব্যিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও দার্শনিক গ্রন্থ সহ অগণিত গ্রন্থ
যা পাঠ করার সময় ও সাধ্য সবার হয়ে ওঠে না। তাছাড়া সংস্কৃতে লেখা অধিকাংশ গ্রন্থই
দুর্বোধ্য বলে তা সর্ব-সাধারণের নিকট অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এসব কথা বিবেচনা
করেই “হিন্দুধর্মের সার কথা” গ্রন্থটি রচনা করলাম যা পাঠ করে পাঠক সংক্ষিপ্ত পরিসরে
কিন্তু খুব সহজে সমগ্র হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন। তাছাড়া এই পুস্তকে
বেদ, উপনিষদ, পুরাণ এবং মনুসংহিতা আদি স্মৃতিশাস্ত্রের আলোকে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা
দেয়া হয়েছে। ফলে পাঠক এক পুস্তক পাঠ করেই বিভিন্ন পুস্তকের স্বাদ পাবেন বলে আশা রাখি।
বাংলা
ভাষায় হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত অনেক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থপ্রণেতাগণই
হিন্দুধর্মের কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু একই পুস্তকের
মধ্যে সমগ্র হিন্দুধর্মের সারবস্তু আছে এমন পুস্তক বিরল। তাই আমি সাধারণ হিন্দুজাতিকে
সমগ্র হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায়
এই পুস্তকটি রচনা করেছি। এ পুস্তকে সাহিত্য-অলঙ্কারযুক্ত, অতি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ,
দুর্বোধ্য ও সংস্কৃতবহুল বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। ফলে এই পুস্তক সব বাংলা-ভাষাভাষীর নিকট সহজবোধ্য
হবে বলে আশা করছি। এ পুস্তকে বেদ-উপনিষদ, পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রের বিভিন্ন মন্ত্রের
বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে। নিত্যকর্ম ও পূজা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রেরও অনুবাদ ও ব্যাখ্যা
দেয়া হয়েছে যাতে নারী-পুরুষ, যুব-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই
সহজে এবং ভালভাবে বুঝে পূজা ও নিত্যকর্ম সম্পাদন করতে পারে। এ পুস্তকে আধুনিক বাংলা
বানান রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পুরাতন রীতিও অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম অর্থাৎ মুনিদেরও ভুল হতে পারে, আমিতো কোন ক্ষুদ্র মনুষ্য। এ পুস্তকে
অনিচ্ছাকৃতভাবে বানানজনিত কিছু ভুল রয়ে গেছে। পাঠক যদি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন
তবে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
পুস্তকে
আমি কোন সম্প্রদায় বা কোন ধর্মকে ছোট বা বড় করার চেষ্টা করিনি। শুধু সত্যকে প্রকাশ
করার চেষ্টা করেছি মাত্র। যখন বৈষ্ণব মত সম্পর্কে লিখেছি তখন নিজেকে একজন বৈষ্ণবই মনে
করেছি, যখন শাক্ত সম্পর্কে লিখেছি তখন যেন মাতৃভক্ত পুত্রই হয়ে গেছি আর যখন শৈবদের
সম্পর্কে লিখেছি তখন হৃদয়-শ্মশানে যেন ঐ নটরাজ শিবেরই নৃত্য দেখেছি। সব
মতকেই নিজের মত ভেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আমি বিদ্বেষে নয়, সমন্বয়ে বিশ্বাসী।
তাই স্বামী বিবেকানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে আজও আমি বলি, সম্প্রদায় থাকুক যেন সাম্প্রদায়িকতা
না থাকে।
হিন্দুদের
গ্রন্থসমূহ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। কোন সংস্কৃত পণ্ডিত আমি নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে
স্বপ্রণোদিত হয়ে একবার দেবভাষা সংস্কৃত শেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সময় ও যথার্থ
গুরুর অভাবে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারিনি। অবশ্য সংস্কৃত ভাষা চর্চাকালে সহজবোধ্য সংস্কৃত-শ্লোকের অর্থ করতে খুব
বেশি কষ্ট হত না। কিন্তু অনভ্যাস ও অনধ্যায়ের ফলে ঐ বিদ্যার অনেকটাই আজ হ্রাস পেয়েছে।
কৃত্তিবাস ওঝা, কাশীদাস, রমেশ চন্দ্র দত্ত, রসিকমোহন, পঞ্চানন তর্করত্ন আদি যেসব সংস্কৃত-পণ্ডিত সংস্কৃত ভাষায়
রচিত ধর্মগ্রন্থগুলোর বঙ্গানুবাদ করে গেছেন তাদের প্রতি আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। ঐসব মনিষীকৃত
বঙ্গানুবাদ ও টীকা-ভাষ্যে আমি অন্ধবিশ্বাস করেছি। কারণ তাঁরা আমাদের
মত সাধারণ মানুষের জ্ঞানার্জনের জন্য দুর্বোধ্য সংস্কৃত-গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ
করে গেছেন। নিজ মত প্রতিষ্ঠা বা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে যশ-খ্যাতি লাভ করার ইচ্ছা
তাঁদের ছিল না। তাছাড়া তাঁদের বঙ্গানুবাদে এমন কিছু ছিল না যা ধর্মবিরুদ্ধ। তাই আমি
পুস্তক রচনাকালে তাঁদের কৃত বঙ্গানুবাদের সাহায্য নিয়েছি। দর্শনের মত উচ্চ-চিন্তা রাজ্যে বিচরণ
করা কি সাধারণ মানুষের কার্য? স্বামী বিবেকানন্দ, নিগমানন্দ সরস্বতী, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী
আদি সিদ্ধ পুরুষগণ হিন্দু-দর্শনকে সহজ-সরলভাবে সাধারণ মানুষের
নিকট উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের বক্তৃতা ও রচিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করেই জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহনের
সাহস ও শক্তি পেয়েছি। বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের কথা না বললেই নয়। আমি স্বামীজীর
দর্শন সংক্রান্ত বক্তৃতা পড়ার পর উপনিষদ পড়েছি। ফলে আমার উপনিষদের গুঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি
করা সহজ হয়েছে।
আমি ধর্মের বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করার সময় বেদ-বেদান্ত ও পুরাণ উভয়কেই
আশ্রয় করেছি। তাই একই বিষয় বেদ-বেদান্তে যেমন আছে পুরাণে তা ভিন্নতর মনে হতে
পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু বিষয় স্ববিরোধীও মনে হতে পারে। যেমন— বেদে সূর্য ও বিষ্ণু
এক হলেও পুরাণে সূর্য ও বিষ্ণুকে ভিন্ন দেবতা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্ব
বর্ণনার ক্ষেত্রেও বেদ ও পুরাণে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আমি একটি কথা বলতে
চাই যে, বেদ ও পুরাণ ভিন্ন স্বাদের বা ভিন্ন রসের গ্রন্থ। বেদে যে বীজ রোপিত হয়েছিল
পুরাণে তা শাখা-প্রশাখা সমেত বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বেদের আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহ
পুরাণে কাব্যের ভনিতায়, রূপকের ছলে, কল্পনার আশ্রয়ে এবং গল্প-দৃষ্টান্তের মাধ্যমে
বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বেদ ও পুরাণ ভিন্ন ভিন্ন রসের গ্রন্থ হলেও পুরাণের বিভিন্ন
কাহিনী সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে তা আর বেদ থেকে ভিন্ন মনে হয় না। আবার একই বিষয়
বিভিন্ন পুরাণের মধ্যে বিভিন্ন রকমভাবে বর্ণনা করা আছে। যেমন কার্তিক ও গণেশের জন্ম-বিবরণ একেক পুরাণে একেক
রকম। এর কারণ সব পুরাণ একই সময় এবং একই ব্যক্তির হাতে রচিত নয়। এটা আমার কথা নয়,
বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত পুরাণের ভাষা, রচনাশৈলী ও ঐতিহাসিক সত্যতা বিচার করেই উক্ত
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তবে কাহিনীর এই ভিন্নতাকে আমি ছোট করে দেখছি না কারণ একই
বিষয়ের প্রকাশভঙ্গি একেক জনের নিকট একেক রকম হতে পারে আবার একই বস্তু স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন রকম
হতে পারে। আমি বিভিন্ন পুরাণের তুলনামূলক আলোচনা নয় বরং বিভিন্ন পুরাণের সমন্বয় সাধনের
চেষ্টা করেছি। আসলে জ্ঞানী পাঠকের মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত যে কোন গ্রন্থের স্থুল
ও ঋণাত্মক ভাব বর্জন করে সূক্ষ্ম ও ধনাত্মক ভাব গ্রহণ করা। যা হোক, পুস্তকের সব কিছুই
যে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে পেয়েছি, তা নয়। কিছু কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা যখন কোন গ্রন্থেই
পেতাম না তখন ঈশ্বরের নাম নিয়ে ঐ বিষয়ে ধ্যানস্থ হোতাম। ঈশ্বরের কৃপায় চিন্তা করতে
করতে এক সময় সব জটিল প্রশ্নের উত্তর কেমন করে যেন পেয়ে যেতাম তা বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।
আমি একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, কোন কিছু খোজার মত খোজলে তার সন্ধান
অবশ্যই পাওয়া যায়।
আমার
মত ক্ষুদ্র মনুষ্যের পক্ষে পুস্তক রচনা করা দুঃসাধ্যই ছিল। যাদের কৃপায় আমার এ পুস্তক
রচনা সম্ভব হয়েছে তাদের প্রতি আমার ঋণ এক জন্মে শোধ হবে না। প্রথমেই আমি কৃপাময় ঈশ্বরের
প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবই তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা না থাকলে শতজন্মের প্রচেষ্টায়ও
এ পুস্তক রচনা সম্ভব হত না। ঈশ্বর আমার সৃষ্টিকর্তা। ঈশ্বরই আমার জীবন-তরীর হাল ধরে আছেন আর
আমি শুধু পাল তুলেছি মাত্র। ঐ পালে যখন কৃপা নামক সুবাতাস বইতে থাকে তখনই তরী নির্দিষ্ট
গন্তব্যে চলতে থাকে। আমার সব কিছু তাঁরই দান। আমিতো শুধু নিমিত্ত মাত্র।
আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার জন্মদাতা পিতা-মাতার প্রতি। পিতা-মাতার চেয়ে উত্তম শিক্ষক আর কেই বা হতে পারে? পিতা-মাতা শুধু আমাকে লালন-পালনই করেননি, তাঁরা আমাকে ধর্মশিক্ষাও দিয়েছেন। আমার ধর্মশীলা মাতার ধর্মাচারণ, ব্রতপালন, কর্মনিষ্ঠতা ও সারল্য দেখেই আমি ধর্মের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলাম। আমার পিতৃদেব সম্পর্কে বিশেষ কথা না বললেই নয়। আমি পিতৃদেবের মত প্রতিভাশীল, জ্ঞানী, উদার, সত্যবাদী ও দৃঢ়প্রতীজ্ঞ ব্যক্তি খুব কমই দেখেছি। তিনি বাহ্য-ধর্মাচরণে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু অন্তরে তাঁর প্রবল ধর্মভাব ছিল। তিনি প্রায়শই বলতেন— সাধু সেজো না, সাধু হও। পিতৃদেবের নিকট আমি যা শিক্ষা অর্জন করেছি তা কোনো তুলনা বা উপমা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। বাল্যে তাঁর মুখে রামায়ণ-মহাভারত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ফলে বাল্যে থেকেই আমার রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী মুখস্থ ছিল। তিনিই আমার চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিলেন। আমার মধ্যে যদি কোন উচ্চ-চিন্তা, সাহিত্যবোধ ও দর্শনের স্ফুরণ ঘটে তার জন্য আমি পিতৃদেবের নিকট ঋণী। সদা সত্য কথা বলবে এবং মানবসেবা করবে, তাঁর এই বেদবাক্যতুল্য উপদেশামৃতই আমি জীবনের মূলমন্ত্র ও চলার পথের পাথেয় করেছি। ইহ জীবনের শেষদর্শনকালেও তিনি ঐ উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মৃত্যুও পূর্বে যে বর দিয়ে গিয়েছিলেন তার শক্তিতেই এ দুঃসাধ্য-সাধন করতে পেরেছি।
বাল্যে আমার দীক্ষাগুরু শ্রীমৎ আচার্য বিবেকানন্দ গোস্বামীর নিকট আমি খুব আদরণীয় ছিলাম। আমি তাঁর সেবা করব কি উল্টো তিনিই আমার যার-পর-নাই স্নেহ-যত্ন করতেন। তাঁর দর্শনের জন্য যেখানেই যেতাম সেখানেই তিনি আমাকে নিজের পাশে বসিয়ে ভোজন করাতেন আর মিষ্টি স্বরে কথা বলতেন যা আজও আমার কানে বাজে। তিনি আমাকে একটা পত্রে লিখেছিলেন, তোমাকে চাঁদ হতে হবে তারা হলে চলবে না। তারকারা চাঁদ অপেক্ষা কোটী গুণ বড় হলেও পৃথিবীতে তারকাদের তুলনায় চাঁদের প্রয়োজনই বেশি। হয়তো এজন্যেই তিনি তারা নয় চাঁদ হয়ে আলো ছড়াতে বলেছেন। চাঁদ হতে পারব কিনা তা জানি না, যদি জোনাকীও হতে পারি তবে সে অবদান গুরুদেবেরই।
বেবী,
গীতা, জয়া, ক্ষমা ও কৃষ্ণা এই পঞ্চভগিনীর নিকট আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে লালিত-পালিত ও পরিপুষ্ট করে
তুলেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করে আমাকে
কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। ছেলেবেলায় আমরা সব ভ্রাতা-ভগিনী সন্ধ্যাকালে একত্রিত
হয়ে ঈশ্বর-বন্দনা করতাম। এসবই আমাকে সঙ্গীত ও ধর্মের প্রতি অনুরাগী
করে তুলেছিল। আমার দুর্দিনের সময় ভগ্নিপতিগণও পাশে ছিলেন তাই তাদের প্রতিও বিশেষ কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করছি। আর একজন বিশেষ ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছি না। ঐ বিশেষ
ব্যক্তিটির নাম মিতা মণ্ডল। যশোরে কর্মসূত্রে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল। মিতা দিদিকে
আমি শ্যামা দি বলে ডাকি। মা শ্যামাই যেন ঐ মিতা দিদির রূপ ধরে দুঃসময়ে সাহায্যের হাত
বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি অনেক শ্রম স্বীকার করে আমাকে ভারত হতে বেশ কিছু ধর্ম বিষয়ক
পুস্তক এনে দিয়েছিলেন যা ছাড়া আমার এই পুস্তক লেখা সম্ভব হত না। এছাড়াও আরো বিভিন্ন
বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে আমাকে যে ঋণী করেছেন, তা এক জন্মে শোধ হওয়ার
নয়।
এক
ধর্মসভায় পুরি সম্প্রদায়ের একদল সন্ন্যাসী আমার বক্তৃতা শুনে বিশেষ প্রীত হয়ে আমাকে
আশীর্বাদ করেছিল। ঐ পূণ্যাত্মা সাধুদের আশীর্বাদের জোড়েই আমার মত একজন সাধারণ মানুষের
পক্ষে এ অসাধ্য-সাধন সম্ভব হয়েছে। সুমনানন্দ পুরি নামক এক শাস্ত্রজ্ঞ অবধূতের
নিকট আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। তাঁর সাথে আমি অনেক শাস্ত্র আলোচনা করেছি। অনেক অজানা বিষয়ে
তিনি আমাকে ধারণা দিয়েছেন। এছাড়াও যারা আমাকে নেপথ্যে থেকে আশীর্বাদ করেছেন, অলক্ষে
থেকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং পুস্তক রচনায় উদ্দীপিত করেছেন তাদের সকলের প্রতি আমি অশেষ
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পরিশেষে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার ধরিত্রী মাকে। ধরিত্রী মা
আমাকে পরম যত্নে লালন করছেন এবং তাঁর কৃপায়ই আজও আমি জীবন-ধারণ করছি। পুষ্প, বৃক্ষ,
তরুলতা, পশুপক্ষী, চন্দ্র, সূর্য, নদী, সমুদ্র, পর্বত, আকাশ, বায়ু প্রভৃতি প্রকৃতির
সব উপকরণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এরাই আমার উৎকৃষ্ট শিক্ষক। এরাই আমাকে সাহিত্যের ভাষা
যুগিয়েছে এবং অন্তরের লুকায়িত সত্য ও সুপ্তপ্রায় ভাবকে বাইরে প্রকাশ করেছে।
পরিশেষে
আমি বলতে চাই, পুস্তক রচনা করে যশ-খ্যাতি লাভ বা অর্থ
উপার্জন আমার উদ্দেশ্য নয়। একজন হিন্দুর নিজেকে হিন্দু হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে হিন্দুধর্ম
সম্পর্কে যতটুকু জানা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু জানানোই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে আমি একথাও
জানি যে, আমি কোন বিখ্যাত সাহিত্যিক বা দার্শনিক নই। আমার এ পুস্তক সকল হিন্দুর ঘরে
ঘরেও পৌঁছাবে না এবং হয়তো সব পাঠকের মনোপুতও হবে না। কিন্তু তারপরও এ পুস্তক পাঠ
করে একজন পাঠকও যদি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করতে পারেন এবং নিজের আধ্যাত্মিক
চেতনাকে জাগ্রত করতে পারেন, তবেই আমি কৃতার্থ হব। ঐ পূণ্যাত্মা পাঠকের জন্যই আমার মানব-জন্ম স্বার্থক হবে।
আকাশ বৈরাগী
বৈশাখ, ১৪২৪
হিন্দুধর্মের সারকথা বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠার ছবি
এই ওয়েবসােইটের সকল ধর্মীয় পোস্ট পড়ার জন্য এই <পোস্ট দেখুন> অংশে ক্লিক করুনআরও পড়ুন
আরও পড়ুন
বইটি পড়া শুরু করলাম। ভালোই লাগছে। আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনবইটি স্টক আউট হয়ে গেছে। কিন্ত সংগ্রহ করে পড়া প্রয়োজন। কিভাবে সংগ্রহ করতে পারি? কেউ যদি হার্ড কপি দেন তাহলে আমি ফটোকপি করে পড়তে পারি। এমন কেউ যদি থাকেন তাহলে দয়া করে আমাকে জানান।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। বইটি আবার পুনর্মুদ্রিত হবে।
মুছুন